6 verified Rokomari customers added this product in their favourite lists
সূচি
উপক্রমণিকা
প্রথম অধ্যায়
মীর মর্শারফ : জীবন ও মানস
জীবনের চড়াই-উতরাই
যেভাবে ‘হয়ে ওঠা’
দ্বিতীয় অধ্যায়
উনিশ শতকের ..
TK. 250TK. 188 You Save TK. 62 (25%)
Get eBook Version
US $2.51
Product Specification & Summary
সূচি
উপক্রমণিকা
প্রথম অধ্যায়
মীর মর্শারফ : জীবন ও মানস
জীবনের চড়াই-উতরাই
যেভাবে ‘হয়ে ওঠা’
দ্বিতীয় অধ্যায়
উনিশ শতকের বাংলা গদ্য
শুরু থেকে দেখা : বঙ্কিম-পূর্ব কাল
গদ্য কাঠামোর সচেতন শিল্পী : বঙ্কিমচন্দ্র
ভূমিকা
মীর মর্শারফ হোসেন সৃষ্টির বৈচিত্র্যে, ভাষা ও রচনারীতির উৎকর্ষে এবং জীবনসত্য ও শিল্প-সৌন্দর্য্যনৈপুণ্যে অবশ্যই বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মুসলমান লেখক। মর্শারফ হোসেন (১৮৪৮-১৯১২) বঙ্কিমচন্দ্র ও রামনারায়ণ-দীনবন্ধুর সমসাময়িক লেখক। তাঁর প্রথম উপন্যাস রত্নবতী (১৮৬৯) বস্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী থেকে মাত্র চার বছর পরে প্রকাশিত হয়। জমীদার দর্পণ (১৮৭৩) নীলদর্পণের তেরো বছর পরে প্রকাশিত হয়। এর উপায় কি প্রহসনটির প্রকাশের সময় ১৮৭৫, মাত্র ছ’বছর আগে (১৮৬৯) রামনারায়ণ তর্করতেœর চক্ষুদান প্রকাশিত হয়। বিষয়বস্তু ও রচনাভঙ্গির দিক দিয়ে মর্শারফ হোসেনের উপন্যাস, নাটক ও প্রহসন যথাক্রমে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস, দীনবন্ধুর নাটক ও রামনারায়ণের প্রহসনের সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত। বসন্তকুমারী নাটকটিও কীর্তিবিলাস থেকে শুরু করে বহু নাটকে সপত্মীপুত্রের প্রতি বিমাতার লালসা ও বিদ্বেষের যে বিপরীত প্রবৃত্তির মন্থনজাত হলাহল দেখা যায় সেই নাট্যধারার সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং বলা যায় উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কলকাতার সাহিত্যসমাজে উপন্যাস ও নাটকের যে ধারা প্রবহমান ছিল, মর্শারফ হোসেনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রচনা তার সঙ্গে সমভাবাপন্ন ছিল। তথাপি তিনি জীবিত কালে কলকাতার সাহিত্যসমাজে তাঁর যথাযোগ্য স্থান পাননি, তার কারণ, তিনি সারাজীবন মফঃস্বলেই কাটিয়ে দিলেন এবং প্রচার অভাবে যথাযোগ্য স্বীকৃতি পেলেন না।
