User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
১৯৩৬ সালে প্রকাশিত পুতুল নাচের ইতিকথা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা একটি অতি সুপরিচিত উপন্যাস। অনেকটা নাস্তিকতূল্য চরিত্র গ্রামের ডাক্তার শশী এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। তিনি ঈশ্বরের বিশ্বাস করে না।গ্রামের পটভূমিতে শশী, শশীর পিতা, কুসুম-সহ অন্যান্য চরিত্রগুলোর মাঝে বিদ্যমান জটিল সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে গড়ে উঠেছে এর কাহিনী ও প্রেক্ষাপট। এই সমাজ সংসারের স্রষ্টার হাতের পুতুল হিসেবে যদি আমরা নিজেকে কল্পনা করে থাকি তাহলে আমাদের পরিণাম ভাগ্য নির্নয় করেন একমাত্র তিনি। কিন্তু সরল চোখে দেখলে মানুষ নিজের কৃতকর্মের দ্বারাই নিজের ভাগ্য ও জীবন কে পুতুল বানিয়ে তাকে নিয়ে ভয়ংকর খেলা খেলে। পরিণামে কেবল বিচ্ছেদ, হতাশা, আর দুঃখে জর্জরিত হয় মানুষের জীবন। নিজের কৃতকর্মের জন্যই কেউ হয় গৃহী কেউ হয় সন্ন্যাসী, কেউবা বেঁচে নেয় দুঃসহ যন্ত্রনার জীবন। উপন্যাসে এ সত্যই উচ্চকিত হয়েছে।বইটির এই সম্পাদনা আমার নিকট অনেক মনোমুগ্ধকর মনে হয়েছে!
Was this review helpful to you?
or
মানিকের অন্যান্য লেখার তুলনায় ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ পড়তে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল আমার।পড়ার জন্য তাগাদা দিয়েছিলেন কাজী স্যার।স্যার প্রায়ই এই বইটির কথা ক্লাসে বলতেন,আর আমার আগে রফিক বইটি পড়ে ফেলেছিল তাই আমিও পড়তে লাগলাম। বইয়ের শুরুটা অভিনব ও চমৎকার- ‘খালের ধারে প্রকাণ্ড বটগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়া হারু ঘোষ দাঁড়াইয়া ছিল। আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন। …স্থানটিতে ওজনের ঝাঁজালো সামুদ্রিক গন্ধ ক্রমে মিলাইয়া আসিল। অদূরের ঝোপটির ভিতর হইতে কেয়ার সুমিষ্ট গন্ধ ছড়াইয়া পড়িতে আরম্ভ করিল। …মরা শালিকের বাচ্চাটিকে মুখে করিয়া সামনে আসিয়া ছপ-ছপ করিয়া পার হইয়া যাওয়ার সময় একটা শিয়াল বার বার মুখ ফিরাইয়া হারুকে দেখিয়া গেল। ওরা টের পায়। কেমন করিয়া টের পায় কে জানে!’ বাংলা সাহিত্যে এমন সূচনার উপন্যাস আর নাই।এমন নির্লিপ্ত করে একটা মৃত্যুঘটনার বর্ণনার মাঝে কোথায় যেন একটু সূক্ষ্ম ব্যাঙ্গ আছে।বিশেষত আকাশের দেবতার কটাক্ষ করার ব্যাপারটা।এরপর একটি মৃত্যুকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন পশু পাখির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এবং সেই বোধটুকুও চমৎকার। সবুজ রঙের সরু লিকলিকে একটি সাপ একটি কেয়াকে পাকে পাকে জড়াইয়া ধরিয়া আচ্ছন্ন হইয়া ছিল এই সাপ স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষকে ভয় পেত,অথচ লোকটি মৃত এই বুঝে সে নির্দ্বিধায় হারুর পায়ের ফাক দিয়ে চলে গেল।এই কথাটা কি এতটা স্বাভাবিক…অন্তত মানিকের লেখায়।এসব ভেবে ভেবে বইটি খুব আকর্ষণ করছিল। উপন্যাসের কাহিনীতে প্রথমে পাওয়া যায় শশীর অস্তিত্ব।