User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
তসলিমা নাসরিনের শ্রেষ্ঠ কবিতার বইয়ের ব্যাপারে তিনি কবিতার কথা বলেন, ‘কবিতা দিয়ে আমার সাহিত্য-জীবনের শুরু। দুঃখে-সুখে, আনন্দ-বিষাদে কবিতার কাছে এখনো নিজেকে আমি সমর্পণ করি। গদ্যে আমি ঝলসে উঠি হয়তো, পদ্য তার শান্ত স্নিগ্ধ জলে আমাকে স্নান করিয়ে নেয়। গদ্য-পদ্য দুটোই আমার জীবনের জন্য জরুরি। শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলনের ব্যাপারে তাঁর ভাষ্য, ‘কোনো কবির শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলন তখনই বের হওয়া উচিত, যখন সে আর বেঁচে নেই, অথবা বেঁচে থাকলেও কবিতা সে আর লেখে না। আমার ক্ষেত্রে এ দুটোর কোনো ঘটনাই এখন অবধি ঘটেনি। আমি প্রচণ্ডভাবে বেঁচে আছি এবং প্রচুর কবিতাও লিখে যাচ্ছি।’
Was this review helpful to you?
or
তসলিমা নাসরিন নামটি উচ্চারিত হলে তাঁর সম্পর্কে যতখানি বলা হতে দেখি তার বোধকরি এক শতাংশ তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলতে দেখি না। অথচ তসলিমা নাসরিন মূলত কবি হতেই চেয়েছিলেন। তিনি কবিতার আরাধনা করেছিলেন, কবিতা তাঁর কাছে ধরাও দিয়েছিলো। তসলিমা অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। আরো অনেকের মতো পদ্য নয়। তসলিমার সাহিত্য জীবন শুরু হয়েছিলো কবিতা দিয়েই। তারপর তাঁর লেখালেখি সাহিত্যজগতকে মায় আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে নানাভাবে ধাক্কা দিয়েছে, ঋদ্ধ করেছে। এরপর তসলিমা ক্রমে কলাম লেখক, গদ্যকার হয়েছেন। তিনি গল্প-উপন্যাস লিখেছিলেন। পরে, নানা ঘটনার পরম্পরায় তিনি পুরো বিপ্লবীই হয়ে গেলেন। দেশ থেকে একপ্রকার বিতাড়িত এই আলোচিত লেখকের ইদানীং এর লেখালেখি বলতে আত্মজীবনী গোছের কিছু রচনাই কিছুদিন পরপর হাতে পাচ্ছি। কবিতা কিংবা গল্প তিনি আর লিখছেন না। কেনো তিনি গল্প কবিতা আর লেখেন না? অনেকগুলো কারণ এর পেছনে থাকতে পারে। আসুন আমরা কয়েকটি সম্ভবনার উৎস সন্ধান করি। এক, তিনি কবিতা কিংবা গল্প লেখায় আগ্রহ পাচ্ছেন না, দুই. গল্প-কবিতা তাঁর কলমে ধরা দিচ্ছে না। তিন. দুটোই একসাথে ঘটেছে, অর্থাৎ, তিনি লিখতে পারছেন না। তাঁর রাইটার্স ব্লক গোছের কিছু একটা হয়েছে। চার. কোনো প্রকাশক তাঁকে গল্প উপন্যাস কিংবা কবিতার পান্ডুলিপি তৈরি করতে তাগিদ দিচ্ছেন না। তাঁকে দিয়ে তাঁরা শুধু