User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
This is one of the 10 books every human being should read in their lifetime.
Was this review helpful to you?
or
একজন মা যখন বলেন "দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা, তুই যুদ্ধে যা।" তখন সেই মায়ের প্রতি পাঠক হিসেবে কেমন অনুভূতি হতে পারে? দেশ-মাতৃকার প্রতি তাঁর আত্মনিবেদনের এই মহিমা ভাষায় প্রকাশ করা কী আদৌও সম্ভব? নাহ্, সে ব্যর্থ চেষ্টায় যাবার দুঃসাহস আমার নেই। এমন মা এবং তাঁর সন্তানের জন্য গর্ববোধে আক্রান্ত হতে পারি কেবল। তাঁর এই উৎসর্গের স্মরণের বেদীতে দু'ফোটা সশ্রদ্ধ অশ্রু রেখে দেয়া ছাড়া অসহায় পাঠক যেন বুঝে ওঠতে ব্যর্থ হয় ঠিক কিভাবে এই অবাক ইতিহাসের আখ্যানটিকে সম্মান জানানো যায়! এমন অনেক অনেক আত্ম উৎসর্গের হাত ধরে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা। কত মা যে তাঁর সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন, তার সবটুকু লেখা নেই সেভাবে। কিন্তু আমরা জানি, আমাদের আত্মার অংশ সবুজের বুকের লাল অংশটুকু কত কত বুকের রক্তে লাল হয়েছে। কত লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া সে পতাকা, স্বাধীনতা। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর আশ্চর্য নির্মোহ লেখনী দিয়ে লিখে গেছেন ১৯৭১ এর সেই উত্তাল দিনের ঘটনাচক্র। তাঁর শোক, তাঁর কষ্টের হাহাকারকে শব্দের আড়ালে রেখেই তিনি লিখে গেছেন দিনপুঞ্জীর মত এই অনন্য সাধারণ বইটি, যার নাম "একাত্তরের দিনগুলি"। যে সন্তানকে তিনি দেশ মাতৃকার জন্য উৎসর্গ করেন, তাঁর নাম শহীদ শাফি ইমাম রুমী। কী প্রখর সম্ভাবনাময় এক তরুণ ছিলেন রুমী। যাঁর পড়তে আসবার কথা ছিল ইলিনয় ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে। কিন্তু দেশে তখন যুদ্ধের ডামাডোল শুরু হয়ে গেছে। স্বার্থপরের মত রুমী পালিয়ে না গিয়ে যুদ্ধে যাবার জন্য তৈরি হন....বাকিটা তো ইতিহাস। সে ইতিহাসের ধারাবাহিক এক নিবিড় প্রামান্য দলিল "একাত্তরের দিনগুলি।" এই বই বার বার পড়া যায়। আবারও পড়বো নিশ্চয়ই!
Was this review helpful to you?
or
ভালো ছিলে।
Was this review helpful to you?
or
একাত্তরের দিনগুলি' মূলত যুদ্ধের হাওয়া লাগা সময়ে জাহানারা ইমামের পারিবারিক দিনলিপি হিসেবে উল্লেখ করা যায়।ডাইরীতে আমরা যেরকম লিখে থাকি,দিন/তারিখ উল্লেখ করে। কিন্তু 'একাত্তরের দিনগুলি' কি শুধুমাত্র একটি সময়ের পারিবারিক দিনলিপি? আমার মনে হয়, না।'একাত্তরের দিনগুলি' পারিবারিক দিনলিপি ছাড়িয়ে দেশ,কাল,সমাজ সংগ্রাম ও একটি গর্বিত উপাখ্যানের অংশ হয়ে গেছে।
Was this review helpful to you?
or
জাহানারা ইমাম রচিত "একাত্তরের দিনগুলি" বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ। বইটি তাঁর ব্যক্তিগত দিনলিপি আকারে লেখা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে এবং সেই সময়ের সার্বিক পরিস্থিতি জানতে হলে "একাত্তরের দিনগুলি" বইটি সবার পড়া উচিত। আমার মতে, বইটি একটি ঐতিহাসিক দলিল।
Was this review helpful to you?
