User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
শহীদুল জহিরের লেখা অনন্য
Was this review helpful to you?
or
বাস্তব ও জাদুর জগত শাহেদুজ্জামান লিংকন বাংলা ছোটগল্পের অগ্রসেনানী আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একবার আশংকা প্রকাশ করেছিলেন ছোটগল্পের মৃত্যুর ব্যাপারে। ছোটগল্পের দশাটা যেমনই হোক এর ¯্রষ্টার সংখ্যা বাংলাসাহিত্যে কষ্মিনকালেও কম নয়। তবে সতন্ত্র ধারার গল্প লিখে অনেকের মাঝে অনন্য হয়ে আছেন এমন গল্পকারের সংখ্যা হাতে গোনা। শহীদুল জহির তেমনি এক প্রতিভাধর বিরলপ্রজ গল্পকার। ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্যে বিশেষ করে মার্কেজের লেখায় জাদুবাস্তবতার যে বিস্তার তার সফল প্রয়োগ বাংলাসাহিত্যে প্রথম আনেন শহীদুল জহির। তার তিনটি গল্পগ্রন্থের প্রথম দু’টির সংকলন ‘শহীদুল জহির নির্বাচিত গল্প’ (পাঠক সমাবেশ, ২০০৭)। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পারাপার’ এ গল্পসংখ্যা পাঁচটি। ‘পারাপার’ শিরোনামের গল্পটি ফেরিঘাটের বর্ণনা নিয়ে। এক সাহেব তার বেডিং পাহারা দেয়ার জন্য ওলিকে অনুরোধ করেন। ওলিকে বেডিং-এর পাশে দেখে দু’জন টোকাই আসে কুলির কাজ নেয়ার জন্য। বেডিং ওলির না হলেও সে তাদের আশ্বস্ত করে যে সাহেবকে বলে ব্যবস্থা করে দেবে। ব্যবস্থা সে করে দেয় ঠিকই কিন্তু সাহেব মজুরি দিতে চান মাত্র এক টাকা যা কিনা তিনটাকার কমে কেউ বইবে না। শেষমেশ জেদ করে টোকাই ছেলে দুটো রাজি হলেও একজনের বওয়া বেডিং পানিতে পড়ে যায়। সাহেব আবুল নামের টোকাইটিকে পুলিশের কাছে হ্যান্ডওভার করতে গেলে ওলি লোকটিকে বলে যে এক টাকায় মাল টানাতে চাইলে এমন হয় এবং সে আবুলকে ছেড়ে দেয়ার সুপারিশ করে। সাহেব লোকটি ওলিকে দালাল আখ্যায়িত করে ও তার ওপর চড়াও হয়। ওলি ভদ্রভাষায় কথা বলার পর কাজ না হলে সাহেবরুপী জানোয়ারটাকে ঘুষি মেরে নিজেকে মুক্ত করে যমুনার কালো ঘোলা পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে। ‘মাটি ও মানুষের রং’ গল্পটি এই গ্রন্থের মধ্যে সেরা বলা যায়। এই গল্পের শেষ অংশটি-ই চমক। শেষে এসে গল্পের মোড় ঘুরে যায়, যেমনটা আমরা পাই জেমস জয়েসের গল্পে। আম্বিয়া তার বাপের বাড়িতে আসার পর ছেলে লালকে নিয়ে গ্রামের ধনী পরিবার দবির খাঁর বাড়িতে যায়। সেখানে নানা কথার মাঝে বাপ-মা কালো হওয়ার পরও ‘লাল’ এর ফর্সা হওয়ার বিষয়ে আসিয়া খাতুন ‘ছিনালগো পোলা সুন্দরই অয়’ বলে অবজ্ঞা প্রকাশ করলে আম্বি বলে যে লালের বাপের কোমর ফর্সা এবং তার সাথে সঙ্গম করলে আসিয়ারও ফর্সা সন্তান হতে পারে। আম্বির প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর শুনে আসিয়া তখন থ। ‘ভালোবাসা’ গল্পটি শহিদ মিনার থেকে নিয়ে আসা ফুল নিয়ে হাফিজদ্দি ও আবেদার সহজিয়া ভালোবাসার বয়ান। ‘তোরার সেখ’ গল্পে সংসার সংগ্রামী তোরাব সেখের একরোখা জেদি মনোভাবের প্রকাশ দেখতে পাই। মেয়ের সম্পর্কের জিদ ধরে বাড়ির সকলের সাথে বাক-বিত-া করে, নিজেই সে বাড়ি ত্যাগ করে। ছেলে জমির ভাবে সকালেই তার পিতা ফিরবে কিন্তু জেদি তোরাব ফেরে না। ‘ঘেয়ো রোদের প্রার্থনা নিয়ে’ গল্পে সাম্প্রদায়িক অত্যাচার সাংকেতিকভাবে