আত্মজীবনী গোছের রচনা লেখাতে চান এবং তসলিমা যেহেতু দেশ থেকে নির্বাসিত, পাঠকের সাথে তাঁর সরাসরি কোনো যোগাযোগ নেই, তাই পাঠক চাহিদার বিষয়টি হয়তো তিনি সেভাবে ধরতে পারছেন না। এই সম্ভাবনাটিকে আমার সবচেয়ে জোরালো মনে হচ্ছে। এই বইমেলায় বেরুনো তসলিমার লেখা এবং আমাকে হতাশ করা আত্মজীবনী ‘নির্বাসন’- যেটি আত্মজীবনী সিরিজের সপ্তম আয়োজন; পড়ে মনে হলো- তসলিমার সকল প্রতিভা নির্বাসনেই গেছে। পাঠক হিসেবে আমি কবি তসলিমা, কলাম লেখক তসলিমার ভক্ত ছিলাম। বিদ্রোহী তসলিমার ভক্ত হবার গল্প এ-লেখার জন্য প্রাসঙ্গিক না কিন্তু এটুকু বলার লোভ ছাড়তে পারছিনা- আমি তসলিমাকে প্রণাম করি তাঁর দ্রোহের আর বিদ্রোহের জন্য। শুরুতে যা বলছিলাম-তসলিমার কবিতার কথা। তিনি যেহেতু আর সাহিত্য সৃষ্টির কাজে নেই, মোটামুটি ছিটকে পড়া তারার মতো হয়ে গেছেন, তাই তাঁর প্রথম কবিতার বইর নামের মতো, ‘শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা’ নিয়ে তাঁর লেখা পুরনো কবিতা পড়ে ইদানীং আনন্দের জাবর কাটি । যুগে যুগে পুরুষরা কবিতায় তথা সাহিত্যে নারীর প্রতি প্রবল আকর্ষণ বোধ করা নিয়ে কিংবা কামজ অনুভূতি নিয়ে বহু কবিতা রচনা করেছেন। গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। নারীদের মধ্যে, বিশেষত বাংলাদেশের নারী লেখক-কবিদের কবিতায় গদ্যে এসব নিয়ে প্রচন্ড আড়ষ্টতা দেখি। প্রেম-কাম যেন একতরফা পুরুষেরই ব্যাপার। নারীর যেন কোনো অনুভূতি নেই। তসলিমাই প্রথম সেই দেয়াল ভেঙেছেন। তিনি পুরুষের প্রতি প্রেম-কামজ অনুভূতি প্রকাশে, পুরুষের পৌরুষের প্রতি কামনার্ত হয়ে প্রচুর গদ্য, কবিতা লিখেছেন। তসলিমা যেভাবে তাঁর কবিতায় প্রেম নিয়ে আসেন সেরকমভাবে আর কেউ পারে না। প্রেম যেন তসলিমার দাসানুদাস। তাঁর অনুভূতি এত প্রগাঢ় যা পড়তে ভাল লাগে। তসলিমা কবিতায় সত্যভাষী। তিনি কিছুই লুকোন না। কবিতায় তিনি ধর্মকে তুলোধুনো করেন, তিনি তথাকথিত পুরুষদের তুলোধুনো করেন। তিনি একজন গভীর শিল্পী। তসলিমার কবিতার বই বেরিয়েছে মোট তেরটি। প্রথমটি ‘শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা’ বেরিয়েছিলো ১৯৮৬ সালে যখন তসলিমার বয়স মাত্র চব্বিশ বছর। মাত্র সাতটি কবিতা নিয়ে বেরুনো সেই কবিতার বইটি চলেনি, পাঠক নেয় নি এবং বিক্রি-বাট্টা ভাল হয়নি। এটি নিয়ে তসলিমার নিজের অনেক ক্ষোভ আর দুঃখ ছিলো। তিনি সম্পর্কিত