User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’- কাব্যগন্ধী ভাষার স্বপ্নবুনন ডঃ বেলাল হোসেন ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ উপন্যাসের প্রথম বাক্য- ‘অথৈকে কেউ-ই বিমানবন্দরে আজ বিদায় জানাতে আসেনি।’ প্রথম বাক্যের পরই লেখক দুই স্পেচ গ্যাপ দিয়েছেন। উপন্যাসের শুরুতেই এই বিরতি দিয়ে তিনি যেন পাঠকের অন্তর্লোকে একটা গোপন সংকেত পাঠান। আর তা হলো, বাক্যের বিন্যাস আর গল্প বলার দূরন্ত গতিতে, এমনকি তার তৈরী চরিত্রের চরমতম মানবিক বিপর্যয়েও তিনি তার উপন্যাসের বিনির্মাণ কাঠামোতে দৃশ্যকল্প নিয়ে খেলা করবেন। অথৈ বাংলাদেশের এক তরুণ সামরিক অফিসার। জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষী মিশনে তার পশ্চিম আফ্রিকার দেশ আইভরি কোস্ট যাত্রা। ‘ঢাকার এপ্রিলের বাতাসে কীসের যেন ইংগিত ভেসে আছে। বিমানবন্দরের অপর প্রান্তের সবুজ দৃশ্যগুলোর উপরে আলোর এক মায়াবী স্তর যেন বলছে – এখনই ভোর অথবা ঝড় হবে, অথচ রাত মাত্র দশটা। অথৈ কী ভাবছিস বাবা? হঠাৎ পেছনে ফিরে তাকাল অথৈ। সে যেন মায়ের কন্ঠ স্পষ্টই শুনতে পেয়েছে। পৃথীবির নীল-কালো স্তরের ভেতরে তখনো আবছা রহস্যময় ইংগিত।’ উপন্যাস শুরু হয় এভাবেই। বিমানবন্দরে ক্লান্ত অথৈকে দেখে দিবার ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’ এর নায়ক চরিত্রের কথা মনে পড়ে। সে অথৈর কাছে অটোগ্রাফ চায়। সাধারণ মানুষের কাছে কেউ অটোগ্রাফ চায় এটা ওর বিশ্বাসের বাইরে। শেষ পর্যন্ত অথৈ মেয়েটির ডায়েরীতে অটোগ্রাফ দিতে বাধ্য হয়- ‘যারা যুদ্ধে যায় যে যুদ্ধে যাচ্ছে, যদি সে কখনো ফিরে না আসে আর মনে রেখো তবুও পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে সে এই পৃথীবির কোথাও; লাল-সবুজ পতাকা জড়িয়ে গায় পৃথীবির ঘাসে মিশে আছে তার অহংকারী-হৃদয় যারা যুদ্ধে যায়!’ ইউনিফর্ম পরিহিত মানুষদের অপছন্দ করলেও, অক্সফোর্ডে ইংরেজ়ী সাহিত্যে পড়া দিবা বুঝতে পারেনি,সামান্য এই কয়েকটা বাক্যের মানবিক আর্তির কাছে অথৈ নামের এক তরুণের মায়াবী চোখদুটো তার হৃদয়ে দৃশ্যকল্প হয়ে যাবে। ২. জাতিসংঘ মহাসচিবের পক্ষে এস আর এস জি বিশাল অপারেশন রুমে সামরিক এবং বেসামরিক স্টাফদের ব্রিফিং করছেন। নতুন আগতদের উদ্দেশ্যে তিনি প্রশ্ন করেন ‘আফ্রিকার অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে কালচার্ড এ দেশ, হাউ ডু ইউ ফিল – দ্য নিউ কামারস?’ অথৈ উত্তরে জানায় … এই কালচার এরা নিজকে ভুলেই চর্চা করছে।… যে দেশে এমন এক মূর্তি স্থাপিত যা এদেশের সংস্কৃতি রিপ্রেজেন্ট করে না অথচ এই কালচার্ডদের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই… স্থানটি নির্দিষ্ট করে আমি বলতে পারব না। তবে আমি গাড়ি পার্কিং করে মূর্তিটার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। শরীর বাঁকা করে এক কালো নারী কী যেন চাইছেন। বোঝা যায় খাবার চাইছেন। অথচ এদেশের কুমারী ভূমি কত উর্বর! আমগুলো গাছে পেকে পঁচে যাচ্ছে।’ অথৈর মন্তব্যে সবাই হাসলেও, ওর তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ উচ্ছল আর উদ্ভিন্ন যৌবনা ফরাসী তরুণী এলমার দৃষ্টি এড়ায় না। উপুর্যুক্ত উদ্ধৃতিটি একটু দীর্ঘ হলো বটে। তবে উপন্যাসটি আগাগোড়া বোঝার জন্য উদ্ধৃতিটি আবশ্যক বলে মনে করি। কেননা এ অংশে শুধু উপন্যাসটির পটভূমিই নয়, আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় সমগ্র উপন্যাসের অন্তর্লোলেকের বুননটি এখানে গাঁথা হয়েছে। কী ঘটতে যাচ্ছে, কী ঘটবে, লেখক কী বলতে চান বা চাচ্ছেন, তার জীবনদর্শন কী? ইত্যাদি সব বিষয়ের ‘মেসেজ’ এখানে লেখক ইংগিতের মাধ্যমে দিয়েছেন। সেই কারণে এই অংশটিকে আমি ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ উপন্যাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলব। ঠিক ‘লালসালু’তে যেমন। তাহের কাদেরের মাছ ধরার দৃশ্য। শ্রাবনের এক নিরাকপড়া দুপুর। মতিগঞ্জের সড়কে মজিদের প্রবেশ এবং নাটকীয় ভঙ্ঘিতে মজিদের মোনাজাত। তারপর একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকে। সে সব ঘটনার পূর্ববার্তা লেখক যেমন এখানে সংকেতের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন; ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’তেও আলোচ্য পটভূমিতে পরবর্তী ঘটনাসমূহের ইংগিতীয় উপস্থান লক্ষ্যনীয়। অথৈ-এলমা-দিবা। ত্রয়ী চরিত্রের ঘূর্ণাবর্ত এবং ঘটনা-স্রোতের প্রচন্ড টানে নিমজ্জিত অথৈ-এলমা-দিবা। সাথে উপরিপাওনা আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যে আফ্রিকান পটভূমি, সা্ম্রাজ্যবাদীদের কূটচাল, রাষ্ট্রদখল, সমর-প্রতিচ্ছায়া সবকিছু মিলিয়ে বাংলা উপন্যাসের আন্তর্জাতিক ভূগোলায়ন। তাহলে শেষ থেকেই শুরু করা যাক –বাংলা উপন্যাসের পটভূমি ঘর থেকে বেড়িয়ে আন্তর্জাতিকতায় পা দিয়ে আফ্রিকায় পৌঁছেছিল চল্লিশের দশকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে। তার ‘চাঁদের পাহাড়’ নামক কল্প উপন্যাসেই আমরা প্রথম আফ্রিকার দেখা পাই। তারপর বাংলা উপন্যাসে করাচি, সিডনি, লন্ডন, নিউইয়র্ক,হাওয়াই বহু আন্তর্জাতিক স্থানিক পটভূমিক ভূগোলায়ন ঘটলেও এক মলাটে – ঢাকা,(আবার বাংলাদেশের দুটি আঞ্চলিক শহর বগুড়া ও নীলফামারি) থেকে আফ্রিকা (প্রায় সমগ্র পশ্চিম আফ্রিকা), সেখান থেকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স,সুইজারল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত ভূগোল ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’য়। এই ভূগোলায়নের সাথে উপন্যাসের একেবারেই ভিন্ন স্বাদের গল্পের