or
#রকমারি_রিভিউ_প্রতিযোগ_জুন ১৯৭১ সালের প্রতিটি দিনে লেখিকার জীবনের এবং তার দেখা ঘটনা গুলোর স্মৃতিচারনে একটি বই, "একাত্তরের দিনগুলি"। মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কেও একটি সম্যক ধারনা অর্জন করা সম্ভব, শহীদ গেরিলা শাফী ইমাম রুমির মাতা জাহানার ইমামের এই বইটি থেকে। ১৯৭১ সালে বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সাথে জাহানারা ইমাম একাত্নতা প্রকাশ করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মৃত্যু,দুঃস্বপ্নভরা বিভীষিকার মধ্যে তার ত্যাগ ও সতর্ক সক্রিয়তা দেশপ্রেমের সর্বোচ্চ উদাহরণ হয়ে আছে। শহীদ রুমির মা পরিণত হন শহীদ জননী তে। মুক্তিযুদ্ধে সন্তান বিয়োগের বেদনাবিধুর মাতৃহৃদয় এবং যাতনা মুর্ত হয়েছে তাকে কেন্দ্র করে। *কাহিনী সংক্ষেপেঃ বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলন প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ঢাকার কবি সাহিত্যকরা।এই কমিটি গঠনের আগে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়।বিভিন্ন মিছিল চলতে থাকে একাডেমির প্রাঙ্গণে। সেখানে অংশগ্রহণ করে দেশের বরেণ্য ব্যাক্তিত্ব, তাদের মধ্যে কিছু হলেন- শামসুর রাহমান, আহমেদ শরীফ, সিকান্দার আবু জাফর,আব্দুল গাফফার চৌধুরী, জহির রায়হান, সুফিয়া কামাল ইত্যাদি ব্যাক্তি। একাত্তরের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র ও অপ্রস্তুত দেশবাসীর ওপর নজিরবিহীন বর্বরোচিত হামলা শুরু করার পর অসহায় বাঙালি সেই হামলার প্রথম ধাক্কা সামলে যেভাবে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে এবং ক্রমশ তা বাংলার মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামে পরিণত হয় এবং দেশের অধিকাংশ মানুষই এতে কোন-না-কোনভাবে অংশগ্রহণ করে — সেই ইতিহাসের একটি স্বচ্ছ চিত্র,জাহানারা ইমাম এই পুস্তকে তাঁর ব্যক্তিগত দিনলিপির মাধ্যমে বিশ্বস্ততার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন।১৯৭১ সালের দীর্ঘ মাসগুলোতে বাঙালিদের আশা — নিরাশা — যন্ত্রণাকে সজীব করে তুলেছে এই গ্রন্থ এবং যে পরীক্ষার তাঁরা সম্মুখীন হয়েছেন ও যে ত্যাগ তাঁরা স্বীকার করেছেন, সেগুলোর গভীরে দৃষ্টি ফেলতে আমাদের সাহায্য করেছে। ছেলেরা ঘরে বসে গেরিলা পরিকল্পনা করছে আম্মা তাদের জন্য চা-নাশতার ব্যবস্থা করছেন। নিজের ছেলে জীবন হাতে নিয়ে যুদ্ধ করছে তার মা তাকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। মাতৃস্নেহের চেয়ে দেশপ্রেমকে বড় চোখে দেখে, এমন দেশপ্রেমিক দৃঢ়চেতা একজন নারী শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।