হয়েছিলেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সাথে। তসলিমা ময়মনসিংহ মেডিক্যালে পড়েন, রুদ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। রুদ্র সম্ভবনাময় তরুণ কবি। সত্তর এর দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের একজন। সেসময় কবিতা লিখতে রুদ্র তসলিমাকে উৎসাহ জোগাতেন। প্রেমিকা তসলিমা মফস্বল শহরে বসে ঢাকার কবিদের কবিতা পড়ে মন খারাপ করতেন, তার নিজের কবিতা লিখতে ইচ্ছে করতো, কবিতাগুলো বড় পত্রিকায় ছাপাতে ইচ্ছে করতো। উনিশশো ছিয়াশিতে সাতটি কবিতা নিয়ে তসলিমার যে কবিতার বইটি বেরুলো তার সব কটিকে ‘অ্যাভারেজ’ কবিতা বলেই আখ্যায়িত করা যায়। এই কবিতাগুলো পড়লে কোনোভাবেই মনে হবে না- পরে এই কবির কলম দিয়ে অসাধারণ সব কবিতার জন্ম হবে। সেটি ঘটেছিলো মাত্র তিন বছর পর, যখন তসলিমা সাতাশ-এ পা দিয়েছেন, লিখেছেন দ্বিতীয় কবিতার বই- ‘নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে’। আমরা যে যুগপৎ, প্রেমময় আর দ্রোহী তসলিমাকে চিনি, সাতাশ বছর বয়সে সেই তসলিমা বিকশিত হয়েছেন। নির্বাসিত বাহিরে অন্তরের প্রথম কবিতার নাম ‘পরিচয়’। পরিচয় এর প্রথম চারটি লাইন এমন-‘তাকে আমি যতটুকু ভেবেছি পুরুষ/ততটুকু নয়,/অর্ধেক ক্লীব সে/অর্ধেক পুরুষ’। কবিতাটির শেষ চারটি লাইন‘ যতটুকু তাকে আমি ভেবেছি মানুষ/ততটুকু নয়,/অর্ধেক পশু সে/অর্ধেক মানুষ’। পুরুষকে (নষ্ট পুরুষকে) ব্যবচ্ছেদ করার এমন চমৎকার উদাহরণ যে কাউকে চমকে দেবে। নির্বাসিত বাহিরে অন্তরের কবিতা সংখ্যা চৌত্রিশ। কবিতাগুলো প্রেমের-বিচ্ছেদের-ক্ষোভের। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সঙ্গে তখন তাঁর সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। ভাব হয় আবার ভাব ভেঙে যায়। সম্পর্কের নানান ডাইমেনসন পরপর আসছে তখন। তসলিমা কবিতায় আহবানের সুরে লেখেন ‘ডাক দিয়ো’। তারপর আবার তসলিমাই লেখেন ‘গোল্লাছুট’। ‘ডাক দিয়ো’তে বলেন ‘মনে মনে তোমার পুরু ঠোঁটে এলোমেলো চুমু খেতে খেতে সাহসে কেঁপে উঠে অহল্যা-শরীর’। পরের কবিতা গোল্লাছুটে বলেন, ‘চোখের দিকে তাকিয়েও কি বোঝো না আমি চলে যাচ্ছি’? তবে নির্বাসিত বাহিরে অন্তরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবিতা ‘দুধরাজ কবি’। এই কবিতা প্রসঙ্গে তসলিমা তাঁর আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন, রুদ্রের