গ্রামের নাম গাওদিয়া,সেখানকার সুদী মহাজন গোপালের ছেলে শশী কলকাতা থেকে পাশ করা একমাত্র ডাক্তার।মানিক যুক্তি সহকারে দেখিয়েছেন,শহরের ছাপ লাগা শশী কেন রঙিন শহর ছেড়ে গ্রামে এসে ডাক্তারি করে। সে প্রসঙ্গে বলেছেন,ছাপটা শহরের হলেও সেটা সাময়িক,গ্রামের যে দাগটা শশীর মাঝে গভীর সেটা সহজে মুছে দিতে পারে নি সে রঙিন হাওয়া।আরও একটি কারন যেন সে তার পিতার কাজের প্রায়শ্চিত্ত করা।তার পিতা গোপাল সম্পর্কে তার মনোভাব খুব ভালো না।গোপাল খারাপ লোক,সুদী মহাজন হিসেবে এমনিতেই সে ঘৃণ্য…তার উপর যামিনী কবিরাজের স্ত্রীকে ঘিরে অনেক কানাঘুষা আছে।স্বার্থ ও অর্থ এইদুটোকেই সে বেশী করে চিনেছিল এবং কঠোর শাসনের মাধ্যমে সে এই শিক্ষাটি শশীর মাঝে স্থানান্তর করতে চায়।সে যে খুব একটা বিফল তাও না,কেননা উপন্যাসে আছে, শশীর চরিত্রে দুটি সুস্পষ্ট ভাগ আছে। একদিকে তার মন কল্পনা, ভাবাবেগ আর রসবোধে পূর্ণ, অন্যদিকে সাধারণ সাংসারিক বুদ্ধি ও ধনসম্পত্তির দিকে ঝোঁকও যথেষ্ঠ। তার কল্পনাময় অংশটুকু গোপন ও মূক। বুদ্ধি, সংযম এবং হিসেবি প্রকৃতির পরিচয়টা পায় সাধারণ মানুষ। কিন্তু সেই গোপন ও মূক প্রকৃতির পরিচয়টা পেয়েছিল শুধু কুসুম, রহস্যময়ী কুসুম শশীর চরিত্রের দ্বিতীয় দিকটি স্পষ্টতই তার বাবার নিয়ন্ত্রণের ফলাফল।কিন্তু এখানে আরেকটি ভাগের কথা বলেছে যার পরিচয় পেয়েছিল কুসুম।কুসুম তার বন্ধু পরানের স্ত্রী,হারু ঘোষের পুত্রবধূ।উপন্যাসে কুসুমের সাথে আমাদের পরিচয় পরানের বোন মতিকে দেখতে শশী তাদের বাড়িতে যায়।লেখকের হাতে- ‘হারুর বউ মোক্ষদা হারুর ছেলে পরানের বৌ কুসুমের উপর ভারি খাপ্পা হইয়াছিল।’ কারণ, সন্ধ্যার প্রদীপ জ্বালানোর দেরি। কুসুম ঘাট থেকে ফিরে কলস রেখে কাপড় ছাড়ে। তারপর জ্বালতে যায় দ্বীপ। তেইশ বছরের বাঁজা মেয়ে, গায়ে তাহার জোর কম নহে।’ শোনা গেল : ‘কুসুমকে এ বাড়ির সকলে ভয় করে।’ কারণ, ‘এই বাস্তুভিটাটুকু ছাড়া হারু ঘোষের সর্বস্ব কুসুমের বাবার কাছে বাঁধা আছে আজ সাত বচ্ছর।’ এই কুসুমুই ‘চাঁদ উঠলে, চাঁদ উঠার আভাস দেখলে’ শুনতে পায় : ‘ ভিন্দেশী পুরুষ দেখি চাঁদের মতন লাজরক্ত হইল কন্যা পরথম্ যৌবন। কে সে কিশোরী, ভিনদেশী পুরুষ দেখিয়া যার লজ্জাতুর প্রেম জাগত? সে কুসুম নয়, হে ভগবান, সে কুসুম নয়।’ এই ভিনদেশী পুরুষ হলো শশী।শশীকে কুসুম পাগলের মত ভালোবাসে।শশী সেটা বুঝে,বুঝেও না বোঝার ভান করে,অবহেলা করে,খেলা খেলে।কিন্তু শশী কি ভালোবাসে না কুসুমকে? কুসুমের প্রেম প্রকাশে জড়তা নেই,শশী যেন তাতে বিব্রত হয়।মিথ্যে অসুখ বলে চলে আসে শশীর ঘরে,শশীর সাধের গোলাপ চারাটা আচ্ছা মতো পা দিয়ে পাড়িয়ে আসে…এ যেন সুন্দরের প্রতি কুসুমের রাগ,শশীর প্রতি প্রতিশোধ।শশী ভাবে : ‘কাঁটা ফুটিবার ভয়ও কি নাই কুসুমের মনে?’ তাদের গোপন অভিসার তালতলায়।কুসুম একসময় বলেই বসে সইতে পারি না ছোটবাবু উত্তরে শশীর অবহেলা আমরা ছেলেমানুষ নই। ইচ্ছে হলেই একটা কাজ কি আমরা করতে পারি? বুঝে-সুঝে কাজ করা দরকার। দীর্ঘ নয়টি বছর কুসুম অপেক্ষা করে শশীর জন্যে এমনি চাঁদনী রাতে আপনার সাথে কোথাও চলে যেতে সাধ হয় ছোটবাবু” কিংবা আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শশীর এমন করে কেন ছোটবাবু? শশীর উত্তরটি আমার কাছে কবিতার মত মনে হয় তীব্র বিষাদ আসে। শরীর! শরীর! তোমার মন নাই কুসুম? এখানে কি কেবল শরীর?