পটভূমি(গল্পের পরের অংশে কী ঘটতে যাচ্ছে,তা পাঠক আঁচ করতে পারবেন না), বিশালায়তনের এই গ্রন্থের গতিময় অথচ কাব্যিক ভাষা, গল্পের ভেতর পাঠককে বুঁদ করে রাখার জাদুকরী ক্ষমতা –এসবই উপন্যাসটিকে বিশ্বমানের উপন্যাসে উন্নীত করেছে। অটোগ্রাফের সূত্রে দিবা-অথৈর যোগাযোগ মেইলে। দিবার সাথে অথৈর ভালোলাগা তৈরী হলেও বস্তুত তারা একে অন্যকে ভালোবেসে ফেলে অথৈর দুমাস ছুটির সময়। একে অন্যকে কাছ থেকে দেখে। সাদামাটা অথচ গভীর হৃদয়ের স্বপ্ন-তরুণ অথৈকে ভালোবেসে বিয়ে হয় তাদের। বিবাহিত স্ত্রীকে লন্ডনে রেখে পুনরায় কর্মক্ষেত্রে যোগদান করে অথৈ। তারপর আফ্রিকার গভীর অরণ্যে অপহৃত কর্ণেল ফল ব্যাককে উদ্ধার অভিযানে বাংলাদেশের পক্ষে অপারেশন ‘রেইন হান্টার’ এর নেতৃত্ব বর্তায় অথৈ এর উপর। সেই উদ্ধার অভিযানে ফরাসী বাহিনী নিয়ে তার সংগী হয় লাস্যময়ী ক্যাপ্টেন এলমা। হাজার কিঃমিঃ দূরে সাসান্দ্রা নদী পেরিয়ে একসময় নরখাদক বাহিনীর নিক্ষিপ্ত বর্শায় আহত এলমাকে বাঁচাতে গিয়ে অথৈ-এলমা জড়িয়ে যায় নিয়তি-চক্রে। দলবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে দুজন। ঘটনাক্রমে ফল-ব্যাকের আস্তানায় স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে কিছুদিন বসবাস। উপন্যাসের জটিল এই অংশের দৃশ্যকল্প অঙ্কন, নারী-পুরুষের সম্পর্কের চিরন্তন অনুভূতি, গল্পের প্রতীকী উপস্থাপনে লেখকের মুন্সিয়ানা লক্ষ্যনীয়। অথৈ-এলমার ‘বাদামী কাঠের ঘর’ - এ পর্যায়ে উপন্যাসের এরকম বাক্যগুলো নির্জন পৃথীবির রহস্যভেজা রুপ-রস-গন্ধে পাঠককে অদ্ভূত এক অনুভূতিতে আক্রান্ত করে। তারা নিজেরাই প্রেমে পড়ে যান! অন্যদিকে সন্তানসম্ভবা দিবা বি বি সি’র খবরে জানতে পারে ফল ব্যাককে উদ্ধার অভিযানে নরখাদকের খপ্পড়ে অথৈ-এলমা। তাদের বেঁচে থাকা অনিশ্চিত। এরপর দিবার পান্ডুর দিন রাত্রিগুলো লেখকের বর্ণনায় বড় মর্মস্পর্শী। তার চেয়েও মর্মস্পর্শী ট্রুপস বিচ্ছিন্নতার অভিযোগে সামরিক আদালতে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত অথৈকে বাঁচাতে এলমার প্রানপণ লড়াই। ৩. সমগ্র উপন্যাসটির মূল অধ্যায় তেরটি। প্রতিটি অধ্যায়ের ভিন্ন ভিন্ন কাব্যিক নাম উপন্যাসটির ভিন্নতায় যোগ করেছে নতুন মাত্রা। ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’র কাহিনী সরল রৈখিক নয়। এ উপন্যাসের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এর কাব্যগন্ধী ভাষা এবং স্পষ্টতা। উপন্যাসের পরতে পরতে কাব্যময় ভাষিক উপস্থাপন কাহিনীর দীপ্তিকে উজ্জ্বল্য দান করেছে। গভীর জীবনবোধ, পাঠকের চোখের সামনে প্রকৃতি আর দৃশ্যকল্পকে স্পষ্টকরণ করা হয়েছে এক গতিময় সাবলিল ভাষায় যা লেখকের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হিসেবেই একদিন বিবেচিত হবে। ভিন্ন-স্বাদের গল্পে