17 verified Rokomari customers added this product in their favourite lists
সেরা লেখিকাদের সেরা গল্প
ভূমিকা
মেয়েরা সাধারণত বিশুদ্ধ শিল্পী হন না—এমন ধারণা আজও বদলাবার তেমন কোনও কারণ ঘটে নি। তাঁরা চিত্রকর হন না, ভাস্কর হন না, লেখক হন না।..
TK. 540TK. 395 You Save TK. 145 (27%)
In Stock (only 2 copies left)
* স্টক আউট হওয়ার আগেই অর্ডার করুন
Product Specification & Summary
সেরা লেখিকাদের সেরা গল্প
ভূমিকা
মেয়েরা সাধারণত বিশুদ্ধ শিল্পী হন না—এমন ধারণা আজও বদলাবার তেমন কোনও কারণ ঘটে নি। তাঁরা চিত্রকর হন না, ভাস্কর হন না, লেখক হন না। হন না মানে সাধারণত হন না। একজন মীরা মুখোপাধ্যায়, কি একজন মহাশ্বেতা দেবী পাওয়া পুরুষদের মধ্যেও দুষ্কর। একথা মেনেও বলতে পারি পুরুষশিল্পী ও নারীশিল্পীদের সংখ্যার একট, সাদামাটা তুলনা করলেও কথাটা স্পষ্টই প্রমাণ হয়ে যাবে। প্রমোদকলা এবং কারুকলাতেই মেয়েদের সিদ্ধি। সঙ্গীত, নৃত্য ইত্যাদি বিনোদনশিল্পে যথেষ্ট নারীশিল্পী পাওয়া যায়। এ ছাড়া আঁকলে তাঁরা আঁকেন আলপনা, গড়লে গড়েন পুতুল, লিখলে লেখেন—ছড়া, ডায়েরি, চিঠি। কেন ?
এ প্রশ্নের উত্তর সিমোন দ্য ব্যুভোয়ার দিয়েছেন। মেয়েদের দু'রকম প্রতিবন্ধক পেরোতে হয়। প্রথমত নারীপরিচয়ের হীনম্মন্যতা-সংকোচ-সংস্কারের প্রতিবন্ধক। দ্বিতীয়ত অনেক যুগের দৌড়ে স্বভাবতই এগিয়ে-থাকা পুরুষের সঙ্গে এক অসম প্রতিযোগিতার বাধা। প্রায় একশ বছরের লেখিকাদের গল্প সম্পাদনা করতে গিয়ে দেখছি বাঙালি নারীলেখকরা এই বাধা পেরিয়েছেন এক অতি সহজ উপায়ে। তাঁরা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথের 'দর্পহরণ' গল্পের নির্ঝর বা নির্ঝরের মতো করে। নির্ঝর তার লেখকম্মন্য স্বামীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জিতেছিল একটি ঘরোয়া বিষয়ে গল্প লিখে। আমাদের লেখিকারাও নিজেদের প্রতিবেশ, সামাজিক বাতাবরণ, সর্বোপরি নিজেদের দিবাস্বপ্ন দিয়ে লেখার জগৎ গড়ে নিয়েছেন। অভিজ্ঞতার বহির্বৃত্তের দিকে তেমন একটা তাকান নি। এটা ভালো কি মন্দ সে আলোচনা অর্থহীন। ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম নারী ঔপন্যাসিক জেন অস্টেনও তাঁর গ্রাম্য-মধ্যবিত্ত জমিমালিকদের আশা-আকাঙ্ক্ষা- কার্যকলাপের পরিবেশ থেকে বেরোন নি, তার জন্য কিন্তু প্রথম শ্রেণীর ঔপন্যাসিকের মর্যাদা তাঁর হাতছাড়া হয়নি। বিষয় ছাড়াও তাঁর হাতে ছিল প্রসাদগুণ, ক্ষুরধার বিশ্লেষণ, রসবোধ, সামগ্রিক নির্মাণের সুষমামণ্ডিত কারুতা।
