35 verified Rokomari customers added this product in their favourite lists
কিরীটী অমনিবাস (১০ম খণ্ড)
ভুমিকা
কিরীটী অমনিবাসের দশম খণ্ডে তিনটি উপন্যাস অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রথমটি হল 'ঘুম নেই'। সমগ্র উপন্যাসটি ডায়েরি-রীতিতে রচিত। এখানে লেখক ও অপ..
TK. 630
In Stock (only 1 copy left)
* স্টক আউট হওয়ার আগেই অর্ডার করুন
বইটি বিদেশি সাপ্লাইয়ারের নিকট থেকে সংগ্রহ করতে ৩০-৪০ দিন সময় লাগবে।
Product Specification & Summary
কিরীটী অমনিবাস (১০ম খণ্ড)
ভুমিকা
কিরীটী অমনিবাসের দশম খণ্ডে তিনটি উপন্যাস অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রথমটি হল 'ঘুম নেই'। সমগ্র উপন্যাসটি ডায়েরি-রীতিতে রচিত। এখানে লেখক ও অপরাধী একই ব্যক্তি। ডায়েরির মধ্য দিয়ে অপরাধী যেন তার স্বীকারোক্তি করে গেল। কিন্তু কাহিনীর একেবারে শেষ অংশে ছাড়া কোথাও তার অপরাধ সম্পর্কে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ আসে না। বরং মনে হয়, সেও যেন সূর্যপ্রসাদের অকৃত্রিম শুভানুধ্যায়ীরূপে তাঁর হত্যাকারীর সন্ধান পাবার জন্য আগ্রহী এবং কিরীটীর সঙ্গে তার পুরোপুরি সহযোগিতাই লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু শেষকালে তাকেই যখন হত্যাকারীরূপে জানা যায় তখন যেন মনের মধ্যে অকস্মাৎ অবিশ্বাসের ধাক্কা লাগে। কি কারণে একজন সুপ্রতিষ্ঠিত এম. আর. সি. পি. ডাক্তার তিন-তিনটে খুন করতে গেল? ডাক্তারের ডায়েরি থেকে তার শেষ স্বীকারোক্তিতে জানা যায়, অর্থের নেশা আর পাপের নেশাই তাকে এই ভয়াবহ পথে নিয়ে গিয়েছিল। অর্থের নেশা বোধ হয় এমনই যে তা আর প্রয়োজন পূরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। তখন মানুষ আর অর্থকে পায় না, অর্থই মানুষকে পেয়ে বসে। একটিমাত্র উপার্জনশীল বোন যার সংসারে সেই উচ্চবিত্ত ডাক্তারের অপরাধমূলক পথে অর্থলাভে প্রয়োজন কোথায়? হয়তো অর্থের নেশা তাকে এমনি পেয়ে বসেছিল যে, স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবনের বিবেচনা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর পাপের নেশাও বোধ হয় অদৃশ্য অপদেবতার মত কাঁধে চড়ে মানুষকে চালিয়ে নিয়ে বেড়ায়, ম্যাকবেথের মত তখন আর একটি খুন করে থামতে পারে না। একটির পর আর একটি, তার পর আর একটি খুনের পথ ধরে চলতে থাকে। প্রথমে জগৎজীবন, তারপর পুলকজীবন, অবশেষে সূর্যপ্রসাদ-নিষ্কৃতি পাবার জন্য ডাক্তার একটির পর একটি খুন করে চলেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিষ্কৃতি সে পায় নি, অদৃশ্য বিধাতার শাস্তি অনিবার্যভাবে
তার উপরে এসে পড়েছে। এই নৃশংস সমাজপ্রতারক পাপীর অন্তরতলে কি প্রায়শ্চিত্তের আগুন অহরহ জ্বলছে? বোন মিতার চোখে ধরা পড়েছে যে দাদা রাত্রে ঘুমোয় না। ডাক্তার নিজের ঘুমকে যে হনন করেছে, তাই তার ঘুম নেই। কিন্তু ঘুম যে তার বড় দরকার। সূর্যপ্রসাদকে সে আর্সেনিক দিয়েছিল কিন্তু সে বেছে নিল ভেরোনল। সেই ভেরোনলই তাকে চিরকালের জন্য ঘুম পাড়িয়ে দিল।