এমনকি তৎকালীন রাষ্ট্রপতির সাধারন ক্ষমার আওতায় ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ থাকার পরেও এই মা তার ছেলের জন্য ক্ষমা চাননি পাকিস্তানী হানাদার শাসকগোষ্ঠির কাছে, কারন তাতে তার ছেলের অসম্মান হয়। ছেলে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গেছে তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে গেরিলা পুত্রের মাথা নিচু করেননি জাহানারা ইমাম। জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটি খুব সাধারণ এক গল্পের অসাধারণ আখ্যান হয়ে উঠার কাহিনী,এক সাধারণ বাঙালি নারীর ব্যক্তিগত ডায়েরীর, বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় দলিল হয়ে উঠার গল্প, এটি জাহানারা ইমামের একজন সাধারণ মা থেকে শহীদ জননী হয়ে উঠার দিনলিপি। "একাত্তরের দিনগুলি" বইটিতে জাহানারা ইমাম মায়ের মমতা নিয়ে, বাঙালি নারীর শাশ্বত মহিমা নিয়ে, দেশপ্রেমিকের ভালোবাসা নিয়ে একাত্তরের দিনগুলোর গল্প আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। "একাত্তরের দিনগুলি" বইটি ডায়েরীর আদলে লেখা। এখানে পরিচ্ছেদের প্রথমেই বিভিন্ন দিনের তারিখ দেয়া এবং নিচে সেই দিনের ঘটনাপ্রবাহ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ডায়েরীর তারিখ শুরু হয়েছে মার্চের প্রথম দিক থেকেই আর শেষ হয়েছে ডিসেম্বরের একদম শেষে গিয়ে। এর মাঝে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রায় সব বড় ঘটনাই দিন অনুযায়ী অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উঠে এসেছে। ডায়েরীতে যেমন ৭ মার্চের শেখ মুজিবর রহমানের রেসকোর্স ময়দানের ভাষণের কথা বলা হয়েছে, তেমনি ভাষণ পরবর্তী মার্চের দিনগুলোতে কীভাবে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন অশুভ আশঙ্কা ঘনীভূত হয়েছিলো সেই গল্পও একান্তভাবে উঠে এসেছে। তারপর ২৫শে মার্চের কাল রাতের বর্ণনা বেশ বিস্তৃতভাবে এসেছে। জাহানারা ইমাম বিভিন্ন জনের কাছে থেকে ২৫ মার্চ রাতের যে সব ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা শুনেছিলেন সে সবও তিনি "একাত্তরের ডায়েরী" বইটিতে লিপিবদ্ধ করেছেন। তাই সে রাতের নৃশংসতার প্রায় সব দিকই এখানে উঠে এসেছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের হত্যাকাণ্ড, পুরান ঢাকার হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে সদরঘাট,লঞ্চ, টার্মিনালের হত্যাকাণ্ডের বীভৎসতার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ছোঁয়াও পাওয়া যাবে এই বইয়ে। তার পরপরই চলে আসে এই ডায়েরীর মূল আলোকপাত যেই ব্যাপারে, সেই রুমীর কথা। রুমী জাহানারা ইমামের বড় ছেলে। অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন এবং মেধাবী ছেলে সে। যুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানী অত্যাচারী শাসকদের প্রতি সে তীব্র ঘৃণা অনুভব করতো। তারপর যুদ্ধ যখন শুরু হল তখন পরিচিত ঢাকাকে এই ভয়ানক তাণ্ডবলীলায় বিপর্যস্ত হতে দেখে, চেনা মানুষগুলোকে নরপশুদের হাতে খুন হতে দেখে রুমী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলো না। অবশেষে তার যুদ্ধে যাবার সুযোগ এসে গেল। সে বন্ধুদের মাধ্যমে একদিন ট্রেনিংয়ে যাবার সুযোগ পেল। কিন্তু রুমী মাকে না জানিয়ে কোন কিছু করার ছেলে না। তাই সে মায়ের কাছে আসলো যুদ্ধে যাবার অনুমতি নিতে। আর জাহানারা ইমাম