User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
মাদারডাঙ্গার কথা বাংলাদেশের যেকোনো গ্রাম বা প্রত্যন্ত জনপদের কথা হতে পারে, কুশলী কথাশিল্পী শওকত আলী মাদারডাঙ্গাকে তাঁর কাহিনির উপাদান হিসেবে বেছে নিয়েছেন। যে গ্রামটিতে একটি মাজার আছে, আছে সেই মাজারকে ঘিরে কিছু ভক্ত মুরিদান, আছে খাদেম এবং লোকবিশ্বাসে আস্থাশীল কিছু নিরীহ মানুষ। আরও আছে উন্নয়নের নামে শহুরে ভদ্রলোকদের উৎপাত তথা পুঁজির আগ্রাসন। বাংলাদেশের আর দশটি গ্রামে যেমন ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আছে, স্বার্থের বিরোধ আছে, ভূস্বামী ও ভূমিহীনের অসম লড়াই আছে, আছে অলৌকিক শক্তির প্রতি অন্ধবিশ্বাস, মাদারডাঙ্গা তার থেকে ভিন্ন নয়। তবে সেই বিরোধকে আরও উসকে দিয়েছে তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্প। প্রাক-আরম্ভে লেখক বলেছেন, ‘ফকির দরবেশদের নিয়ে অনেক কাহিনি ও গল্প এ দেশে সাধারণ মানুষদের মধ্যে প্রচলিত ছিল এবং সেগুলো এখনো গ্রামের বয়োবৃদ্ধদের মুখে শোনা যায়। সেসব কাহিনির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শহুরে ভদ্দরলোকদের নষ্টামি ভ্রষ্টামি তথা পুঁজির দৌরাত্ম্য। শেষমেশ গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো এ দৌরাত্ম্য মেনে নেয় না।’ শওকত আলীর উপন্যাসে ইতিহাস থাকে, জনজীবনের চিত্র থাকে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষ, যারা কেবল ইতিহাসের দর্শক নয়, নির্মাতাও। এ উপন্যাসের কাহিনি বিন্যস্ত হয়েছে দৌলতালি নামে একজন দরবেশকে কেন্দ্র করে, যিনি গ্রামের নিঃস্ব, অসহায় মানুষের সহায়, গ্রামবাসী যাঁর কথা মানে, যিনি নিজে সংসারবিরাগী হয়েও জগৎ-সংসারকে আপন করে নেন। একসময় মাদারডাঙ্গায় গোড়া সেপাই এসেছিল ব্রিটিশ বেনিয়াদের স্বার্থরক্ষায়, এখন দেশি সেপাই তথা থানা পুলিশ ও প্রশাসন সেই স্থান পূরণ করেছে। উপন্যাসের শুরুতে আমরা আকলিমা নামের এক অসাধারণ ত্যাগী নারীর সাক্ষাৎ পাই, যিনি গভীর জঙ্গলে গিয়ে সোনার মোহর খুঁজে পেতে সাপের কামড়ে মারা যান। দেশীয় গুনিনের চিকিৎসা তাঁকে বাঁচাতে পারেনি। কাহিনির শেষে দেখতে পাই, সাপের দংশনে আহত দৌলতালি বেঁচে যান হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসা নেওয়ায়। আলী আফজাল মাদারডাঙ্গায় গিয়েছেন তাঁর বিরাট কৃষি খামার, পোলট্রি খামার ও মৎস্য খামারসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে, যার পেছনে আছে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা, আছে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের মদদ। আলী আফজাল তাঁর প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য খনন করতে গিয়ে আবিষ্কার করেন মৃত মানষের মুণ্ড, হাড়গোড়। মজুরেরা বিদ্রোহ করে। প্রকল্পে বিরাট ক্ষতির আশঙ্কায় ঠিকাদার তাদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন। সেই মামলার অন্যতম আসামি আব্বাস গজুয়ার। যাঁকে হাবাগোবা যুবক ভাবা হয়। কিন্তু সেই আব্বাস গজুয়া রুখে দাঁড়ান। তিনি দৌলতালিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘না চাচা আমার জিরাইবার সময় নাই। কেহ দুনিয়াতে জিরায় না, আসমানের চাঁদ সুরুজ দেখেন, গাছ বিরিখ দেখেন, ভূইয়ের ফসল দেখেন, কেহ কেহ জিরায় না।…মরনের আগে হামারও জিরান নাই।’ বাংলাদেশের গ্রাম সমাজের রূপান্তর ঘটেছে, সেখানে চাষবাষের জন্য ট্রাক্টর গেছে, আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে গেছে পুঁজি এবং পুঁজির যা ধর্ম, সবলকে আরও সবল এবং দুর্বলকে নিঃস্ব করে। সাধারণ কৃষক তার জমি বিক্রি করে লক্ষ মহাজনের প্রকল্পে বেতনভুক মজুর হচ্ছে। এই যে শহর থেকে গ্রামে পুঁজি যাচ্ছে, সেই পুঁজির সঙ্গে অনাচারও যাচ্ছে, প্রকল্প মালিকের সঙ্গে থানা পুলিশ ও প্রশাসনের লেনদেন হচ্ছে, পুলিশ ভালো মানুষকে দাগী অপরাধী বানাচ্ছে। অন্যান্য উপন্যাসে যেমন, মাদারডাঙ্গার কথায়ও শওকত আলী শ্রেণীবিভাজিত সমাজের মূল দ্বন্দ্বটি তুলে ধরতে ভোলেন না। সেই সঙ্গে পীর-দরবেশদের প্রগতিশীল ভূমিকা, বিশেষ করে সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখে তাদের একাত্ম হওয়ার বিষয়টিও এখানে উত্থাপিত হয়েছে বিশ্বস্ততার সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত আব্বাস বা দৌলতালি আপস করেন না। এর বাইরে সুজাত আলী মুন্সী, রাজু, শম্ভুনাথ, বাটু বেলাল, ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, হাসেম চৌধুরী—সবাই আমাদের চেনাজানা জগতের মানুষ। মাদারডাঙ্গার কথা আসলে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রামের কাহিনি। লেখককে অভিনন্দন।