‘সেরা লেখিকাদের সেরা গল্প' নাম দেওয়া হয়েছে বটে কিন্তু এই শীর্ষনাম এখানে কতটা সুপ্রযুক্ত সে বিষয়ে সংকলক ও সম্পাদক উভয়েরই যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। স্বর্ণকুমারী থেকে পূর্ণশশী—এঁদের লেখা এখন দুষ্প্রাপ্যর পর্যায়ে পড়ে। যথেষ্ট লেখা পাওয়া যাবে তবে তো নির্বাচনের প্রশ্ন! অন্যত্র এঁদের যেসব লেখা অদ্যাবধি প্রকাশিত হয়েছে তা ছাড়া অন্য লেখা মিলে যাওয়াটাই এখন সৌভাগ্যের বিষয়। তাদের স্থান দিতে পারলে আমরাই তৃপ্তি পাই, গৌরবান্বিত বোধ করি। অনেকের লেখা সময়াভাবে যোগাড় করা গেল না। মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, দীপালি দত্ত রায় এই কারণেই সংকলনভুক্ত হলেন না। তা সত্ত্বেও এ সংকলন মোটের ওপর প্রামাণ্য এবং প্রতিনিধিমূলক এমন দাবি করাই যায়।
অনেকে মনে করেন, নারী-লেখকদের আলাদা করে বিচার করা ঠিক নয়। ইতিহাসের পরামর্শ অন্যরকম। ইতিহাস মানে তো শুধু সাহিত্যের ইতিহাস নয়, সমাজেরও ইতিহাস, সভ্যতা ও সংস্কৃতিরও ইতিহাস। সমাজের অন্দরমহল এবং অন্তরমহলের ঘনিষ্ঠ খবরাখবর
মেয়েদের ঝুলিতে যতটা ধরা থাকে, ততটা আর কোথাও থাকে না। বিশেষত এই দ্বিতীয় ইতিহাসের প্রয়োজনকে স্বীকার করেই এই সংকলন। এবং গল্প বাছার সময়ে যা সবচেয়ে বেশি বিবেচিত হয়েছে তা হল বিবর্তমান নারীমানস, তার মনোযোগবিন্দুর প্রতিসরণ।
এই সংকলনে মাত্র তিনটি গল্প আছে যেগুলি মেয়েদের সম্পর্কে নয়। শৈলবালা ঘোষজায়ার ‘লাফো’, সুভদ্রা ঊর্মিলা মজুমদারের ‘বি-পজিটিভ' এবং গৌরী ধর্মপালের ‘ভুবনডাঙার জাত খেলুড়ে'।
‘লাফো’তে খুন জখম প্রতিহিংসা স্বেচ্ছানির্বাসন সেই সঙ্গে গভীর সৌহার্দ্যের এক মিলমিশ দেখতে পাওয়া যায়। ‘লাফো’ মগ অর্থাৎ রেঙ্গুনের বর্মী কাঠের কারখানা মালিকের চরিত্র উপস্থিত করেই শৈলবালা আমাদের চমকে দিয়েছেন। তবে আপাতদৃষ্টিতে যতটা জটিল প্লট মনে হচ্ছে, গল্পের বিন্যাসে তেমন প্রত্যাশাপূরণ হয় নি। সবটাই স্মৃতিচারণের আকারে উপস্থাপিত হয়েছে, আখ্যানের আকারে পরিবেশিত হয়েছে।
‘বি-পজিটিভ’-এ সুভদ্রা ঊর্মিলা একটি আত্মকেন্দ্রিক পুরুষচরিত্র নিয়ে লিখেছেন আত্মকেন্দ্রিক এবং স্বার্থপর। সারাজীবন সূর্য নামে এই পুরুষটি ঘনিষ্ঠজনদের দাবিয়ে, নিজের অধিকার মর্যাদা এবং সুখসুবিধা আদায় করে নিয়েছে। কখনোই এর ব্যত্যয় হয় নি। জীবনে প্রথম এই নিয়ম ভঙ্গ হল ছেলের বেলায়। দুর্ঘটনায় মৃতপ্রায় ছেলেকে রক্ত দেবার জন্যে সূর্য যখন নার্সিং হোমে ছুটে এল, রক্তের গ্রুপ বি-পজিটিভ। এই প্রথম কি সূর্যের মধ্যে পজিটিভ প্রতিক্রিয়া দেখা গেল, যা তার মনুষ্যত্বের পরিচায়ক ?