পড়লেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি। একদিকে দেশের প্রতি দায়, অন্যদিকে মায়ের ভালোবাসা। শেষ পর্যন্ত জাহানারা ইমামের বিবেকবোধ জয়ী হল, দেশপ্রেম জয়ী হল। তারপর রুমীদের মেলাঘরে ট্রেনিং নেয়া, ঢাকার মধ্যে করা দুঃসাহসী অপারেশনের গল্প আর একদিন অসতর্কতার কারণে হানাদারদের হাতে ধরা পড়ে যাওয়া সবই এই বইয়ে বিস্তৃতভাবে উঠে এসেছে। অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বরে বিজয় আসে। কিন্তু রুমী আর ফিরে আসে না। তাছাড়া ১৪ই ডিসেম্বর গভীর রাতে জাহানারা ইমামের স্বামীও না ফেরার দেশে চলে যান সবাইকে রেখে। যে কোন মহান আখ্যানের মত এই দুঃখবোধ সাথে নিয়েই ডায়েরীটি শেষ হয়। যে সব পাঠক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ব্যাপারে জানতে আগ্রহী, কিন্তু শুধু শুধু খটমটে ইতিহাস পড়তে যাদের অনীহা তাদের জন্যে জাহানারা ইমামের "একাত্তরের দিনগুলি" একটি অবশ্যপাঠ্য বই। এখানে দিনলিপির ছলে গভীর মমতায় যুদ্ধদিনের কথাগুলো দক্ষ শিল্পীর কলমের আঁচড়ে উঠে এসেছে। *গুরুত্বপূর্ন চরিত্র বিশ্লেষণঃ জাহানারা ইমামঃউনি লেখিকা হলেও মুল চরিত্র বিশ্লেষণে ওনার ভুমিকা অপরিসীম। ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, তিনি দেখছেন। কিন্তু দেখছেন দূর থেকে। যদিও এই গল্প একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত গল্প। জননীর তীব্র শোক ও বেদনার গল্প। নিজের গল্প দূর থেকে দেখতে পারেন তাঁরাই, যাঁরা বড় শিল্পী। গভীর আবেগকে সংযত করবার জন্য প্রযোজন হয় একটি পাষাণ হৃদয়ের। সত্যিকার শিল্পীদের হৃদয় হয় পাথরের, নয়ত এত দুঃখকে তাঁরা কোথায় ধারণ করবেন? জাহানারা ইমাম হৃদয়কে পাথর করে লিখলেন তাঁর ডায়রি। কী অসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গেই না তাঁর গল্প বলে গেছেন। সেই গল্প তাঁর একার থাকেনি। কোন এক অলৌকিক উপায়ে হয়ে গেছে আমাদের সবার গল্প। 'মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়' — এই অমর উক্তির মর্মার্থ সামনে রেখে আমরা স্মরণ করতে পারি এক বাঙালি নারী, গৃহবধূ, লেখিকা এবং লড়াকু জননী জাহানারা ইমামকে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে এক জাহানারা ইমাম মুক্তিযুদ্ধ পক্ষের মানুষের কাছে হয়ে ওঠেন প্রেরণা ও আস্থার ধ্রুবলোক। তাঁর মধ্য দিয়ে সব অপূর্ণতা পূর্ণ, খন্ড অখন্ডের সঙ্গতি পেয়ে থাকে; আর তিনি জীবনবেদ থেকে উৎসারিত জায়মান চেতনা ছড়িয়ে দেন দুঃসময়ে অসহায় মানবাত্মার সম্পূর্ণ মুক্তির উদ্দেশ্যে। শরীফ ইমামঃ জাহানারা ইমামের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা "একাত্তরের দিনগুলি"-তে প্রকাশ পেয়েছে স্বামী শরীফ ইমামের দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধে অবদান, প্রখর ব্যক্তিত্ব, নির্ভীক মানসিকতা, মুক্তিযোদ্ধা পুত্র শহীদ রুমীর জন্য তীব্র ভালোবাসা।জাহানারা ইমাম তাঁর স্মৃতিকথায় স্পষ্ট তুলে ধরেছেন শরীফ ইমামের স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা প্রদানের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার বিষয়গুলো। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চলাচল ব্যাহত করার উদ্দেশ্যে ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ তাঁর কাছে বাংলাদেশের ব্রিজ ও কালভার্টের তালিকা চেয়ে পাঠান। সারা দেশের সবগুলো ব্রিজ আর কালভার্টের তালিকা তৈরি করা সহজসাধ্য ছিল না। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তাঁকে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করতে হয়েছিল। রোডস অ্যান্ড হাইওয়েজের ডিজাইন ডিভিশনে অবাঙালি এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার কর্মরত থাকায় সেখান থেকে ব্রিজের ফাইলগুলো বের করে আনা ছিল অত্যন্ত দুরূহ কাজ। সুকৌশলে ফাইলগুলো সরানোর পর শরীফ ইমাম একপ্রকার আহার-নিদ্রা পরিত্যাগ করে লাগাতার তিন দিন ধরে ৩,৫০০টি ব্রিজ আর কালভার্টের তালিকা তৈরি করেন সহকর্মী এস আর খান বাঁকা এবং সামাদ সাহেবকে নিয়ে। শরীফ ইমাম নিজে বাজার করে গেরিলাযোদ্ধাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন। ২৫ আগস্ট ’৭১-এ ধানমন্ডিতে দুর্ধর্ষ অপারেশন সেরে আসা রুমী এবং তাঁর দলের অস্ত্রশস্ত্র নিজ বাসভবনে রাখার ব্যাপারে শরীফ ইমাম সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া শরীফ ইমাম এবং জাহানারা ইমাম মুক্তিযোদ্ধাদের তাঁদের সাধ্যমতো আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করতে থাকেন। শাফী ইমাম রুমীঃ রুমী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫১ সালের ২৯ মার্চ। ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়ের সন্ধিক্ষণে যাঁর জন্ম, একাত্তরের নিবিড় প্রশান্তিতে তাঁর চলে যাওয়া। মাঝখানে দৃপ্ত জীবনের এক অনিমেষ অধ্যায়। আদমজী স্কুল এ- কলেজ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন তিনি। তারপর ভর্তি হন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমান বুয়েট)। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থাতেও তিনি বিশেষ অনুমতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির ক্লাশ করেন। ফলে সে-ই সময়ের উত্তাল পরিস্থিতি তাঁকেও স্পর্শ করে এবং বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের জন্য তিনিও তৈরি করতে থাকেন নিজেকে। এর মধ্যে রুমীর স্কলারশীপ হয়ে যায়। কিন্তু সেসময় স্কলারশীপ নিয়ে পড়তে যাওয়ার চিন্তা রুমির মাথায় একদমই ছিল না। আর সে কারণেই ইলিনয় ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পড়ার সুযোগ পেয়েও যুদ্ধ শুরু হবার দরুণ সে সুযোগটি তিনি গ্রহণ করেননি।মুক্তিযুদ্ধে যাবার বিষয়ে রুমী শুরু থেকেই পরিবারের সাথে আলোচনা শুরু করেন।