56 verified Rokomari customers added this product in their favourite lists
"উপদেশের কবিতা" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ
‘বড়’রা উপদেশ দিতে পছন্দ করে। আর ছােটরা ঠিক ততটাই অপছন্দ করে উপদেশ শুনতে। কিন্তু বড়দের যে উপদেশ না-দিলে চলে না! বড় মানে য..
TK. 130TK. 98 You Save TK. 32 (25%)
In Stock (only 3 copies left)
* স্টক আউট হওয়ার আগেই অর্ডার করুন
Product Specification & Summary
"উপদেশের কবিতা" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ
‘বড়’রা উপদেশ দিতে পছন্দ করে। আর ছােটরা ঠিক ততটাই অপছন্দ করে উপদেশ শুনতে। কিন্তু বড়দের যে উপদেশ না-দিলে চলে না! বড় মানে যে মানুষ বয়সে বড়, অভিজ্ঞতায় বড়, চিন্তা-চেতনায় বড়, ভবিষ্যৎদর্শী হিশেবে বড়, ব্যক্তি ও সমাজের হিতকামী হিশেবে বড়। তাই বড়রা উপদেশ দিয়েই চলে। কারণ বড় যে, সে জানে, উপদেশ না-দিলে ছোটকে শুরু করতে হবে। সেই প্রথম থেকে, যেখান থেকে শুরু করেছিল তার অনেক আগের পূর্বপুরুষ। তাহলে ঠেকে ঠেকে শিখে বর্তমানের অবস্থানে আসতেই ছােট-র লেগে যাবে অনেক অনেক সময়। তাতে ব্যাহত হবে ব্যক্তির বিকাশ এবং সমাজের প্রগতি। কারণ বড়-র উপদেশের মধ্যে শুধু ব্যক্তির জ্ঞানপ্রকাশের ইচ্ছাই লুকিয়ে আছে তা তাে নয়। বরং তার নিজের অর্জিত এবং অধীত সমস্ত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতাও সে দিয়ে যেতে চায় তার উত্তরপুরুষকে, যাতে তার পথচলার গতি সুষম এবং সহজতর হয়। এটি মানুষের সহজাত অভিজ্ঞতা যদি না-ও হয়ে থাকে, তাহলেও বলা যায়, এই ‘দিয়ে যাওয়ার’ গুণটি অর্জনের মাধ্যমেই মানুষ অর্জন করেছে বিরূপ বিশ্বে নিজের প্রজাতির টিকে থাকার এবং অবিরাম বিকাশের জিয়নকাঠি। পৃথিবী থেকে অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আরও অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হবে। কারণ তারা নিজেদের অভিজ্ঞতার সারাৎসার দিয়ে যেতে পারেনি তাদের উত্তরপ্রজন্মকে। মানুষ যে টিকে আছে, এবং টিকে থাকবে, তার পেছনে বিশাল ভূমিকা রয়েছে এই উপদেশের।
কিন্তু ছােটরা যে উপদেশ নিতে চায় না! এই না-শুনতে চাওয়া-ও বােধহয় মানুষের সহজাত প্রবণতা। তাই তেতাে ওষুধ গেলানাের জন্য যেমন মিষ্টির প্রলেপ দেওয়া হয়, মানুষ তার উত্তরপ্রজন্মকে উপদেশ দিয়ে যাওয়ার জন্যও তেমনই খুঁজে বের করেছে অনেক অপ্রত্যক্ষ মাধ্যম এবং উপায়। তেমনই একটি মাধ্যম হচ্ছে পদ্য বা কবিতা। | আমরা আজকে যাকে উপদেশমূলক কবিতা হিশেবে অভিহিত করছি, তা রাতারাতি উদ্ভাবিত হয়নি। সাহিত্যের অন্য সব মাধ্যমের মতােই উপদেশমূলক কবিতাও আজকের চেহারায় আসার আগে অনেকগুলাে বিবর্তনের পর্যায় পার হয়েছে। উপদেশমূলক কবিতার আগে ছিল উপদেশমূলক প্রবাদ, বচন এবং লােকছড়া। আমাদের দেশে যেমন খনার বচন, ডাকের বচন, আঞ্চলিক প্রবাদ। আর ছিল ছােট ছােট উপদেশমূলক আখ্যান, যেগুলাে আধুনিক ছােটগল্পের সূচনারূপ। এই ধরনের আখ্যান প্রথম আমরা পাই জাতকের গল্প’-তে। বলা হয়ে থাকে, গৌতম বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের ধর্মীয় শিক্ষা এবং দুঃখ-মৃত্যু-জরা-পুনর্জন্ম থেকে নির্বাণলাভের উপায় সম্পর্কে উপদেশ দান করতেন এইসব ছােট ছােট আখ্যানের মাধ্যমে। তাঁর