তৃতীয় গল্পটি সম্পূর্ণই ভিন্ন জাতের। ছোটদের জন্য লেখা বলে মনে হয়। কিন্তু অস্কার ওয়াইল্ডের ‘সেলফিশ জায়ান্ট' কিম্বা হানস ক্রিশ্চান অ্যান্ডারসেনের 'দি এম্পারার্স ক্লোদস’ যেমন ছোটদের গল্প না হয়েও ছোটদের মন দোলায়, ভোলায়, কাঁদায়, হাসায়—এ-ও তেমনি, তবে এ গল্প কাঁদায়ও না, হাসায়ও না, স্বপ্ন দেখায়। 'ভুবনডাঙার জাত খেলুড়ে' রূপক গল্প । এই গল্পের পুতুল গড়া বুড়ো বোধহয় আদিশিল্পীর শাপভ্রষ্ট মর্ত্যরূপ। ফরমাশী পুতুল সে তো গড়েই, গড়ে আপন খেয়ালের পুতুলও। তা ছাড়াও গড়ে মায়াপুতুল আর ছায়াপুতুল । তবু তার মন খুঁতখুঁত করে, কেননা তার বাবা তার কানে মন্ত্র দিয়ে গেছেন ভুবনডাঙার পাবন মাটি না হলে সেই আসল পুতুলটি তার গড়া হবে না। ছোট্ট মেয়ের আবদার পূরণ করতে গিয়ে কেমন করে সে অতি সামান্য উপকরণ দিয়ে তার সেই প্রাণের পুতুলটি গড়ল, তাই নিয়েই এই গল্প বা কবিতা। শিল্পী যখন ফরমাশে নয়, খেয়ালে নয়, প্রাণের টানে শিল্প সৃষ্টি করেন তখন তাতে সৃষ্টিকর্তার হাতের ম্যাজিক এসে যুক্ত হয়। কবিতার মতো গদ্যে, গ্রাম্য কথ্যভাষার সহজ মিষ্টি দেশজ তদ্ভব টানে এ গল্প লেখা।
আরও তিনটি ব্যতিক্রমী বিষয়ের গল্প আছে সংকলনে— রাধারাণী দেবীর ‘মূক সাথী’ পশুপ্রেমের গল্প। নবনীতা দেবসেনের 'আবার এসেছে আষাঢ়' রসরচনা। এ গল্প একটি নির্মল হাসির ফোয়ারা যাতে বিদ্রূপ, বিরক্তি, কান্নাকে হাসির ছদ্মবেশ পরানো—এসব কিছুই নেই, আছে শুধুই দুর্যোগের দুর্ভোগকে হাসির মধ্য দিয়ে পার হয়ে যাওয়া। মীরা বা সুব্রামনিয়ন লিখেছেন একটি গোয়েন্দা গল্প ।
এগুলি বাদে আর সব গল্পই সামাজিক সমস্যাবিষয়ক বা মনস্তাত্ত্বিক। এ গল্পগুলিতে প্রধান চরিত্র নারী। প্রধান বিষয় প্রেম। প্রায়শই ব্যর্থ। স্বর্ণকুমারী থেকে সীতা দেবী এই সুদীর্ঘ সময়যাত্রায় দেখি মর্ষকামী আবেগের চোরাগলি থেকে লেখিকামানস কিছুতেই বার হতে পারছে না। পুরুষনির্ভর সুখ, পুরুষকেন্দ্রিক জীবন ও পারিবারিক অবহেলার এক শোচনীয় চিত্র ফুটে উঠেছে এঁদের গল্পে।