একাত্তরের দিনগুলি,বইটির প্রথম দিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক পটভুমি ফুটে উঠেছে। প্রায় প্রতিদিনই মায়ের সাথে দুভাইয়ের তর্ক হত যুদ্ধে যাওয়া নিয়ে। রুমীর চােখে ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন,দেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন। একটা সময় মা তাকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দেন। শহীদজননী জাহানারা ইমাম তাঁর ছেলেকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দেয়ার সময় একটি চমৎকার কিন্তু ভীষন বেদনাদায়ক কথা বলেছিলেন “যা তোকে দেশের জন্য কোরবানী করে দিলাম”। একজন মা তার সন্তানকে তখনই কোরবানী দিতে পারেন যখন সন্তানের চেয়ে দেশ বড় হয়। সে সময় বাংলাদেশের হাজার হাজার মা তার সন্তানকে দেশের জন্য কোরবানী দিয়েছেন।রুমী যুদ্ধে চলে যায়। ২ নম্বর সেক্টরে যোগ দেয়। এর পরে থেকে যুদ্ধের বর্ননা শুরু হয়। সেই বর্ননায় প্রতিমুহূর্তে চোখ ভিজে উঠে। মুক্তিযোদ্ধাদের যে কোন জয়ে মন প্রফুল্ল হয়ে উঠে। যুদ্ধের ফাঁকে রুমি বাসায় আসে। যুদ্ধের বিবরন শোনায়। যে রুমি গ্লাসে একটু ময়লা দেখলে পানি খেত না, সেই রুমি যুদ্ধে গিয়ে পোকা খাওয়া রুটি খেত। এসব ঘটনা শুনতে শুনতে মায়ের চোখ অশ্রুতে ভরে য়ায়। *যে কথোপকথন গুলো খুব মন কেড়েছেঃ ০১.আম্মা, দেশের এ অবস্থায় তুমি যদি আমাকে (রুমী) জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত। তাহলে কিন্তু আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়ত বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হবো, কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কোনদিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তাই চাও আম্মা? আমি (জাহানারা ইমাম) জোরে দুই চোখ বন্ধ করে বললাম ঠিক আছে, তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা, তুই যুদ্ধে যা। ০২."সারা ঢাকার লোক একই সঙ্গে হাসছে আর কাঁদছে । স্বাধীনতার জন্য হাসি। কিন্তু হাসিটা ধরে রাখা যাচ্ছে না। এত বেশী রক্তে দাম দিতে হয়েছে কান্নার স্রোতেও হাসি ডুবে যাচ্ছে,ভেসে যাচ্ছে। " ০৩."৩ মে জাহানারা ইমামের জন্মদিনে এসে রুমি জানাল- ‘তোমার জন্মদিনে একটি সুখবর দিই আম্মা।’ সে একটু থামল, আমি আগ্রহে তাকিয়ে রইলাম, ‘আমার যাওয়া ঠিক হয়ে গেছে। ঠিকমতো যোগাযোগ হয়েছে। তুমি যদি প্রথমদিকে অত বাধা না দিতে, তাহলে এক মাস আগে চলে যেতে পারতাম।’ আমি বললাম, ‘তুই আমার ওপর রাগ করিসনে। আমি দেখতে চেয়েছিলাম, তুই হুজুগে পড়ে যেতে চাচ্ছিস, না, সত্যি সত্যি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যেতে চাচ্ছিস।’ ‘হুজুগে পড়ে?’ রুমীর ভুরু কুঁচকে গেল, ‘বাঁচা-মরার লড়াই, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে যেতে চাওয়া হুজুগ?’ ০৪." পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেয়ে বাংলার নায়ক হওয়া অনেক বেশী গৌরবের " ০৫."যদি কখনো কোন বিষয়ে আমাদের মতের সাথে তোমার মত না মেলে,তাহলে আগে আমাদেরকে বুঝিয়ে তোমার মত ফেরাবে তারপর সেই কাজটা করবে" ০৬."