সাথে তখন সম্পর্ক প্রায় ভেঙে গেছে। তসলিমার মন রুদ্রের প্রতি খুবই ক্ষুব্ধ। রুদ্র সিফিলিস বাঁধিয়েছিলেন, বারবার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছিলেন। দুধরাজ কবিতাটি লেখা হয়েছে সেই ক্ষোভের মন নিয়ে, রুদ্রকে নিয়ে। এই কবিতা লেখার পর রুদ্রও একটা পাল্টা কবিতা লিখলেন। কবিতার নাম‘সামঞ্জস্য’। দুটো কবিতা পুরো তুলে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। প্রেমিক-প্রেমিকার (স্বামী-স্ত্রীর) এমন পাল্টাপাল্টি কবিতা লেখার দ্বৈরথটি না লিখলে আমার এ-লেখাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। প্রথমে দিলাম তসলিমার লেখা ‘দুধরাজ’ কবিতাটি- কেউ শখ করে পাখি পোষে/ কেউ-বা কুকুর/ আর আমি এক-পা এগিয়ে গিয়ে/একজন কবিকে স্বগৃহে শখ করে পালন করেছি/ পাখা নেই, তবু সে উড়াল দেবে/কেশরের কিচ্ছু নেই/তবু সে ঘাড়ের রোঁয়া ফুলিয়ে দাঁড়াবে/খেতে দিই/বুকের বল্কলে ঢেকে বলি/ঘুম যাও/কবি কি ঘুমায়?/ বিড়াল-নরম হাত থেকে বের হয় তার ধারালো নখর/আঁচড়ে কামড়ে আমাকেই আহত করে/বাদুড়ের মতো ঝুলে থাকে আমারই পাঁজরায়/কবি কি ঘুমায়?/ তারচে’ কুকুর পোষা ভাল/ধূর্ত যে শেয়াল, সে-ও পোষ মানে/দুধকলা দিয়ে আদরে-আহ্লাদে এক কবিকে পুষেছি এতকাল/আমাকে ছোবল মেরে দ্যাখো সেই কবি আজ কীভাবে পালায়। এবার রুদ্রের লেখা পাল্টা কবিতা- ‘সামঞ্জস্য’। তুমি বরং কুকুর পোষো/প্রভুভক্ত খুনশুটিতে কাটবে তোমার নিবিড় সময়/ তোমার জন্য বিড়ালই ঠিক/বরং তুমি বিড়াল পোষো/ খাঁটি জিনিশ চিনতে তোমার ভুল হয়ে যায়/ খুঁজে এবার পেয়েছো ঠিক দিক ঠিকানা/ লক্ষী সোনা, এবার তুমি বিড়াল এবং কুকুর পোষো/ শুকোরগুলো তোমার সাথে খাপ খেয়ে যায়/কাদা ঘাটায় দক্ষতা বেশ সমান সমান/ঘাটাঘাটির ঘটঘটায় তোমাকে খুব তৃপ্ত দেখি/তুমি বরং ওই পুকুরেই নাইতে নামো/পংক পাবে, জলও পাবে/চুল ভেজারও তেমন কোনো আশংকা নেই/ইচ্ছে মতো যেমন খুশি নাইতে পারো/ঘোলা পানির আড়াল পেলে/কে আর পাবে তোমার দ্যাখা!/ মাছ শিকারেও নামতে পারো/তুমি বরং ঘোলা পানির মাছ শিকাওে দ্যাখাও তোমার গভীর মেধা/ তুমি তোমার স্বভাব গাছে দাঁড়িয়ে পড়ো/নিলিঝিলির স্বপ্ন নিয়ে আর কতো কাল?