মন কি সত্যি নাই।কুসুমের মত আর কে বুঝতে পেরেছে শশীকে? কিন্তু দীর্ঘ বছর পর শশীকেই কাঙালের মত ফিরে আসতে হয় কুসুমের কাছে।কিন্তু ততদিনে কুসুম আর নেই।শশীর প্রার্থনা,’আমার সঙ্গে চলে যাবে বৌ?’ উত্তরে কুসুম জানায়,’চলে যাব? কোথায়?’ শশীর কাতর কণ্ঠঃ”যেখানে হোক। যেখানে হোক চলে যাই, চল আজ রাত্রে।” কুসুম ফিরিয়ে দেয় শশীকে,” কেন যাব?…… আপনি বুঝি ভেবেছিলেন যেদিন আপনার সুবিধে হবে ডাকবেন, আমি অমনি সুড়সুড় করে আপনার সঙ্গে চলে যাব? কেউ তা যায়?” শশী বলে,”একদিন কিন্তু যেতে– কুসুম গর্জে উঠে,” স্পষ্ট করে ডাকা দূরে থাক, ইশারা করে ডাকলে ছুটে যেতাম তখন।আজ হাত ধরে টানলে ও আমি যাব না।কেন যাব?লাল টকটক করে তাতানো লোহা ফেলে রাখলে তাও আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়ে যায়, যায় না? সাধ-আহ্লাদ আমার কিছু নেই নিজের জন্যে কোনও সুখ চাই না,বাকি জীবনটা ঘরের লোকের সেবা করে কাটিয়ে দেব ভেবেছি।আর কোনো আশা নেই, ইচ্ছে নেই। সব ভোঁতা হয়ে গেছে ছোটবাবু। লোকের মুখে মন ভেঙে যাবার কথা শুনতাম; অ্যাদ্দিনে বুঝতে পেরেছি, সেটা কী। কাকে ডাকছেন ছোটবাবু, কে যাবে আপনার সঙ্গে? কুসুম কি বেঁচে আছে? সে মরে গেছে। এইটুকু পড়তে আমার বুক ভেঙে যায়।কার জন্য দুঃখ?শশী?শশী তো উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে।কুসুমের জন্য খারাপ লাগে,কষ্ট হয় না।কষ্ট হয় নিজের জন্য,স্রেফ নিজের জন্য।আমার সহস্র অবহেলার জন্য।আমি কি কাউকে অবহেলা করি নি? এরপর কুসুম চলে যায় গাওদিয়া গ্রাম ছেড়ে।শশীকে একলা করে দিয়ে।এদিকে পিতা গোপালের সাথে শশীড় আদর্শিক দ্বন্দ তুঙ্গে।শশী ঠিক করে সেও শহরে চলে যাবে।তাকে আটকায় গোপাল।গোপালের এত সম্পত্তি বিত্ত সে তো সব শশীর জন্য।তাই সে নিজে বের হয় পথে।আর নিজের সবকিছু পাহারায় রেখে যায় শশীকে।শশীও আটকা পড়ে যায়। উপন্যাসের কুমুদ শশীর বন্ধু,সে বিয়ে করে পরানের সহজ সরল বোন মতিকে।কুমুদ শশীকে শহর চিনিয়েছিল,জীবন চিনিয়েছিল।শশীর যে আধুনিকতা,সবটাই কুমুদের দান।কুমুদ প্রতিভাবান,কিন্তু ছিন্নছাটা,সে সত্যিই মতির সরলতা ভালোবাসে।তাদের নিয়ে উপন্যাসের অনেক অংশ জুড়ে আছে।কিন্তু এক জায়গায় লেখক সেটা থামিয়ে দেন।এ নিয়ে মানিক এই উপন্যাসের সেকেন্ড পার্টে লিখবেন বলেছিলেন।কিন্তু সে উপন্যাস আর শুরু করা হয় নি। উপন্যাসের শেষটা আমাকে খুব টানে।সেই যে “টিলার উপর দাড়াইয়া সুর্যাস্ত দেখিবার সুযোগ শশীর জীবনে আর আসিবে না।”শশী যেন আটকা পড়ে গেছে যক্ষের মত,উত্তরাধিকারের মত তাকে পালন করতে হবে তার বাবার দায়িত্ব।সেখানে ভালোবাসার সুযোগ কী আসবে তার জীবনে।কুসুমের মত ভালো কি আর কেউ তাকে বাসতে পারবে? বুকের ভেতর একটা মোচড় দিয়ে উঠে।কোথায় যেন একটা খাঁ খাঁ।এ কেবল অনুভব করা যায়।কষ্ট হয় উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রের জন্য।এভাবেই পড়ে থাকে তালতলা,টিলা…গাওদিয়া!শূণ্য,সবকিছু শূণ্য।