উপস্থাপন করেন শহীদুল জহির। যে জাদুবাস্তবতার জন্য শহিদুল জহির অনন্য তার প্রয়োগ প্রথম গল্পগ্রন্থে আমরা পাই না। দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’-এ শুরু হয় জাদুবাস্তবতার প্রয়োগ। নাম শিরোনামের গল্প ‘ডুমুরখেকো মানুষ’ শুরু হয় ভিক্টোরিয়া পার্কে মোহাব্বত আলির জাদু দেখানোর দৃশ্য দিয়ে। মোহাব্বাত আলির জাদু দেখানোর বর্ণনা শহীদুল জহিরের ভাষার জাদুতে এমনভাবে উঠে আসে যে পাঠক গল্পের ভিতরে ঢুকে যায়, জাদু ও বাস্তব একাকার হয়ে যায়। রূপকথার আদলে এই জাদুময়তা গল্পের শেষপর্যন্ত বজায় রাখেন গল্পকার। ‘আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল নেই কেন’ গল্পে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থার চিত্র আমরা দেখতে পাই। আগারগাঁও কলোনিতে একসময় ফুল ফোটে না, প্রজাপতি আসে না, ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্পে মৃত বৃক্ষপ্রেমিক আব্দুস সাত্তারের মগজের ছোঁয়ায় একটি স্থানে দু’টি নয়নতারা গাছে ফুল হয় ঠিকই কিন্তু নগরায়নের ফলে ঐ জায়গাটুকুও পাকা হয়ে গেলে সেখানে আর নয়নতারা ফুল জন্মায় না। ‘এই সময়’ গল্পে আজন্ম দুঃখী কিশোর সেলিম ও বিধবা শিরীনের প্রেম নির্মাণ করেন গল্পকার। সেলিমের মাধ্যমে আবু, হাফু ও শফি তিনভাই শিরীন আকতারের কাছে ফুল পাঠায় প্রেম নিবেদনার্থে কিন্তু শিরীনের মনে যে মায়া ও ভালোবাসা জন্মে তা সেলিমের জন্যই বরাদ্দ। তাই শিরীন আকতার এরশাদ সাহেবের দেয়া শাড়ি-গহনা ফকিরদের, আব্দুল জব্বারের দেয়া বেহেশতি জেওর মসজিদে দান করে, তিনভাইয়ের দেয়া মেশক-এ-আম্বর নর্দমায় ফেলে দেয় কিন্তু সেলিমের দেয়া ফুল-পাতা সযতনে রাখে। শেষাবধি এই প্রেমের করুণ পরিণতি ঘটে। ‘কাঁটা’ গল্পের বয়ান ও নির্মাণ কৌশল চমকপ্রদ। এখানে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের গোলকাধাঁধায় পড়ে পাঠক। মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু সুবোধচন্দ্রকে কুয়ায় ফেলে দেয়া ও তার স্ত্রী স্বপ্নার অনুগামী হওয়ার ট্রাজেডি কিছুতেই ভুলতে পারে না ভূতের গলির লোকেরা। তারা একটা সংকটের মধ্য দিয়ে জীবন পার করে। ভূতের গলিতে তিনবার ফিরে ফিরে আসে সুবোধ ও স্বপ্না। তিনটি ভিন্ন সময়ে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নিপীড়নের কৌশলী বর্ণনা ধাঁধাঁর মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করেন গল্পকার। ‘কাঠুরে ও দাঁড়কাক’ গল্পটি পড়ে মনে হতে পারে রুপকথা। কিন্তু একটা সংকেতময়তা এখানে কাজ করে। দরিদ্র আকালু যখনি কাক দেখে তখনি তার দুর্ভাগ্য নেমে আসে। গাছের কোটরে অনেক টাকা পাওয়ার পরও সে তার ভোগ করতে পারে না। উকিলের শরণাপন্ন হতে গিয়ে উকিল ও দালালের হাতে তার টাকা খোয়া যায়, এলাকাও ছাড়তে হয়। এরপর একবার এক যাত্রীর মানিব্যাগ পেয়ে ফেরত দিতে গেলেও উল্টো পুলিশের ফাঁপড়ে পড়ে সে, জেলে যেতে হয়। জেল থেকে বের হওয়ার পর হাজার হাজার কাক আকালু ও তার স্ত্রী টেপিকে পাহারা দেয়, কাকের আনা এটা-ওটা জিনিস বেঁচে তারা সাবলম্বী হয়ে ওঠে। কিন্তু এলাকার লোকজন তাদের এই অবস্থা পরিবর্তন ভালো চোখে দেখে না। আক্রমণ করতে গেলে আকালু ও টেপিকে কাকেরা