/শুধু শুধুই মগজে এক মোহন ব্যাধি/তুমি বরং কুকুর পোষো, বিড়াল পোষো/ কুকুর খুবই প্রভুভক্ত এবং বিড়াল আদর প্রিয়/ তোমার জন্য এমন সামঞ্জস্য তুমি কোথায় পাবে?? ১৯৯০’তে বের হয় তসলিমার লেখা তৃতীয় কবিতার বই- ‘আমার কিছু যায় আসে না’। যে তসলিমা সমাজ বদলের ডাক দিয়েছিলেন, নারীকে সত্যিকারের মানুষ হবার কথা বলেছিলেন সেই তসলিমাকে আমরা- ‘আমার কিছু যায় আসে না’-তে আবিস্কার করি পুরোপুরিভাবে। চরিত্র-দৌড় দৌড়, খেলা, দ্বিখন্ডিত, বসবাস, যার যা খুশি, সীমানা, শাসন, শিকড় নামের কবিতাগুলোর বক্তব্য পরিস্কার আর শক্তিশালী। দৌড়, দৌড়-এ তিনি বলেন-‘তোমার পেছনে একপাল কুকুর লেগেছে/জেনে রেখো, কুকুরের শরীরে র্যা বিস/তোমার পেছনে একপাল পুরুষ লেগেছে/জেনে রোখো, সিফিলিস’। তাঁর প্রেমের কবিতা অনবদ্য। ‘বিনিময়ে’ তিনি বলেন,‘তুমি আমাকে বিষ দিয়েছ/আমি তোমাকে কী?/ভালবাসার হাঁড়ি কলস/উপুড় করেছি’। ‘জগতের আনন্দযজ্ঞে’ কবিতায় তিনি লিখেন, ‘তুমি তো হে বেশ আছ/জাহাজ ভিড়ছে/বন্দরে নিয়ত কোলাহল, ভীড়।/ কে যে একলা কোথায় কাঁদে/স্মৃতির সুতোয় কে যে সমস্ত বিকেল গেঁথে রাখে কষ্টের বকুল/তুমি তার কিছুই জানো না। তসলিমার কবিতার বইগুলো এরপর মোটামুটি বছর বছর এসেছে। কবিতার ফ্রেম বদলেছে, তাঁর মনোজগতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। তিনি পরিণত হয়েছেন। কবিতাগুলো সুস্পষ্ট বক্তব্য বয়ে এনেছে। বই-এর নামগুলো দেখলে বোঝা যাবে তাঁর কবি মনের আর কবিতার বিবর্তন কীভাবে ঘটেছে। ১৯৯১-এ অতলে অন্তরীণ, ৯২-এ বালিকার গোল্লাছুট, ৯৩-এ বেহুলা একা ভাসিয়েছিল ভেলা, ৯৫-এ আয় কষ্ট ঝেঁপে জীবন দেব মেপে, ৯৬-এ নির্বাসিত নারীর কবিতা, ২০০০-এ জলপদ্য, ২০০২-এ খালি খালি লাগে, ২০০৪-এ কিছুক্ষণ থাকো, ২০০৭-এ ভালোবাসো? ছাই বাসো, এবং ২০০৯-এ বন্দিনী। ‘অতলে অন্তরীণ’- ‘মাঝরাতের আলো’ কবিতার ক’টি লাইন, 'সামনে পেতে পারি/সামনে যদি কিছু থাকে/সামনে সামান্য/সামনে দু’একটি পাথর যদি মেলে/পাথরে পাথরেই আগুন জ্বেলে দেব/আগুন অন্তত তাড়াবে সাপখোপ/বৃক্ষ চিনে নেব চিনব তরুলতা/সবচে ভাল হয় মানুষ যদি চিনি'। ‘বালিকার গোল্লাছুট’-‘বার্ধক্য’র ক’টি লাইন, 'টানটান ত্বকে ভাঁজ পড়ে গেছে/রজঃযন্ত্রণা নেই/বারবার বলা এক গল্পের/হারিয়ে গিয়েছে খেই’। সমাবর্তন’ কবিতায় আছে ‘ঘুরে ঘুরে ওই এক বিন্দুতে ফেরা/খামোকাই এত দুর্বহ লুকোছাপা!