Category:স্মারকগ্রন্থ ও বিবিধ
২০০৮ সন। আমি তখন নারায়ণগঞ্জের মদনপুরে বেশ বড়ো একটা গ্রুপ অফ কোম্পানিজের একটি শিল্প কমপ্লেক্সে মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও মানব সম্পদ) হিসেবে কর্মরত। সেখানে ছোটো-বড়ো মিলে প্রায় ১২ ট..
২০০৮ সন। আমি তখন নারায়ণগঞ্জের মদনপুরে বেশ বড়ো একটা গ্রুপ অফ কোম্পানিজের একটি শিল্প কমপ্লেক্সে মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও মানব সম্পদ) হিসেবে কর্মরত। সেখানে ছোটো-বড়ো মিলে প্রায় ১২ টি কারখানা ছিল। তিন শিফট মিলে মোট শ্রমিক সংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই হাজারের মতো। বেশ কিছু শ্রমিক তাদের পরিবারসহ কারখানা কমপ্লেক্সের ভিতরে বাস করতেন। প্রায় ৪০০ মহিলা শ্রমিক ও কাজ করত সেই শিল্প কমপ্লেক্সে।
কিছুদিন পর লক্ষ্য করলাম সেখানে শ্রমিকদের জন্য কোন রকম বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। মনে মনে ভাবলাম এ বিষয়ে কিছু একটা করা যেতে পারে। কমপ্লেক্সের ভিতরে একটি খোলা মাঠসহ বেশ কিছু খালি জায়গা ছিলো। ছিলো দুটো বড়ো বড়ো পুকুর। পরিকল্পনা করলাম কারখানার ভিতরে শ্রমিক আর তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য একটি খেলাধুলা আর আনন্দ অনুষ্ঠানের আয়োজন করার। কর্তৃপক্ষ থেকে এইজন্য ১৫ হাজার টাকা বরাদ্দ পেলাম যা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে অপ্রতুল। সাপ্তাহিক একটি ছুটির দিনে কারখানার ভিতরে সারাদিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। কারখানার ভিতর এবং বাইরে থেকে অনেক শ্রমিক কর্মচারী তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে।
শ্রমিকদের জন্য আন্ত কারখানা ভলিবল প্রতিযোগিতা, সাঁতারসহ আরো কিছু কিছু প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। শ্রমিকদের স্ত্রী, মহিলা শ্রমিক আর শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য ও কিছু কিছু খেলাধুলার ব্যবস্থা রাখা হয়। আন্ত ইউনিট ভলিবল প্রতিযোগিতায় চূড়ান্ত পর্বে একটি বল স্ম্যাশ করতে গিয়ে দুঃখজনকভাবে একজন শ্রমিক তাঁর হাতে প্রচণ্ড আঘাত পায়। তাঁর ডান হাতের হাড় ভেঙে যায়। প্রতিষ্ঠানের মেডিক্যাল অফিসারকে বলে তাৎক্ষণিকভাবে ঐ শ্রমিককে ঢাকার যাত্রাবাড়িতে একটি হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষা করার পর তার হাতের হাড়ে ফ্র্যাকচার ধরা পড়ে। দিন দশেক চিকিৎসার পর সে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায়। যতটুকু মনে পড়ে তার হাসপাতালের বিল ছিল প্রায় ৬ হাজার টাকার মতো। কারখানার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা মালিকপক্ষকে এই বলে বোঝানোর চেষ্টা করে যে যেহেতু সেই শ্রমিক খেলতে গিয়ে আহত হয়েছে কাজেই তাঁর হাসপাতালের খরচ কোম্পানি বহন করার দরকার নেই। মেডিক্যাল অফিসার আমাকে বারবার তাগাদা দিচ্ছিলেন বিল পরিশোধের জন্য। কারণ চিকিৎসা শেষে মেডিক্যাল অফিসারের অনুরোধে ইতোমধ্যেই ঐ শ্রমিককে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালের বিলটা তখনো পরিশোধ করা হয়নি।
মেডিক্যাল অফিসার ওই বিল পরিশোধের জন্য প্রধান কার্যালয়ে ও ধরনা দেন। কিন্তু মালিকের অনুমতি না থাকায় তাতে কোন লাভ হয়নি। আমি কর্তৃপক্ষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে যেহেতু এই ক্রীড়া অনুষ্ঠান কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষেই করা হয়েছে কাজেই শ্রমিকের প্রাপ্ত এই আঘাত একটি ‘ওয়ার্ক প্লেস ইনজুরি’ হিসেবেই বিবেচিত হবে এবং সেই কারণে এর চিকিৎসা খরচ আইন অনুযায়ী কোম্পানিরই বহন করার কথা। কিন্তু কারো কারো প্ররোচনার কারণে প্রচণ্ড এই খরচ দিতে রাজি হয়নি। আমি তখন মেডিক্যাল অফিসারকে বলি যে কর্তৃপক্ষ বিল পরিশোধ করতে রাজি না হলে হাসপাতালের বিল আমি আমার ব্যক্তিগত অর্থ থেকেই পরিশোধ করব। যাহোক আমার এই প্রস্তাবের কথা শোনার পর অবশেষে মালিকপক্ষ ওই শ্রমিকের হাসপাতালের বিল পরিশোধ করতে সম্মত হয়।
ইতোমধ্যেই ঐ শ্রমিক সুস্থ হয়ে কাজে যোগদান করে। একদিন সকালে আমি ঐ শ্রমিককে দেখতে তাঁর কারখানায় যাই। আমি তাঁকে ডেকে আমার কাছে নিয়ে আসি। তাঁর আঘাত পাওয়া হাতের উপর আমি আমার হাত রেখে তাঁর আঘাত আর এই কারণে তার কষ্ট পাওয়ার জন্য দুঃখ আর সমবেদনা প্রকাশ করি। প্রচণ্ড আবেগে সেই শ্রমিক আমার কথার কোন উত্তর দিতে পারছিল না। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। এক পর্যায়ে উক্ত শ্রমিক আমাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কেঁদে ওঠে। এই অবস্থায় আমি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে থাকি। আশেপাশে তখন এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। অনেক শ্রমিককে তখন চোখ মুছতে দেখা যায়। এই পরিবেশে তখন আমি ও আমার আবেগ আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারিনি। আমার দুচোখের কোণে ও তখন বিন্দু বিন্দু জল।
Report incorrect information