পাঠকের সামনে একের পর এক অজানা জগত আর নতুন নতুন তথ্যের দিগন্ত উন্মোচিত হতে থাকে। অথৈ-দিবা ও এলমার জীবনের ঘূর্ণিস্রোতে পাঠক নিজেও নিমজ্জিত হয়। আবার সে চরিত্রগুলোর মানবীয় উত্থান-পতন প্রত্যক্ষে নিজেও আনন্দিত অথবা ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকে। ৪. সাম্রাজ্যবাদ বর্তমান বিশ্বের একটি ভয়াবহ সমস্যা। সাম্রাজ্যবাদ কীভাবে যুদ্ধের পটভূমি তৈরী করে এবং সে খেলায় মাঝে মধ্যে ক্ষান্তি দিয়ে জাতিসঙ্ঘের পতাকাতলে কীভাবে শান্তির দাওয়াই ফেরী করে কর্পোরেট রাজনীতি –তার বিশ্বস্ত দলিল ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’। উপন্যাস থেকে কিছু উদ্ধৃতি- অথৈ এলমাকে বলছে ক। রিবেলস শব্দটা রাজনৈতিক অথবা কর্পোরেট। কৃত্রিম সংকট। এ দেশের সরকার, জাতিসঙ্ঘের স্টাফ এবং ফোর্স সবার জন্য রাস্তাটা নিষিদ্ধ করে রেখেছে। মিডিয়ায় তারা ফ্রান্সের বিরুদ্ধে কথা বলছে। অথচ ‘ফ্রান্সের-পাইপলাইন’ নামের ঐ রাস্তাটা রিবেলস শব্দের আড়ালে তারাই পাহাড়া দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ তাদের শোষনের পাইপলাইন চেনে বলে মনে হয় না। যুদ্ধটা আসলে নিজ স্বার্থে। বিশ্বের চোখে ধুলা দিয়ে ব্যবসা করা।(পৃষ্ঠা ২৬) খ। মদ-নৃত্য, নারী,হাই-ভলিউমের চিৎকারে বুঁদ হয়ে থাকা –এদের জীবন। এদের রক্তস্রোত। পঙ্ঘু রাখার এই সংস্কৃতি ফ্রান্সের শেখানো। …মদ সস্তা। বাংলাদেশি বিশ টাকায় ফ্রান্সের সলিব্রা এরা সেলিব্রেট করে… বলে রাখি এদেশে এক বোতল মিনারেল ওয়াটারের দাম ষাট টাকা। তাই পানির বদলে মদ খাওয়াই যুক্তিসংগত। গ। একটা জাতির ভাষা ফরাসিরা কেড়ে নিয়েছে। এ দেশে ভিক্ষুক শব্দ কোথাও খুঁজে পাবে না। ৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশী রপ্তানী উদ্বৃত্ত। তবু এদের খাদ্যের অভাব! (পৃ-৭৫) ঘ। খনিজসম্পদগুলো তোমরা সব নিয়ে যাচ্ছ আমাদের চোখের সামনেই। তোমাদের সেই ‘এক্সট্রাকশনে’ আমরা পাহারাদারমাত্র।(পৃ-৯৪) পুরো উপন্যাস জুড়ে এমনিভাবে সাম্রাজ্যবাদীদের শোষনের চিত্র অংকিত হয়েছে। সাথে সাথে উপন্যাসজুড়ে বাংলাদেশ নামক দেশটির জন্য অথৈর হৃদয় নিংড়ানো আকুল ভালোবাসা আর গভীর মমত্ব যে কোনো বাংলাদেশির সত্তাতেও যেন আকুলতা ছড়িয়ে দেয়। আফ্রিকাসহ পৃথিবীর সকল বঞ্চিত মানুষের অধিকারের কথা এমন স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতে গিয়ে লেখক সাম্রাজ্যবাদিদের বিরুদ্ধে হয়ে উঠেছেন অত্যন্ত সাহসী এবং প্রতিবাদী কন্ঠস্বর যা এই উপন্যাসে যোগ করেছে আরো এক ভিন্নমাত্রা। তিন প্রধান চরিত্র, এলমা-অথৈ-দিবার ত্রিভূজ প্রেম, এলমার সাথে গড়ে উঠা শারিরীক সম্পর্ক চিত্রনে লেখক যে শিল্পমান দেখিয়েছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’র সহজ বাক্যের সুর ছন্দে লুকানো আছে দার্শনিকতা। উপন্যাসের