User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
পিয়াস মজিদের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ মারবেল ফলের মওসুম-এর বিভাব কবিতায় কথিত ঋতুহীন মারবেল ফল স্বপ্নপ্রসূ। আবার সে স্বপ্ন অলীকও নয়। আর তা এজন্যে যে, স্বপ্নও মানুষের জীবনবাস্তবতারই অবচেতন স্বর-যা কিনা একজন প্রকৃত কবির চেতনায় একেবারে জীবন্ত হয়ে ওঠে। জীবনানন্দ দাশ ‘স্বপ্নের হাতে’ ধরা দিয়ে অনুভব করেছিলেন : ‘পৃথিবীর যত ব্যথা-বিরোধ-বাস্তব হৃদয় ভুলিয়া যায় সব! চাহিয়াছে অন্তর যে-ভাষা যেই ইচ্ছা,-যেই ভালবাসা খুঁজিয়াছি পৃথিবীর পারে পারে গিয়া, -স্বপ্নে তাহা সত্য হয়ে উঠেছে ফলিয়া!’ আবার তিনি আমাদের স্বপ্নের হাতে ধরা দেবার আহ্বান জানিয়েছিলেন এভাবে : ‘মরমের যত তৃষ্ণা আছে, তারি খোঁজে ছায়া আর স্বপ্নের কাছে তোমরা চলিয়া আস, -তোমরা চলিয়া আস সব।’ বাংলাদেশের সাম্প্রতিকতম কবিতার পাঠকও যেন এই কাব্যগ্রন্থে ওই একই আহ্বান শুনতে পান ‘মরমের তৃষ্ণা’ কাতর এক নবীন কবি পিয়াস মজিদের কাছ থেকে। বইটির প্রথম কবিতা ‘কবি’-তে পিয়াস নির্মাণ করেন এক কৌতূহলী কবিসত্ত্বাকে, যে-কিনা অক্ষরের বদলে ফুলের স্বর শুনে গন্ধভাষায় জরিপ করে স্বপ্ন-নক্ষত্রের দ্বারা নিহত হওয়া সত্ত্বেও সে মোমের আলোক জ্বালাতে সচেষ্ট শবের উপকূলে। এখানে আমাদের ফের মনে পড়তে পারে জীবনানন্দের কথা-তাঁর লিখে যাওয়া সেই চূর্ণবাদী সমুদ্রে ভাসমান অনুসন্ধানী নাবিক-আত্মার কথা। ঠিক সেভাবেই পিয়াসের এই কবিতাও হয়ে ওঠে সন্ধানী মানবজাতির প্রতীক খোঁজার বয়ান, তমসা-মিনারের চাইতে উঁচু আধাঁর-ঘেঁষা অসম্ভব চুম্বনের নিশানা – ফলত সেখানে ওই কবিসত্ত্বার কাছে যুক্তাক্ষরময় পৃথিবীতে চিরকেলে অনির্ণেয় তুমি সর্বনামই একমাত্র সোজাসাপ্টা ব্যথা হয়ে ধরা দেয়(অবশ্য সেই অধরা অনুভূতিকে শব্দমালার ভেতরে ধরবার কাজ তো কষ্টেরই বৈকি, তবুও সেটা কবি করে যাচ্ছেন ক্রমাগত!)। এরপর আমরা দেখতে পাবো, মারবেল ফলের মওসুম-এ ‘তুমি’ সর্বনামই বারবার হাজির হচ্ছে-কবিতার পর কবিতার আয়না ভাঙতে ভাঙতে সে আসছে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিমায়, অন্য অবয়বে। নতুন প্রতীকে তার সৃষ্টিও হচ্ছে অন্যরকমভাবে। তুমির দিকে ফিরে ফিরে সেই কবিসত্তার মেধাভস্ম কখনো গিলেটিনে বসন্তবলি হয়, কখনোবা স্রেফ পুড়তেই থাকে: ‘তোমার পায়ের পথে একজন; রোদে পুড়ে খাক হওয়া করুণ মল্লার।’