উড়ে নিয়ে যায়। এখানেও বাস্তব ও কল্পনাকে এক করে দেন শহীদুল জহির। এই কাকেরা মূলত গ্রামের সাধারণ মানুষের প্রতীক যারা শহরে এসে কাজ করে, ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে, শহরের শহর হয়ে ওঠার পেছনে যাদের ঘাম-শ্রম তারাই বরাবর নিপীড়নের শিকার হয়। ‘ধুলোর দিনে ফেরা’ গল্পে আব্দুল ওয়াহিদের মৃত্যু সংবাদ অনেক আগেই আমাদের দেন গল্পকার। ফিরে ফিরে একটি কথাই আসে যে আব্দুল ওয়াহিদ আসলে মৃত্যুর জন্যই ফিরে এসেছিলো। এরপর ভিতরের ঘটনা খোলাসা করেন গল্পকার, নূরজাহান-আব্দুল ওয়াহিদ ও আবুল হোসেনের কাহিনী আমরা জানতে পারি। ময়না পাখির কথা বলা, গোলাপ গাছের সাথে কথা বলার সংকেতময়তার কারণে মৃত্যু সংবাদ আগে জানলেও গল্পটি পানসে হয়ে যায় না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে শহীদুল জহিরের গল্পে রিপিটেশন গল্পের প্রয়োজনেই। প্রথম প্রথম বিরক্তি আসতে পারে কিন্তু একবার মজে গেলে তা আলাদা মাজেজা নিয়ে আসে। আর শহীদুল জহির এমনভাবে গল্প বলেন যে তিনি যেন এইসব ঘটনা শুনেছেন। অন্যের দ্বারা যেন তিনি গল্প বলিয়ে নেন। ‘তারা বলে যে, গ্রামের/মহল্লার লোকেরা বলে যে’ এইসব ভঙ্গি তিনি নিয়ে আসেন। ‘চতুর্থ মাত্রা’ গল্পটি বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করে। এটি মূলত নিসঙ্গ আব্দুল করিমের সামাজিক হয়ে ওঠতে চাওয়ার যে প্রয়াস তারই গল্প। গল্পটির বর্ণনা নিত্যবৃত্ত ভবিষ্যতে। বর্ণনার অংশটুকু তৃতীয় বন্ধনীতে আবদ্ধ। শহীদুল জহিরের গল্পে সংলাপ কম কিন্তু এই গল্প সংলাপ-নির্ভর, মনে হতে পারে চিত্রনাট্য। আব্দুল করিম গ্লাস ভেঙ্গে দরজার কাছে রাখে যা দিয়ে পাড়ার ছেলেরা কটকটি কেনে, কটকটি নিয়ে তারা ঝগড়া বাধায়। আব্দুল করিম স্বপ্নে মালিকের পারমিশন ছাড়া শুকিয়ে যাওয়া নদী বা মরা ধানক্ষেত দেখে। এক রমণীর জন্য সে গোলাপ ছিঁড়ে রেখে চেয়ারে বসে থাকে। কিন্তু বরাবারই নিগৃহীত হয় নিসঙ্গ আব্দুল করিম। ‘আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস’ গল্পটি মাত্র একটি প্যারায় লেখা। একটি কমা দিয়ে শেষ করা যা কিনা প্রচলিত প্রথাগত নয়। তরমুজ নামের গ্রীষ্মকালীন ফলটিকে ঘিরে এই গল্প আবর্তিত হয়। দক্ষিণ মৈশুন্দির শিল্পায়নের ইতিহাসে আমার দেখি পূঁজিপতিদের দৌরাত্ম। মোট তেরটি গল্পের এই সংকলনে নানা স্বাদের গল্প আমরা পাই। প্রথম গ্রন্থের গল্পগুলোয় নারী পুরুষের প্রেম, মানবিকতা, নিম্নবর্গের মানুষের জেদী মনোভাব প্রাধান্য পায়। দ্বিতীয় গ্রন্থের গল্পগুলিতে জাদুবাস্তবতার আদলে সমাজচেতনা ও রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থাকে তুলে আনেন গল্পকার। শহীদুল জহিরের শব্দ সাধারণ হলেও তার বাক্যের গঠন অসাধারণ। জাদুময়তার মধ্য দিয়ে পাঠককে তিনি ধরে রাখেন গল্পের মধ্যে। পড়াতে পড়াতে পাঠককে নিয়ে যান ভূতের গলিতে, ভিক্টোরিয়া পার্কে মোহাব্বত আলির জাদুর আসরে, দক্ষিণ মৈশুন্দিতে কখনো বা সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ বা সুহাসিনিতে। শহীদুল জহিরের জাদু ও বাস্তবের এমন জগতে প্রবেশাগ্রহীদের জন্য পাঠক সমাবেশের নির্বাচিত গল্প সংকলনটি প্রবেশদ্বার। (তরুণ গল্পকার, রংপুর। ০১৭২১৭০০৭৫৮)