কিরীটীর বর্ণনা ডাক্তার এভাবে দিয়েছে—‘চমৎকার দেহসৌষ্ঠব ভদ্রলোকের।... পরিধানে গেরুয়া পাঞ্জাবি ও পায়জামা, গায়ে একটা সাদা শাল, পায়ে চপ্পল, মুখে বর্মা চুরোট’। উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বময় চেহারা। অন্যান্য জায়গার মত এখানেও সে প্রশান্ত, বাসংযমী সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণশীল এবং মানবচরিত্র সম্পর্কে অভ্রান্ত জ্ঞানসম্পন্ন। অন্য সকলেই যখন একটা বদ্ধমূল ধারণায় বশীভূত তখন সে-ই ভিন্ন পথ অনুসরণ করেছে। অনুমান ও প্রমাণের একটির পর একটি সূত্র অনুসন্ধান করে চরম সত্যে উপনীত হয়েছে। একটা নস্যির কৌটো, জুতোর কাদার চিহ্ন, মাটিতে পায়ের দাগ, চেয়ারের সামান্য একটু স্থানান্তর ইত্যাদি নানা আপাততুচ্ছ বস্তু থেকে সে তার সত্যসন্ধান পেয়েছে। চুরুটের ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মধ্য দিয়ে সে তার নোতুন নোতুন সন্ধানসূত্র আবিষ্কার করে অবশেষে তার লক্ষ্যস্থলে গিয়ে পৌঁছয়। তার আত্মগত ভাবনা বজ্রনির্ঘোষে তার শেষ সিদ্ধান্তের মধ্যে ফেটে পড়ে—‘আপনি! হ্যাঁ আপনি, ডাক্তার সেনই—সূর্যপ্রসাদের হত্যাকারী!”
গোয়েন্দা কাহিনীর মধ্যে কিছু কৌতুকের স্পর্শ, কিছু প্রণয়ের রক্তরাগ থাকলে কাহিনী আরও উপভোগ্য হয়ে ওঠে। আলোচ্য উপন্যাসে কৌতুকচরিত্র হল দারোগা ব্রিজনন্দন পাণ্ডে। তার প্রত্যেক কথার মধ্যে ‘মারো গোলি' শ্রোতাদের চিন্তাক্লিষ্ট মনেও যথেষ্ট কৌতুক সঞ্চার করে। সে একবার সমর, আর একবার আবদুলকে অপরাধী ভেবে যে ধরনের নিশ্চিত আত্মপ্রসাদ বোধ করেছে তাও কম কৌতুক-রসাত্মক হয় নি। সমরের প্রতি মিতার ভালবাসা যে চাপা বেদনা ও গোপন অশ্রুনির্ঝরের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে তা হিংসা-সন্দেহ-ষড়যন্ত্র ও হত্যার চতুর্দিক ব্যাপী বিষবাষ্পের মধ্যে অমৃতের একটি স্নিগ্ধ আলোকরেখার মত উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
আলোচ্য খণ্ডের দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘কলঙ্ককথা’। এ উপন্যাসের অপরাধমূলক ঘটনাটি একটু ভিন্ন ধরনের। এখানে অর্থের নেশা কিংবা ব্যক্তিগত বিদ্বেষ অপরাধমূলক ঘটনার প্ররোচনা দেয় নি। এখানে সেই প্রণয়ঘটিত ঈর্ষা ও ব্যর্থতার জ্বালাই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পরিণতি লাভ করেছে। ষড়যন্ত্র ও হত্যার সঙ্গে জড়িত কয়েকটি angry generation-এর বিপ্লবী প্রতিনিধি, যারা ক্রুদ্ধ, উদ্ধত, বেপরোয়া ও আগুনের ঝাণ্ডাধারী, কিন্তু আসলে তারাও সকলে সেই আদিম রিপুর বশীভূত। সেই আদিম ঈর্ষা ও নিঃসপত্ন অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা তাদের অন্ধ জিঘাংসায় উত্তেজিত করে তুলেছে। মনে হয়, বিপ্লব ও সংগ্রামের স্লোগানগুলি তাদের পক্ষে কত বিসদৃশ, কত হাস্যকর!
