User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
আবদুল মান্নান সৈয়দ এর মৃত্যুর পর তাঁর অপ্রকাশিত লেখা নিয়ে ‘মিটিল না সাধ ভালোবাসিয়া তোমায়’ নামের একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এতে তাঁর লেখা চিঠি, রোজনামচা, কবিতা, সাহিত্য-ভাবনা, সাহিত্যের ভুবনের মানুষদের নিয়ে নানা কথা সহ অসংখ্য বিক্ষিপ্ত ভাবনা উঠে এসেছে। কবিকন্যা জিনান সৈয়দ এবং তরুণ কবি পিয়াস মজিদ-এর সম্পাদনায় গ্রন্থিত এই বইটিকে বেশ ব্যতিক্রমী একটি প্রকাশনা বলে মনে হয়েছে আমার। লেখকদের মৃত্যুর পর তাঁদের অপ্রকাশিত/অগ্রন্থিত লেখা প্রকাশ হবার রীতি অবশ্য খুব অপ্রচলিত নয়। কিন্তু সেই গ্রন্থগুলোতে কাঁচি চালানোর এবং স্পর্শকাতর বিষয়গুলোকে প্রাদপ্রদীপের আলোয় না আনার একটা প্রচেষ্টা লক্ষ্য করেছি। ব্যতিক্রম হিসেবে উদাহরণ দিতে হলে এই গ্রন্থটিকে বিবেচনা করা যায়। সম্পাদনা প্যানেলে কবিকন্যার উপস্থিতি থাকবার পরও এই বই-এ কবির শেষ জীবনের গভীর প্রণয়ের বিশদ বয়ান আর বিভিন্ন চিন্তার কাব্যিক উপস্থাপনা যেভাবে এসেছে তা পড়ে বিস্ময়বোধ জেগেছে। আবদুল মান্নান সৈয়দ যেভাবে তাঁর মনের গহন সাম্রাজ্যটিকে খাতার পাতায় মেলে ধরেছেন, গ্রন্থটিও সেভাবেই তার প্রতিনিধিত্ব করছে। ‘‘আমার জীবন কথা লিখো তুমি। তোমার কাছে আমি খানিকটা উন্মোচিত। খানিকটা আমার সাইক্রিয়াট্রিস্টের কাছে”- যখন চিঠিতে কথাগুলো লেখা হয়, তখন পাঠকের কি বুঝতে বাকি থাকে - কবি কতোটা ভালোবাসা নিয়ে বান্ধবীকে চিঠি লিখেছিলেন? এমন চিঠি বইতে কয়েকটি রয়েছে। প্রতিটি চিঠিতে রহস্যের পর্দা ভেদ করে উড়ে আসা পায়রার মতো খুব নরোম কিছুর দেখা মেলে। পেলব এর ভাষা। কবি-হৃদয়ের আকুতি, তাঁর প্রণয়াসিক্ত মন হাহাকারের মতো বেজে উঠেছে কোথাও কোথাও। বইতে কয়েকটি চিঠি হুবহু তুলে দেয়া হয়েছে। ধারণা করি, এ-চিঠিগুলো প্রাপকের কাছে পৌঁছোয়নি; হয়তো লিখে রেখে দিয়েছিলেন, পোস্ট করা হয়নি। পত্রপ্রাপকের কাছে নিজেকে তিনি অসামাজিক মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। সঙ্গে রয়েছে নিজের সম্পর্কে এবং ধন-মান নিয়ে নির্লিপ্ত মূল্যায়ণ - ‘পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের মধ্যে আমি কে? আমি তো বুদবুদ্ মাত্র- ধনগর্বে যশোগর্বে মাত্রাহীন মানুষের আস্পর্ধা দেখে হাসি পায় (পৃ:৩১)।’ এই চিঠিটির ইতিতে ‘তোমার দস্তয়েভস্কি’ লেখা রয়েছে। বোঝা যায় যে, পত্রপ্রাপক ভালোবেসে কবিকে 'দস্তয়েভস্কি' বলে ডাকতেন। আরেক জায়গায় তিনি আদরণীয় ছিলেন 'কোলরিজ’ বলে কিংবা 'তোমার চিরজনমের লক্ষীসোনা', ‘তোমার শিল্পী’ বলে। স্বাভাবিক মৃত্যুচিন্তার পাশাপাশি আত্মহনন-ভাবনার নীল আগুন কবির মনের ভেতর সতত জেগে ছিল। একইসঙ্গে সৃষ্টিশীলতার সুখ এবং দহন যেন পুড়িয়েছে তাঁকে। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো অদ্ভুত সব ভাবনার মাধ্যমে। যেমন, একজায়গায় লেখা হয়েছে - ‘আত্মহত্যার পরিকল্পনা ছিল আমার, এখনো আছে। কিন্তু এখন দু-একটা খুন-খারাবি না-করে আত্মহত্যা করব না। আমার মুশকিল-আমার প্ল্যান সবসময় একটু পালটে পালটে যায়। এখন আত্মহত্যার চেয়ে অন্যকে হত্যার প্রবণতা বেশি আমার। খুন নিয়েও ভেবেছি। প্রকৃত প্রেমিকের পথ দুটি : (১) প্রেম করা; (২) খুন করা। আমার আবার আর-এক মুসিবত হল, সবকিছু বিশ্লেষণ করা। সেজন্য জীবনে শান্তি পেলাম না। লিখে লিখেই আত্মহত্যা, খুন, এমনকি প্রেমিকাকে পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছি (পৃ: ৪১)।’ তিনি যে জীবন যাপন করছিলেন কখনো কখনো তাঁর ভাবনার জগতটি বয়ে যাচ্ছিলো তারচেয়ে বিপরীতমুখী ধারার পানে। একটি সাংসারিক, গৃহী মানুষ যেন বিপরীত স্রোতে দাঁড় বাইছিলেন। সংসারের তেল-নুন-ঝোলের অভ্যেস যেমন তাঁকে ঘিরে রেখেছিল; তেমনই কর্তব্যকাজে নিবিষ্টও ছিলেন বোঝা যায়, আবার ব্যক্তিগত স্বপ্নের ভুবনটিও রেখেছিলেন ফুলেল করে। সেই ফুলে মৌতাত ছিল, জ্বলুনিও ছিল। কবি লিখেছেন, ‘আমার জীবনের জ্বলুনি-পুড়নি কাকে বোঝাব? আমার ৭২ বছর বয়সে এক নারী এসে আমার শরীর-মন ছারখার করে দিয়ে যাবে - এই তো আমার প্রাপ্য।’ (পৃ:৯২) লেখা শেষ করার আগে প্রাসঙ্গিক আরেকটি বিষয় সামনে আনতে চাই। এই গ্রন্থের লেখাগুলো এতটাই ব্যক্তিগত এবং স্পর্শকাতর যে বোধগম্য কারণেই কবি এগুলোকে তাঁর জীবদ্দশায় গ্রন্থভুক্ত করে যান নি। কবির মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র উত্তরসুরী হয়তো পুরো বিষয়টি দেখভাল করছেন এবং বইটির সহসম্পাদকও হয়েছেন, তাই কবিকন্যার কারণেই এ বিষয়গুলো সামনে এসেছে এবং অপ্রকাশিত এসব লেখা নিয়ে গ্রন্থ বেরিয়েছে তা বোঝাই যায়। বলেছিলাম ব্যক্তিগত বিষয়াদির কথা। কোথাও কোথাও এর মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে শারীরিক প্রসঙ্গও এসে পড়েছে। স্মৃতিচারণার এ-সমস্ত বিষয় পড়ার পর মনে প্রশ্ন জাগে, যাকে নিয়ে কবির সুখ-অসুখের কাব্যগাঁথা তার প্রাইভেসি লেখাগুলোর মাধ্যমে কতটা রক্ষিত হলো? সম্পর্কিত মানুষগুলোর সম্মান এবং গোপনিয়তা রক্ষার বিষয়টি কোনোভাবেই মাথা থেকে সরাতে পারছি না। শুধু তাই নয় ‘ঘুমের ভিতরে নিদ্রাহীন’ নামের একটি কবিতার বইও কবির মৃত্যুর পর বেরিয়েছে এবং সেই কবিতাগুলোর বিষয়বস্তুও আলোচ্য গ্রন্থটির মতোই। শুরুতে এই গ্রন্থটিকে প্রকাশনা জগতের ব্যতিক্রম বলে যে কথাটি বলেছি সেই সূত্রে এটিও বলতে চাই, কবির এই ভীষণ গোপন এবং ব্যক্তিগত বিষয়গুলো আসলেই মৃত্যুপরবর্তী সময়ে গ্রন্থভুক্ত হয়ে সর্বজনীন পাঠের বিষয় হতে পারে কি না সেটি নিয়ে ভাববার অবকাশ রয়েছে।