(বিধুর/পৃষ্ঠা ২২) এভাবেই ক্রমে ক্রমে মারবেল ফলের মওসুম-এ সৃষ্টি হয় বাংলা কবিতার এক স্বতন্ত্র জগৎ। যেখানে আবেগ-অনুভূতির স্রোতের তোড়ে তৈরি হয় অবিমিশ্র বিষাদের সূক্ষ্ণ পরাবাস্তব শিল্পকলা, ফিনফিনে সুতোর মতোই যার বিস্তার, যাকে পড়তে হয় পলাশ আর শিমুলভাষায়: ‘যখন আমার ভেতর কিছু সমুদ্রবীথি ও অনন্ত শ্মশান। শেষ বিকেলের যত ছায়াছন্দ জলের অতলে যেতে থেমে যায় মৎস্যসরণিতে। আমাকে বধির করে বাগিচায় জন্ম নেয় সহস্র শিমুল আর পলাশভাষা।’(‘শিল্পকলা’/পৃষ্ঠা ১২) বস্তুত, কবির এই নিজস্ব পৃথিবীতে অবগাহনের শব্দই এখানে তৈরি করে অন্যরকম ভাবনা, কবির সেইসব ভাবনায় ভ্রমণের উৎসুক্যই প্রসারিত হয়ে চলে গোটা কাব্য জুড়ে। রাত্রির নিদ্রিত ঝরোকায় তিনি জেগে উঠতে চান কোনো সময়, আবার হয়তোবা তলিয়ে যেতে চান কালো গোলাপের ঝাপটায়-অপুষ্পক উদ্ভিদের ছায়ায়। কবির এই ভ্রমণে রক্তমাখা হাহাকার ও আঘাতের ভ্রম- দুটোই লভ্য। কিন্তু তাতে অনবদ্য আলোকায়নের তৃপ্তিও কম পান না তিনি : ‘আমি যতই যেতে চাই অন্ধকারের দিকে চারদিকে ততই তারাদের আজন্ম প্রহরা। আর কে যেন সন্ধ্যার শান্ত গান ছেনে শিল্পহারা পিয়াসের জন্যে তুলে রাখে রক্তিম রাগমালা। আমি; বাস্তব ও স্বপ্নে মার খাওয়া মানুষ ওই প্রভা এবং সুরশক্তির পায়ে উপচার হিসেবে ঢলের মতো ঢেলে দিতে পারি আমার একবিন্দু অশ্রুকুমকুম।’(‘পারমিতা’/ পৃষ্ঠা ৩০) তবে মারবেল ফলের মওসুম-কে স্রেফ পরাবাস্তবতা আর কল্পনার কাব্য বলাটা ভুল হবে। পরাবাস্তবতার ভেতরেও যে ব্যক্তিগত বিষাদ বা দৈনন্দিন হতাশা পরতে পরতে জমে থাকে; সেটাকেও পিয়াস খুব সহজাতভাবে প্রকাশ করেন তাঁর কবিতায়। আমাদের সময়ের অন্তর্গত নাগরিক শোক-বাসনা-ব্যসন এবং রাজনৈতিক ক্রোধ-বিক্ষোভও এখানে চলে আসে, সোজাসাপটা কাব্যিক ভঙ্গিমায় : ‘একদিন ওয়ান ইলেভেন। আরেকদিন চাকমা বান্ধবীর গোপান বিষাদ। সকালে কালো কফি। সারারাত জৈবিক ভূগোল জাগরণে বিভাবরী পায়ে ভূমিহীনতা।’ (‘জীবনযাপন’/ পৃষ্ঠা ৪৮) আবার আদ্যের গম্ভীরা গানে যেভাবে মহাদেবের ওপর পৃথিবীর যাবতীয় অসংগতি নিয়ে বিদ্রূপ-বাণ ছেড়ে দিত গাইয়েরা – ‘গম্ভীরা ২০১০’ কবিতায় সেই ঐতিহ্যের মতো করেই, ধারালো ভঙ্গিতে পিয়াস যেন যান্ত্রিক সভ্যতার সমস্ত মানবিক-সজীব অনুভূতিকে গ্রাস করার অসুস্থ প্রবণতাকে খানিকটা অপদস্ত করে ছাড়েন : ‘আর তুমি পেনড্রাইভে ভরে ফেলছ এমনকি সন্ধ্যার সমস্ত মাধুরী।’