বাক্যগুলো পাঠকের মননকে আলোকিত করতে করতে যেন অন্ধকার এক রহস্যময় জগতে চুম্বকের মতো টানতে থাকে। উপন্যাসের আরো একটি উজ্জ্বলতর অংশ হলো এর ভেতরের চরিত্রগুলোর কথোপকথোন- অথৈ এলমাকে বলছে ‘ওদের খুন করে এদেশের দেবতা সাজার ইচ্ছেটা তোমাদের ‘থটস’(ভাবনা)… আর নিজ দেশে ডাকাতির সাজা ভিনদেশীদের ট্যাংকের চাকায় পিষ্ট হওয়া। … এ ব্যাপার নিয়ে যাদের কথা বলার অধিকার নেই, তাদের ভাবনাকে ভাবনা নয়; বলে অনুভব।’ (পৃ-২৩) ‘তোমাদের ট্যাংকের গর্জনের ভাষা এই বিশ্ব যত বুঝেছে, ঐ অনাহারী মানুষগুলোর কষ্টের ভাষা তত বোঝেনি।’ (পৃ-২৪) অথবা ভয়ংকর ডাসিরিতে প্রবেশের মুখে, নরখাদক দলের প্রথম প্রতিরোধ আক্রমণে সতীর্থ হারানোর বেদনায় যখন মূহ্যমান এলমা, গভীর বনের মুখে অসীম নীরবতায় একটা জাহাজে তারা যেন তীর্থযাত্রী। এলমাকে প্রাণবন্ত করার জন্য অথৈ বলছে- ‘আমাদের বোধের চেয়েও জীবন বেশী দুর্বোধ্য।দর্শকশুন্য নাট্যমঞ্চে আত্মোপলব্ধির চেয়ে জীবন বেশী অবুঝ। ভালোবাসাহীন জীবনের পরিণতিহীন পরিণতির চেয়ে জীবন মাঝে মাঝে করুণ। ভালোবাসার উত্তাপে সঞ্চিত গভীরতম আবেগের চেয়েও জীবন বেশি অদৃশ্য। প্রতিটি নরের। প্রতিটি নারীর। চেয়ার্স এলমা।’ (পৃঃ ২০২) কোর্ট-মার্শাল এর প্রধান ফরাসী জেনারেল টেরি মোনাক এলমাকে নিজের বিছানায় নেওয়ার জন্য হুমকি দেন ‘ইউ আর এ্য ব্লাডি মিলিটারি অফিসার। পৃথিবীর কোনো কোর্ট-মার্শালে সুবিচার হয় নি, হয় না, হবেও না। ভালো করেই জানো, ওটা ছিড়ে যাওয়া সুতা জোড়া লাগানোর প্রহসন।’(পৃঃ ২৮০) উপন্যাসজুড়ে এ ধরনের কথোপকথন পাঠক-চিত্তে গেঁথে যাওয়া এক একটা অমলিন মুহূর্ত হয়ে থাকে। আফ্রিকার লোকবিশ্বাসও সংগত কারণেই উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে। স্থানীয় এক স্কুল শিক্ষকের কাছে অথৈ জানতে পারে আফ্রিকান সমাজের সেই বিভিষিকাময় মৃত্যুবিশ্বাস। তাদের শিশুরাও বিশ্বাস করে মৃত্যুর ছয় সপ্তাহ পর আবার পূনর্জন্ম হয়। এই বিশ্বাসের কারণে বৃদ্ধ হওয়ার চেয়ে মরে গিয়ে তারুণ্য; যৌবন ফিরে পাবার আনন্দ-ভাবনায় মরে যাওয়াটা তাদের জন্য বড় কোনো ঘটনা নয়। তাই তারা এইডস হবে জেনেও এইডস এর প্রতিরোধক ব্যবস্থা নেয় না। আবার মেয়েরা সোনার অলংকার ব্যবহার করে না এই ভয়ে যে তাদের আর পুনর্জন্ম হবে না! মজার ব্যাপার এই লোকবিশ্বাসগুলো তাদের শোষণের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে উন্নত বিশ্বের মানুষদের দ্বারা ছড়ানো। এছাড়া নরখাদক এলাকার উপজাতীয় সংস্কৃতি উপন্যাসটিতে স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল। যেমন গর্ভবতী নারীরা পুরুষ মানুষের মুখ দর্শন করলে উপজাতীয় রাজার মৃত্যু হয়,তাই সন্তান না হওয়া পর্যন্ত তাদের আটকে রাখা হয় পুরুষ বর্জিত এলাকায় নির্মিত আতুঁড়ঘরে। ৫. একটা ভালো উপন্যাসে যেমন