অনুসারীরা সেইসব উপদেশমূলক আখ্যানগুলােকে একত্রিত করে নাম দিয়েছেন জাতকের গল্প। এই পদ্ধতির কার্যকারিতা উপলব্ধি করতে পেরে অচিরেই হিন্দু ঋষিগণ তাদের ধর্মোপদেশ দান করা শুরু করলেন আখ্যানের মাধ্যমে। তাদের উপদেশগুলাে সংকলিত হয়েছে ‘হিতােপদেশ’ এবং ‘পঞ্চতন্ত্রে। এখন সারা পৃথিবীতে ব্যাপকভাবে প্রচারিত 'ঈশপের গল্প’ আসলে আমাদের উপমহাদেশের জাতকের গল্প’-এর মতােই লেখা ইউরােপীয় আখ্যান। তাদের সকলেরই উদ্দেশ্য এক। তারা আসলে উপদেশের বাহন।
বাংলাভাষায় আধুনিক উপদেশমূলক কবিতার জন্ম ইংরেজদের আগমনের আগে। বাংলাদেশ ও বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে যাকে মধ্যযুগ নামে অভিহিত করা হয়, সেই সময়েই ব্যক্তি, সমাজ ও গােষ্ঠীর মঙ্গলের উদ্দেশ্যে নীতিকবিতা ও উপদেশমূলক কবিতার জন্ম হয়। কোনাে একক ব্যক্তি বা কবি এই ধারার কবিতার জনক বলে চিহ্নিত নন। বরং মধ্যযুগে কবিদের একটি প্রধান প্রবণতাই ছিল নীতিকবিতা ও উপদেশমূলক কবিতার মাধ্যমে সমাজের সংস্কারসাধন। বাংলাভাষায় রচিত উপদেশের কবিতাগুলােকে মােটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ধরনের কবিতার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে নীতিপ্রচার এবং উপদেশদান। এই ধরনের কবিতা রচনার সময় কবির মনে প্রধানত কাজ করেছে সমাজের জন্য মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা। সৃষ্ট কবিতার কাব্যমূল্য বা শিল্পমূল্য নিয়ে কবি মাথা ঘামাতে নারাজ। শিল্পের বিচারে অকিঞ্চিৎকর হলেও তিনি এক্ষেত্রে তার উপদেশ প্রচারকেই প্রধান বলে মনে করেন। অর্থাৎ শিল্পের চাইতে সামাজিক প্রয়ােজনের কথাই তিনি বেশি ভাবেন। আরেকদিকে রয়েছে সত্যিকারের শিল্পসফল কবিতা। এই ধারার কবিতাগুলােতে প্রথমে রয়েছে কবিতা, তারপরে স্থান পেয়েছে উপদেশ। অর্থাৎ উপদেশের বাহন হলেও এই কবিতাগুলাে শিল্পবিচারে শেষ পর্যন্ত কবিতাই। এগুলাে পাঠ করে পাঠক প্রকৃত কাব্যের রসাস্বাদন করতে পারেন। তাই এখানে প্রাপ্ত উপদেশসমূহ পাঠকের বাড়তি লাভ।
এই বইটিতে যে কবিতাগুলাে নির্বাচন করা হয়েছে সেগুলাে অসাধারণ তাদের সুখপাঠ্যতার কারণে। সুখপাঠ্যতার কারণেই একবার পাঠ শেষ করার পরেও এই কবিতাগুলাে পাঠকের মনের মধ্যে গুঞ্জরিত হতে থাকবে। পাঠকের অবচেতন মন যেন তাকে বারবার পড়ে শােনাবে এইসব কবিতা। এই গ্রন্থের জন্য কবিতাকে নির্বাচন করা হয়েছে; কবিকে নয়। তাই দেখা যাবে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রজনীকান্ত সেন, কুসুমকুমারী দাশ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, জসীমউদ্দীন, ফররুখ আহমদের মতাে প্রকৃত ও প্রখ্যাত কবিদের পাশাপাশি অনেক কম পরিচিত ও তুলনামূলকভাবে অখ্যাত কবির কবিতা গ্রহণ করা হয়েছে। আবার এমন দুটি কবিতাও গ্রহণ করা হয়েছে, যাদের রচয়িতার নাম আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসবিদদের কাছেও অজানা। তবে ইতােমধ্যেই এই কবিতাগুলাে আমাদের সমাজের মানুষের কাছে চিরায়ত প্রবাদের রূপলাভ করেছে। এমনকি অনেক নিরক্ষর মানুষকেও এই কবিতাগুলাে উচ্চারণ করতে শােনা যায়। এই সর্বগ্রাসী নীতিহীনতার যুগে আমাদের নতুন প্রজন্মের কিশাের-তরুণদের কাছে এইসব উপদেশের কবিতা হতে পারে এক দীপান্বিত জীবনের আহ্বান।