(পৃষ্ঠা ৩৯) লক্ষণীয়, পিয়াস মজিদের এই কাব্যগ্রন্থে অনেক সময় এভাবে বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতির সংশ্লেষের সাথে একই সমতলে মিশে গিয়েছে বৈশ্বিক অন্তর্জালের সংকেতধর্মী ঠিকানা। তাই বলে তা দুর্বোধ্য নয়। পিয়াস মজিদের কাব্যভাষা এখানেই গতানুগতিকের মোড়ক ছেড়ে এক ব্যতিক্রমী রূপ নেয়। তিনি বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হন-তাঁর কবিতা অন্যধাঁচের, তাঁর অনুভূতির ডানা ভিন্ন গড়নের : ‘পায় না সবাই প্রেতসংকেত। ওরা যত পরিলিপ্ত। আমি মায়ের জঠর থেকে সরাসরি ক্ষুধার ভেলায় চড়ে, অরূপের রেখা ধরে এসেছি এই দাবদাহকূলে। ওগো অস্তমিত প্রেম, শোনো- দক্ষিণে জখমি ঝরনার গান, চুম্বনঝরোকার রেশমি বিলাপ। তোমার প্রবেশ তোরণ ঘুমিয়ে গেলে আমি মরবো কোথায়?’(হিন্দোল/পৃষ্ঠা ৪৩) প্রেম সরাসরি পিয়াসের কবিতায় আসে না সবসময়, সেও ইঙ্গিতে ধরা দেয়। যেখানে তিনি কারো অসম্ভব কালো নূপুর কিংবা আসন্ন ভোরে রূপান্তরিত হন। অতঃপর প্রেম প্রসঙ্গে কবির অভিজ্ঞান দাঁড়ায় এই: ‘তুমি শুনতে শুনতে মলিন হওয়া গান। আমি এক জনমের মঞ্চক্লান্ত নীল নটরাজ। আসলে জানকী শুষে নেয় তারাহারা দিগন্তের গাঢ় অভিসার।’(‘অভিজ্ঞান’/পৃষ্ঠা ৪৪) গ্রন্থের শেষ কবিতাটির শিরোনাম ‘গ্রীনরোডে’। কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ স্মরণে লেখা বলেই হয়তো কবিতাটি তাৎপর্যের দিক হতে একটু বেশিই মূল্যায়ন দাবী করে আমাদের কাছ থেকে: ‘স্মৃতি থেকে আমি দিব্যি মনে করতে পারি অমরতার জন্যে একমাত্র মৃত্যুই আশ্রয় নিয়েছিল তার নিঃসঙ্গ কাননে।’(পৃষ্ঠা ৫৫) এক্ষেত্রে বলতে পারি, পিয়াস মজিদের কবিতাও এই অমর মৃত্যুর কাননের সাথে পরিচিত। যেখানে দ্রোহ বারবার আহত হয়, হৃদয় হয় ছুরিচিকিৎসার শিকার, বোধ দিয়ে ঝরে রক্ত-কিন্তু সেখানে কবিতার মৃত্যু হয় না। পিয়াসের কবিতা সেই কাননের বাসিন্দা হয়ে সমকালকে জড়িয়ে ধরে সাবলীলভাবে ক্রমশ মহাকালের পথে এগোতে থাকে । এই কবিতার বইয়ে তেমনভাবে কোনো ছন্দের ব্যবহার নজরে পড়বে না পাঠকের। কবি হয়তো ইচ্ছা করেই এখানে ছন্দের প্রথাগত গণ্ডীতে বাঁধেননি কবিতাগুলোকে। তা সত্ত্বেও নিবিড় পাঠের মাধ্যমে বোঝা যায়, পিয়াসের কবিতার ভেতর একটা অন্তর্গত ছন্দ আছে- অর্কেস্ট্রা বা রাগসংগীতের অনায়াস চলনের মেজাজ যেন। তা অতি সূক্ষ্ণ বুননের মতোই কবিতার ভেতর নিবিড়ভাবে লুকিয়ে থাকে। পিয়াস মজিদের কবিতায় পাঠক হয়তো কোনো নির্দিষ্ট চিত্রকল্প বা সীমাবদ্ধ দৃশ্য খুঁজে পাবেন না। তবে সেখানে মিলবে এক অন্যরকম ধ্যানী কাব্যভাষা, যেখানে বাঁধাধরা রূপকল্পে নয় বরং সংগীতের সুরের মতো তাঁর অন্তর্গত বোধ কবিতা-পাঠকের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। কবি এক্ষেত্রে খানিকটা স্বল্পবাকই, মৌনী – হট্টগোলের ভেতর ক্রমাগত চুরমার হতে থাকা পৃথিবীকে তিনি দেখেন নৈঃশব্দ্যের আড়াল দিয়ে। প্রচলিত