মর্শারফ হোসেনের সাহিত্যসৃষ্টির মধ্যে দুইটি স্তর লক্ষ্য করা যায়। প্রথম স্তরে তিনি খাঁটি সাহিত্যসাধক এবং সংস্কৃত ভাষাশ্রয়ী চিত্রবর্ণনা-অলঙ্কারসমৃদ্ধ বাংলা ভাষার লেখক। দ্বিতীয় স্তরে, অর্থাৎ ১৯০০ থেকে তিনি আত্মজীবনী ও ইসলাম ধর্মবিষয়ক পুস্তিকাদি রচয়িতা। গাজী মিয়াঁর বস্তানী, এস্লামের জয়, বিবি খোদেজার বিবাহ ইত্যাদি ইসলামীবিষয়ক গ্রন্থ তিনি দ্বিতীয় স্তরে রচনা করেছিলেন। প্রথম স্তরে সংস্কৃতশব্দনির্ভর উচ্চাঙ্গের কবিত্বময় ও রসাশ্রিত ভাষা ব্যবহার করেছিলেন বলে এই স্তরে রচিত বিষাদ-সিন্ধু মুসলমানী বিষয় অবলম্বনে রচিত হলেও এতে সংস্কৃত শব্দ, অলঙ্কার চিত্র ও সঙ্গীতের অপূর্ব সমাবেশে ঘটেছে। কিন্তু দ্বিতীয় স্তরে সাহিত্যরস অপেক্ষা ধর্মীয় সংস্কৃতির দিকেই লেখকের মন ঝুঁকেছিল বলে ওই স্তরের লেখাগুলিতে আরবী-পারশী শব্দের প্রবেশ ঘটেছে।
গবেষক শ্রী সৌমিত্র শেখর গদ্যশিল্পী মীর মর্শারফ নামক এই গ্রন্থে মর্শারফ হোসেনের গদ্যরচনার শিল্পরীতি নিয়ে যে আলোচনা করেছেন তা প্রশংসনীয় সন্দেহ নেই। মর্শারফ হোসেনের রচনা বিষয়বস্তু অপেক্ষা ভাষাশিল্পের দিকে দিয়েই অধিকতর মূল্যবান। সৌমিত্র শেখর সেই ভাষাশিল্পের গঠন, বিন্যাস, শিল্পের উপাদান এবং সামগ্রিক আবেদন নিয়ে মৌলিক ও সূক্ষ্মদর্শী সমালোচনা করেছেন। অবশ্য সাধারণভাবে শিল্পরীতির মৌলিক লক্ষণগুলি আলোচনা করে প্রত্যেকটি গ্রন্থ ধরে আলোচনা করলে বোধহয় আলোচনার ক্ষেত্র পূর্ণতর হত।
ছয় অধ্যায়ে বিভক্ত এই গ্রন্থে’ মীর মর্শারফ হোসেনের জীবনকাহিনী ও মানসিকতা, উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত, বিশেষ করে বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে মূলবান বিশ্লেষণ, রচনাগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় এবং প্রত্যেকটি গদ্যরচনার শিল্পরীতি ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পরিশিষ্ট অংশটিও বহু তথ্যে সমৃদ্ধ।
মর্শারফ হোসেনের সংস্কৃত শব্দ-চিত্র-সঙ্গীত ও অলঙ্কারবহুল গদ্যভাষার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন পাওয়া যায় তাঁর দুটি উপন্যাস রত্নবতী ও বিষাদ-সিন্ধুতে। রত্নবতী সংস্কৃত শব্দের ভার, আড়ম্বর ও আড়ষ্টতায় কিছুটা ক্লিষ্ট ও শ্লথগতি। মর্শারফ হোসেনকে তাঁর এক শিক্ষক কাদম্বরী পড়তে দিয়েছিলেন। সেই কাদম্বরীর ভাষার বাগ্বিস্তার ও স্থিতিশীল গাম্ভীর্ষ যেন রতœবতীর ভাষার মধ্যেও লক্ষ্য করা যায়, যথা, ‘একদা প্রভাকর দৈনিক কার্য্য সমাধানান্তর লোহিতবসনাবৃত হইয়া পশ্চিমাঞ্চলে গমনোদ্যোগ করিতেছেন। এমন সময় রাজনন্দন ও মন্ত্রিতনয় অত্যুকৃষ্ট বেশভূয়ায় ভূষিত হইয়া প্রদোষকালে বিশুদ্ধ বায়ুসেবন