থাকে বিস্তৃত এক জীবন তেমনি চরিত্রগুলোর উত্থান-পতন এবং মানবীয় পরিবর্তন। এক্ষেত্রে আমার দৃষ্টিতে উপন্যাসটির সবচেয়ে শক্তিশালী চরিত্র এলমা। স্রোতে ভাসা, বয়ফ্রেন্ড-হান্টে বিশ্বাসী একসময়ের এলমা অথৈ এর সান্নিধ্যে সত্যিকারের ভালোবাসার স্বরুপটা চিনতে পারে। বদলে যাওয়া এলমা অথৈকে বলে ‘তুমি সব উলট-পালট করে দিলে। দিবার প্রতি তোমার অহংকারী গভীর ভালোবাসা, আমাকে প্রতিদিন সত্যিকার ভালোবাসার স্বরুপটা চিনিয়ে দিল। প্রতিদিন আমার সত্তাকে জাগিয়ে দিতে থাকল। এ এমন এক আগুন! তার জ্বলায় নির্দিষ্ট সময় পর অন্তর মনে সুস্থির হয়। আমিও সুস্থির হলাম। গভীর ভালোবাসায় অথৈ নামটা আমার হৃদয়ে স্থির হয়ে গেল। শুধু তোমাকেই নয়, দিবাকেও ভালোবাসলাম। আমি পূর্ণ হলাম অথৈ।’ এই হলো এলমা। দিবা মরে গিয়ে বেঁচে গেল কিন্তু এলমা অথৈর ভালোবাসায় সারাজীবনের জন্য নিমজ্জিত হলো অথৈ-শুন্যতায়। ভালোবাসার এমন শক্তিই এলমাকে বাস্তবতার দেবী করে তোলে। সকল হলাহল পান করে যে নিজের ভালোবাসাকে, প্রেমকে বাঁচাতে চায়। তাই সে অথৈকে শেষ চিঠিতে লিখে ‘দিবাকে বলে রেখো এ জন্মে ত্যাগটুকু আমার হলেও পরজন্মে পাওনাটুকু আমার। ঐ পারে সে যেন তোমার দিকে কখনোই হাত না বাড়ায়, অনন্তকাল অপেক্ষা করে কাউকে পেলে… কী জানি… সহ্য মনে করা যায় না।’ একই চিঠিতে এলমা আরো জানায় ‘জানো অথৈ, আমি মা হব! ছেলে হলে ওর নাম রাখব অথৈ। মেয়ে হলে দিবা। আমাকে কোনো ঠিকানায় খুঁজো না। পাবে না। ছোট অথৈ আর আমার নতুন সংসার! সেখানেই আমার অনন্ত অপেক্ষা। তোমার জন্য।’ আমার মনে হয় দিবার তুলনায় এলমা অনেক সক্রিয় চরিত্র। এমন চরিত্র বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয়টি নেই যার সাথে এলমার তুলনা চলে। প্রতিদিন চলার পথে এমনকি জীবনের চরমতম বিপর্যয়ে অথৈকে দিবার চেয়ে এলমা কাছ থেকে চেনার সুযোগ বেশী পায়। এই চেনাটুকু এলমাকে নিজের সত্তার কাছে নতুন করে ফিরে নিয়ে যায়। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে পাঠক দিবার তুলনায় এলমার দিকে ঝুকে পড়ে -সম্ভবত এলমার ভালোবাসার শক্তির কাছে পাঠকও পরাজিত হয়। যেমন উপন্যাসটি পড়া শেষ হবার পরও ক’দিন আমার উপর ভর করে ছিল এলমা-আচ্ছন্নতা, দিবা নয়। বাস্তব জগতের প্রতি নির্মোহ থেকেও যে আবেগে উপন্যাসিক ভালোবাসার আকুলতা ছড়িয়ে রেখেছেন ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’য় তার প্রচ্ছন্ন ভাবাবেগ প্রতিটি পাঠককে আচ্ছন্নতায় ডুবিয়ে রাখবে বলেই আমার ধারণা। ৬. উপন্যাসের পটভূমির কারণে ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’য় দিবার উপস্থিতি কম। তবু পাশ্চাত্যে বড় হয়ে উঠা এই তরুণীর আপাদমস্তক বাংগালী নারীত্বে ঢাকা। অথৈর জন্য তার ভালোবাসা এক কথায় বলা যেতে পারে শরৎচন্দ্রীয় নারীর মতো। তাই