সত্যসন্ধানী কিরীটীকে সেই যৌবনদীপ্ত, সদাসক্রিয় গোয়েন্দারূপে এখানে দেখি না। এখানে সে যেন একটু বয়সের ভারে মন্থর, ক্লান্ত মনে উদ্যমের অভাব, কাজের মধ্যে
ঝাঁপিয়ে পড়বার আগ্রহ যেন আর নেই—‘একদিন ছিল নেশা আর উত্তেজনা—কিন্তু আজ যেন সেই নেশা আর উত্তেজনা ঝিমিয়ে এসেছে।' তাই এ বইতে তার যেন অনেকটা উপদেষ্টার ভূমিকা, ক্রিয়ার মধ্যস্থলে রয়েছে সুদর্শন। শ্যামপুকুরের থানা অফিসার সুদর্শন মল্লিক ব্রিজনন্দন পাণ্ডের ন্যায় স্থূলবুদ্ধি ভাঁড়চরিত্র নয়। সে বুদ্ধিমান, ব্যক্তিত্বশালী ও সঠিক পথে তদন্তে সক্ষম। এখানে সে কিরীটীর সহযোগী এবং কিরীটীর তদন্তধারা অনুসরণ করে প্রকৃত অপরাধীর সন্ধানে অনেকখানি সফল। শেষের দিকে অবশ্য কিরীটীও প্রত্যক্ষভাবে সত্য উদ্ঘাটনে প্রবৃত্ত হয়েছে। কিন্তু তখনও কিরীটী ও সুদর্শনের সক্রিয়তা পাশাপাশি চলেছে।
কিরীটী-কাহিনীর বৈশিষ্ট্য হল সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের জেরা করে একটি প্রত্যাশিত স্বীকারোক্তির দিকে তাদের নিয়ে যাওয়া। কিরীটী ও সুদর্শন এভাবে সুশান্তর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তিকে জেরা করে হত্যারহস্যের সন্ধানের দিকে এগিয়েছে। শেষকালে মোক্ষম প্রমাণ মিলল পার্কে ফেলে যাওয়া চপ্পল থেকে। তবে মূল হত্যাকারিণী প্রতিভার স্বভাব ও ক্রিয়ার পরিচয় খুব কম পাওয়া গেছে, তাই সে যখন হত্যাকারিণীরূপে প্রমাণিত হল তখন বিস্ময়ের আঘাত কাটিয়ে উঠতে আমাদের একটু সময় লাগে ।
এ উপন্যাসে দুটি ঘরোয়া পরিবেশ রয়েছে. সুদর্শন ও সাবিত্রী এবং কিরীটী ও কৃষ্ণাকে নিয়ে দুটি স্নিগ্ধ, প্রীতিপ্রদ পরিবেশ। ঘৃণা-বিদ্বেষ ও রক্তপাতের বেষ্টনীর মধ্যে দুটি নিরাপদ শান্তির নীড়। স্নেহে-যত্নে-নর্মালাপে মধুর দুটি সুখী পরিবার।
আলোচ্য খণ্ডের তৃতীয় উপন্যাস ‘হীরা চুনি পান্নার’ কাহিনী দূরবর্তী নির্জন অঞ্চলে একটি জমিদারী এস্টেটকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে, সেজন্য ঘনীভূত রহস্যের বিস্তারে উপন্যাসটি বিশেষ চমকপ্রদ হয়ে উঠেছে। রতনগড়ের ভয়সংকুল প্রাসাদের কক্ষে কক্ষে কত না বিসর্পিল ষড়যন্ত্র, রক্তাক্ত হিংসা আর অবরুদ্ধ কান্নার স্মৃতি জড়িত হয়ে আছে। সেই প্রাসাদের এক রহস্যরোমাঞ্চিত কক্ষে দুর্ধর্ষ রবিশঙ্কর দিনরাত তার অটল একাকিত্বের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছে। চতুর্দিকব্যাপী রাতের অন্ধকারের মধ্যে তার ঘরের হাজার পাওয়ারের আলোটি সকলের মনে তীক্ষ্ণ আতঙ্ক জাগিয়ে অবিরাম জ্বলছে। রবিশঙ্কর চরিত্রটি শেষকালে যেন হঠাৎ খুব বেশি পোষমানা ও শান্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু তার বন্দিত্বের আগে পর্যন্ত সে মূর্তিমান ত্রাসের মত সমগ্র কাহিনীকে রহস্য-কণ্টকিত করে রেখেছে। রতনগড় এস্টেটের জমিদার-পরিবারের লোভ-কামনা-হিংসা-ষড়যন্ত্র নিয়ে উপন্যাসের কাহিনী বিবর্তিত হয়েছে। এই জমিদার পরিবারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে ডাঃ ঘোষালের পরিবার। এ কাহিনীর একদিকে রয়েছে লোভ ও হিংসার বীভৎস রূপ, অন্যদিকে রয়েছে ভালবাসা ত্যাগ ও দুঃখ বরণের করুণ বেদনাসিক্ত মূর্তি।