/ফিরে তো দেখেই হৃদয়ের তার ছেঁড়া/বৃত্তের মাপে জীবনের পথ মাপা’। ‘বেহুলা একা ভাসিয়েছিল ভেলা’র, কবিতা-'বেহুলার ভেলা’, তিনি লিখেন, ‘বেহুলা একা ভাসিয়ে দেবে ভেলা/ উতল যমুনায়/খোলনলচে উলটে ফেলে সনাতনের খেলা/লখিন্দর লোহার ঘরে স্বপ্নহীনতায়’। ‘আয় কষ্ট ঝেঁপে জীবন দেব মেপে’- ‘যাত্রা’ কবিতাটি বড়ই মনোরম। তিনি লেখেন, ‘আমি তাকে লঙ্ঘন করেছি অবলীলায়, ঘৃণায়/ ছুঁড়েছি হৃদয় থেকে দূরে/ ঝোপঝাড়ে/ পেছনে সে কাঁদে নাকি কামড়ায় নিজের আঙুল/ ছেঁড়ে চুল/ ঠেকে না কি মাথা অনড় দেওয়ালে?/সে কোনও বিষয় নয় ফিরে তাকাবার/ লঙ্ঘন করেছি তাকে যদি, যদি তার মুছেই ফেলেছি নাম/ তবে কেন স্মৃতির শরীরে হাত রেখে কোমল ঝাঁকুনি দিয়ে কাঁধে ফোঁটা ফোঁটা কষ্টের বকুল ঝরাব আবার/অবেলায়?/ একবার ধূলো ঝেড়ে ধূলোতে আবার কেউ গড়াগড়ি যায়? ‘নির্বাসিত নারীর কবিতা’ ‘না জানুক’ পড়ি আমরা, 'সে কি জানে তাকে আমি আজও মনে রাখি, চাই!/আজও তার স্মৃতির আগুন জ্বেলে/মাঝরাতে শরীর তাপাই!/ সে যদি না জানে, তাতে কার কী!/ আমার এ-ই সুখ/আমি ভালবাসি/ সে আমাকে বাসুক বা না বাসুক'! ‘জলপদ্য’ এর ডাঙা কবিতায় দেখি, ‘যাবে কতদূর, কতদূর আর যেতে পারো একা/ভেড়াতেই হবে নাও খানা কোনও এক তীরে/জলে জন্ম মানুষের নয়/দলছুট মানুষও একলা নির্জনে গহন রাতের কোলে ক্লান্ত মাথা রেখে প্রাণপন চায় আবার মানুষ'। ‘খালি খালি লাগে’, মানুষের জাত কবিতায় দেখি, 'ঈশ্বর-পুজোয় আজ উন্মাদ মানুষ/ মন্দির মসজিদ গির্জায় ঢাকা পড়ছে মানুষের মুখ/ অন্ধ হচ্ছে চোখ, মস্তিষ্কে ঢুকে যাচ্ছে বিষাক্ত পোকা'। ‘কিছুক্ষণ থাকো’ বই-এর ধর্মনিরেপক্ষতায় আছে, ‘সব ধর্মের গোড়াতেই সমান জল ঢেলে, বিষবৃক্ষ পুষ্ট রাখি ধর্মখেলা খেলে/ধার্মিকের জয়জয়কার/নাস্তিকের হার/এমন ধর্ম-দেশ আপনি কোথায় পাবেন আর’! ‘ভালোবাসো? ছাই বাসো’- এর অরণ্য, তুমি কবিতার লাইন, ‘যখন সুখ দিচ্ছেন আমাকে, অসুখ দিচ্ছেন বুঝিনি/চুম্বনের জন্য বিযুক্ত করেছি ঠোঁট/গোপনে বিষ দিয়েছেন মুখে, বুঝি নি। ‘বন্দিনী’ এর পরাধীনতা কবিতাটি এমন, ‘ধর্মতন্ত্র আমাকে ফাঁসিয়ে মিথ্যেকে দিল জয়/লক্ষ নারীকে পুরুষতন্ত্র বন্দি করেছে ঘরে/বিক্রি হচ্ছে শত শত লোক ধনতন্ত্রের কাছে/স্বাধীনতা আজ দুর্লভ খুব দুর্ভাগাদের দেশে’। তসলিমার ভেতরে অনেক কবিতা জমে ছিল। তিনি সত্যিকারের কবিতার দেখা পেয়েছিলেন। দিয়েছেনও প্রচুর। কিন্তু এই মেধাবীর কলম অনেকদিন কথা বলে না। আমরা যারা তাঁর কবিতা ভালবাসি, চাই তিনি লিখুন। আবার তাঁর কলম থেকে অশ্রুর মতো, ঝর্ণার মতো, রক্তের মতো অবারিত কবিতা বের হোক। শুভকামনা তসলিমা নাসরিন!