কম উপস্থিতি নিয়েও তার স্পষ্ট চরিত্র, মেধাবী মনন এবং তার শেষ পরিণতি পাঠকের অন্তরে দাগ কেটে যায়। দিবার মৃত্যুর পর অথৈ তার দেশের বাড়িতে এক পুরাতন ডায়েরী খুঁজে পায়। অথৈর সেই ডায়েরীতে দিবা চুপি চুপি লিখে রেখেছিল একটা কবিতা -ছোট্টবেলার অথৈর ডায়েরীতে লেখার ধরণ অনুকরণ করে। সেই কবিতা ঝাপসা চোখে দেখলে বাংলায় লেখা ২ অক্ষর হয়ে যায়। ‘এই পৃথীবি পৌঁছেছে/যুদ্ধ নামের/কর্পোরেট ব্যবসায় … যারা যুদ্ধে যায়!/ যারা যুদ্ধে পাঠায়/ কপট তারা/ভ্রষ্টচারী/ … যারা যুদ্ধে পাঠায়/ট্রিগারে উদ্দেশ্যহীন হাত/ উশখুশ রাত/শীতল মৃত্যু/’লক্ষ্য’ অথবা ‘উদ্দেশ্য’ পর্ণোনামক রাজনীতি। অঙ্কের দুই যেন ক্রমশ ভেঙ্গে যাওয়া, পাঁচ পৃষ্ঠায়, ১৩৫ পংক্তির স্থান পাওয়া দিবার ভাবনাগুলোই যেন উপন্যাসের প্রতিটি পৃষ্ঠার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। অথৈর অজান্তে,তার অনুপস্থিতিতে, তাদের বিয়ের আগেই দিবা অথৈর ঘরের প্রতিটি অংশে তার ভালোবাসার ছাপ রেখে গিয়েছিল। উপন্যাসের শুরুতে,বিমানবন্দরে দিবার ডাইয়েরীতে লেখা অথৈর অটোগ্রাফের প্রভাব উপন্যাসের শেষে এসে এক ব্যঙময় প্রতীক হয়ে যায়। অথৈ আর দিবা দুজন মিলে ‘এক’ হতে চেয়েছিল। যুদ্ধ অথবা কর্পোরেট রাজনীতি দুজনের এক হয়ে উঠাকে ভেঙ্গে দিয়েছে। পৃথিবীতে ‘মানবতা’ শব্দটুকু এভাবেই সাম্রাজ্যবাদের কারণে অস্তমিত! দিবার মৃত্যু যেন এই প্রতীককে ধারণ করা এক চিরন্তন সত্য। প্রতীকটুকু বোঝামাত্র উপন্যাসের প্রতিটি পৃষ্ঠায় প্রায় না থেকেও দিবা নামের এক অসাধারণ নারীর মুখটা যেন প্রচ্ছন্নভাবে ভেসে উঠে। দিবার আকুল ভালোবাসায় পাঠকের হৃদয়েও জেগে উঠে অদ্ভুত এক হাহাকার। আর এই হাহাকার জাগামাত্র পাঠক লেখকের প্রতি অভিমানী হয়ে উঠেন। উপন্যাসটিতে এত কম সময় দিবাকে পাওয়ার কারণে। সত্যিই উপন্যাসটির যে বিস্তৃতি তাতে এর কলেবর আরো একটু বড় হলে পাঠক-তৃপ্তি বাড়ত। বাংলা শব্দ গাঁথুনির অসাধারণ চমৎকারিত্বের মাঝে হঠাৎ দু একটা ইংরেজী শব্দের ব্যবহার লেখক এড়িয়ে গেলেই ভালো করতেন। সাসান্দ্রা নদী হয়ে হাজার কিঃমিঃ দূরে গভীর বনে; নরখাদক এলাকায় গিয়ে অথৈ খুঁজে পায় দক্ষিন ভারতীয় অনিতাকে। যে অনিতা অপারেশনে যাওয়ার আগে অথৈকে বিদায় জানিয়েছিল আবিদজানে। নতুন সাম্রাজ্য তথা বিশ্বের সব শ্রেনীর মানুষ দিয়ে গড়া অভায়রণ্য বিস্তারের সংকল্পে কর্নেল ফল ব্যাকের মানুষ-ভ্রুণ কেনায় অনিতা কীভাবে অংশগ্রহণ করেছে তা স্পষ্ট নয়। এসব সত্ত্বেও ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ সাম্রাজ্যবাদের এক বিশ্বস্ত দলিল হিসেবে বাংলা সাহিত্যে দিন দিন শক্তিশালী এক উপন্যাসের অবয়ব ধারণ করবে বলেই আমার বিশ্বাস। ৭ উপন্যাসের কাহিনী বাঁক নিয়েছে ফল ব্যাককে উদ্ধার অভিযানে সাসান্দ্রায়। সাসান্দ্রার আগ পর্যন্ত