করিতে বহির্গত হইলেন’ ক্রিয়াপদ ছাড়া এ বাক্যে সবই তৎসম শব্দ। বিষাদ-সিন্ধুতে সংস্কৃত শব্দের অপূর্ব চিত্র, ধ্বনি ও রস আছে, কিন্তু ভাষার মন্থরতা ও অড়ষ্টতা নেই। সেই ভাষার প্রবৃত্তির সংঘাত, দুর্দম আবেগের উত্তেজনা এবং দুর্জয় গতির বেগ রয়েছে। সৌমিত্র শেখর এই দুই উপন্যাসের শব্দপ্রয়োগ, অলঙ্কারব্যবহার এবং ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট নিয়ে বিশদ আলোচনা করে এসব একটি একটি করে দেখিয়েছেন।
লেখক মর্শারফ হোসেনের নাট্যভাষা নিয়েও পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করেছেন। ভাষা নিয়ে আলোচনা করার আগে বসন্তকুমারী নাটক ও জমীদার দর্পণের নাট্যরীতি নিয়ে আলোচনা করা দরকার। ১৮৭৩ খ্রীস্টাব্দে রচিত এই নাটক দুটিতে সংস্কৃত নাট্যরীতি অনুসরণ করে প্রস্তাবনা দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে। জমীদার দর্পণে আবার নাটকের শেষে সংস্কৃত নাটক অনুসরণে নটনটীর মুখে ভরতবাক্যের মতো একটি সহিতকামনামূলক সঙ্গীতের অবতারণা হয়েছে। ১৮৭৩ খ্রীস্টাব্দে কোনো হিন্দু নাট্যকার এ ধরনের সংস্কৃত নাট্যরীতি অনুসরণ করেননি। সৌমিত্র শেখর নাট্যভাষার কথা বাস্তবতা, শ্রেণী অনুযায়ী ভাষার বৈচিত্র্য এবং নাটকের ক্রিয়া ও বেগ সৃষ্টিতে এই ভাষার উপযোগিতা নিয়ে যথার্থ ব্যাখ্যা করেছেন। এর উপায় কি তৎকালীন বাস্তব সামাজিক প্রহসনের কথা, অমার্জিত ও অশ্লীল ভাষারূপের নিদর্শন।
মর্শারফ হোসেন আত্মজীবনীমূলক কয়েকটি গ্রন্থ লিখেছেন, যথা, উদাসীন পথিকের মনের কথা, আমার জীবনী, কুলসুম জীবনী ইত্যাদি। এই গ্রন্থগুলির মধ্যে ভারহীন, আড়ম্বরহীন স্বচ্ছন্দ গতিশীলতা ও অকপট আন্তরিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। উদাসীন পথিকের মনের কথার মধ্যে কুষ্টিয়ার নীলের হাঙ্গামার কাহিনী বিবৃত হয়েছে। উদাসীন পথিক হলেন স্বয়ং গ্রন্থকার। গ্রন্থের মুখবন্ধ থেকে লেখকের ভাষার প্রাঞ্জলতা ও স্বচ্ছন্দ চলমানতার নিদর্শন দেওয়া হচ্ছে, ‘মনের কথা অকপটে মুখে প্রকাশ করা বড়ই কঠিন। বিশেষ সংসারীর পক্ষে নানা বিঘ্ন, নানা ভয়, এমন কি জীবন সংশয়। সংসারে আমার স্থায়ী বসতি স্থান নাই। সহায় নাই, সম্পত্তি নাই, আত্মীয় নাই, স্বজন নাই, বুদ্ধি নাই। আপন বলিতে কেহই নাই। চক্ষু কাঁদে, না মন কাঁদে (যাহা চক্ষে দেখতে পাই) অনেকের জন্য কাঁদে।’
গবেষক সৌমিত্র শেখরের এই গবেষণা মীর মর্শারফ হোসেনের সাহিত্যের উপরে একটি তীক্ষè বিশ্লেষণমূলক সমালোচনারূপে সমাদৃত হবে এ-বিশ্বাস আমার রয়েছে।