প্রক্রিয়ায় শব্দকে অতিরিক্ত ও অতি রিক্ত-ভাবে ব্যবহার করবার বদলে নৈঃশব্দ্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রত্নভাষাকে রচনা করে চলেন সযত্নে-সুতীক্ষ্ণভাবে । নৈঃশব্দ্যের মধ্য দিয়ে রহস্যের পাঠোদ্ধারেও তাঁর দক্ষতা নজর কাড়বার মতো। মালার্মে বলেছিলেন একটি বস্তুকে নির্বাচন করে তার ভেতর থেকে একটি মুডকে খুঁজে নিয়ে তা থেকে স্বতন্ত্র কোনো সংকেত উদ্ধার করবার কথা। সেই প্রচেষ্টাও পিয়াস চালিয়েছেন এ কাব্যগ্রন্থে, অত্যন্ত দক্ষতা ও সৃষ্টিশীলতার সাথে। স্বল্প শব্দের হলেও তাঁর কবিতার আমেজ ও প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী। উদাহরণ হিসেবে ‘সুরভি’ কবিতাটির কথাই ধরা যাক : ‘আমার মৃত্যুমুহূর্তের উপর কে যেন জাফরান ছিটিয়ে যায়।’(পৃষ্ঠা ৩২) এখানে কবিতাটির শরীর তেমন দীর্ঘকায় না হলেও অল্প শব্দেই কবির দক্ষতা ও অন্যরকম শৈলী প্রয়োগের জোরে একটা চিরস্থায়ী রেশ রেখে যায়। যা অনেকটা সেই জাফরানের সুগন্ধের মতোই প্রচণ্ড উপভোগ্য এবং সে বিধ্বস্ত ঘ্রাণ আমাদের চেতনার মর্মমূলে গিয়ে নাড়া দেয় । আবার ‘দৃশ্য’ কবিতাটি এক ধরণের সময়-বলয় তৈরি করে ফেলে স্বল্প অক্ষরেই : ‘একটা নদী আমাকে দ্বিধাবিভক্ত করে তিনটা শেয়াল সেটা দেখে এবং ঘড়িতে তখন রাত দেড়টা।’(পৃষ্ঠা ৩৩) প্রসঙ্গত বলা চলে, শঙ্খ ঘোষ তাঁর কবিতায় যখন লিখে চলেছেন চুপ করার ও শব্দহীন হবার কথা, তখন অনেকে আপত্তি করলেও সেই হিরণ্ময় পঙক্তিগুলোর ভেতরেই একজন সতীর্থ দেখতে পেয়েছিলেন ব্যাপ্তির দিশা- আমাদের মতে ওই একই কথা পিয়াস মজিদের মারবেল ফলের মওসুম-এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এখানে শব্দের বদলে নৈঃশব্দ্য, অধিক কথার বদলে স্বল্পতার সংকেত পাঠকের অনুভূতির অ্যান্টেনাকে ঘুরিয়ে দেয় নতুন কাব্যঘ্রাণের দিকে, এক অন্য ধরণের স্বাপ্নিক অথচ অনুপেৰণীয় কবিতার জগতের দিকে। গ্রিক পুরাণে দেবী ভেনাস বিশ্বসংসারের সবকিছুকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন-সব বিপ্রতীপতা সেখানে মিলে গিয়েছিল-সমগ্র মিশে গিয়েছিল অংশে, অংশ সমগ্রে। সমস্তকিছুকে তিনি করে তুলেছিলেন এককের অংশ। ব্যাপারটা মারবেল ফলের মওসুম বইটির ক্ষেত্রেও খাটে। এ কাব্যগ্রন্থে সবকিছুই এককের অংশ, পরস্পরের সাথে এমনভাবে যাবতীয় বিষয়াদি মিশে গিয়েছে যে ফলত সেখানে প্রকৃতপক্ষে একটি কাব্যই রয়েছে। যার ইশারাটা আমরা পেলাম মাত্র । বাকি উহ্য অংশটা ‘অধরা মাধুরী’ হয়ে প্রকাশিত সমগ্রের সাথে একাকার হয়ে আছে। সেটা পাঠক খুঁজে নেবেন অবশেষে, নিজের মতো করে।