উপন্যাসের কাহিনী একেবারেই সরলরৈখিক। এখান থেকেই ঘটনা অথবা কাহিনী প্রবাহের ইসিজি গতি। ঋজুতা ভেংগে এই বক্রতাই উপন্যাসের বাঁক ফিরিয়েছে। সুতরাং উপন্যাসের নামকরণটি সার্থক বলা যায় নিঃসন্দেহে। উপন্যাসটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য কী? এক কথায় বলা যায় পাঠককে আকর্ষণের চৌম্বকীয়তা। এর কাহিনী, ঘটনাপ্রবাহ, চরিত্র, ভাষা, সবকিছু পাঠককে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। পাঠককে ধরে রাখা যদি উপন্যাসিকের সবচেয়ে বড় গুণ বা বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকে তাহলে সে ক্ষেত্রে লেখক একশত ভাগ সফল এ কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। আমি মনে করি ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ উপন্যাসটি আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যে শুধু আন্তর্জাতিক পটভূমিই তৈরী করে নি -নতুন একটি ধারাও সৃষ্টি করেছে। বাংলাভাষায় লেখা এ উপন্যাসটি প্রথম সামরিক জীবন-ধারায় সৃষ্টি সাহিত্য-উপন্যাস। নতুন সংস্করণে বিদ্যাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত ৩২৯ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি বাংলাভাষী পাঠকের চিত্ত ও জ্ঞানকেই শুধু সমৃদ্ধ করবে না, একটি নতুন জগতে নিয়ে যাবে এই প্রত্যাশা। কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা কাব্য-সাহিত্যে ঝড় তুলেছিলেন নতুন ধারার কবিতা লিখে। তার প্রায় নব্বই বছর পর আরেক কাজী বাংলা কথাসাহিত্যে তথা উপন্যাসে নতুন ধারার ঢেউ জাগালেন। জয়তু কাজী রাফি। বিঃদ্রঃ এমন ক্ষুদ্র পরিসরে এ উপন্যাসটির পূর্ণাঙ্ঘ আলোচনা মোটেও সম্ভব নয় বলে আমি মনে করি। উপন্যাসটি পড়ার সময় আমি যেভাবে আলোড়িত, আন্দোলিত, নির্ঘুম-মোহেয় আচ্ছন্ন হয়েছিলাম সে অনুযায়ী আমি আমার অভিব্যক্তির বোধ হয় পাঁচ ভাগও প্রকাশ করতে পারলাম না। সৈজন্যেঃ ইত্তেফাক সাহিত্য সাময়িকি
Was this review helpful to you?
or
আমি সাধারণ এক পাঠিকা মাত্র। 'ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা' র মতো অসাধারণ এক উপন্যাস নিয়ে মন্তব্য করা আমার জন্য সম্ভব নয়। তবে উপন্যাসটি পড়ার সময় আমি নাওয়া-খাওয়া ভুলে গিয়ে কী এক ঘোরের মাঝে ছিলাম- বোঝাতে পারব না! তারপর আরো কয়েকবার পড়লাম। এর মাঝে কী আছে জনিনা, এই উপন্যাসের জগত আমাকে বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকে। একদিন, এই উপন্যাস ঘরে ঘরে প্রিয় এক বই হয়ে বাস করবে, এ ব্যপারে আমি নিশ্চিত। লেখককে আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই, আমাদের এমন একটি জগত উপহার দেওয়ার জন্য। আমাদের শিল্পমানকে তিনি বড় এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন এই উপন্যাস দিয়ে।