কেন যে বললাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে দিলাম যা, এই কথা মনে হয় আল্লাহ কবুল করে নিয়েছেন; যদি বলতাম যা বাবা যুদ্ধ করে ওদের থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়ে তবেই মায়ের কাছে ফিরে আসিস,তাহলে হয়তো ছেলেটা এখন কাছেই থাকতো" *বইটির নামকরনঃ বইটিতে আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানী বাহিনী কর্তৃক নির্যাতনের করুন বেদনা সম্পর্কে সরাসরি জানতে পারি। ২৫ মার্চ ভয়াল কাল রাত্রিতে যে হত্যা যজ্ঞ চালানো হয় সেই ঘটনা এবং পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের গর্জে উঠা সর্ম্পকেও বলা হয়েছে। এ শুধু একাত্তরে মানুষের আর্তনাদের চিত্র নয় এতে রয়েছে দীপ্ত যৌবনের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। বিভিন্ন ভয়াবহ দিনের বর্ননা করেছে লেখিকা অবলীলায়, আর বইটি লেখাও হয়েছে দিনলিপি আকারে। একে একে উঠে এসেছে পুরো ৯ মাসের বিভৎস বর্ননা।তাই নামটি যথার্থ মনে হয়েছে। *প্রচ্ছদ বিশ্লেষণঃ তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করার ক্ষেত্রে একাত্তরের দিনগুলির ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। এটা কেবল একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই নয়, এটা একজন মায়ের চোখে, মায়ের আবেগ মিশ্রিত মুক্তিযুদ্ধের অকাট্য দলিল। মুক্তিযুদ্ধের ওপরে লেখা বইগুলোর মধ্যে পাঠকের কাছে চাহিদায় এটি শীর্ষস্থানীয়। সেই অনুযায়ী প্রচ্ছদ টা হয়তো আরো অন্যরকম হতে পারতো।। প্রচ্ছদ টা যে একেবারেই অসুন্দর সেটা বলছিনা।কিন্তু বইয়ের ভেতরের কাহিনীর সাথে প্রচ্ছদ টা অমিল ই বেশী মনে হয়েছে। তবে বইয়ের ভেতরের লেখা দিনলিপির কাছে, বইয়ের মুল কাহিনীর কাছে, এই ভুল টা তেমন কিছু না। *প্রুফ রিডিংঃ পুরো বইয়ে এই বিষয় টা ছিলো নজরকাঁড়ার মতো। বইটি পড়ার সময় আমি কোথাও এতোটুকু বানান ভুল পাইনি, পুরো বইটির এই দ্বায়িত্ব যার হাতে ছিলো সে খুব দ্বায়িত্ব বোধ নিয়ে কাজটি সম্পন্ন করেছে। এতো ভালো একটা বইতে কোনরকম বানানের অসংগতি আমার চোখে পড়েনি। *বইটির সাথে জড়িত গল্পঃ ১.প্রথমদিকে জাহানারা ইমাম কে লিখতে বলা হলে উনি লিখতে চান নি। বলেছেন সে এটা সম্ভব করতে পারবেনা, কিভাবে কোনদিক দিয়ে শুরু করবে, তারপরও অনেকের অনুরোধে অবশেষে তিনি লিখতে বসেন এবং আমাদের উপহার স্বরুপ দিয়ে যায় চমৎকার এই বইটি। বইটি প্রথমে প্রকাশের ভার নিয়েছিল সন্ধানী প্রকাশনী। বই প্রকাশের আগ মুহূর্তে তিনি মহা উত্তেজিত। ঠাট্টা করে মুনতাসীর মামুন বলেছিলো, ‘আমরা লাইন দিয়ে বই কিনব।’ যেদিন বই প্রকাশিত হলো সেদিনই গিয়েছিলো বইটি কিনতে। সঙ্গে আরো কয়েকজন। বইটি কেনার পরে মুনতাসীর মামুন বললেন,বইটি কিনলাম এবং তাঁর সামনে তুলে দিলাম। হেসে তিনি লিখলেন, ‘পরম স্নেহাস্পদ মুনতাসীর মামুনকে, জাহানারা ইমাম, ১৭-০২-৮৬’। ২.জাহানারা ইমামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন সরদার ফজলুল করিম, কীভাবে তিনি লিখেছিলেন ‘একাত্তরের দিনগুলি’। উত্তর দিতে গিয়ে তিনি কেঁদেছিলেন। তারপর বলেছিলেন, “এটা আমার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। নিজের খাতায় টুকিটাকি লিখে রাখা। দিনাদিনের ঘটনা। কিন্তু একাত্তরের ঢাকায় বসে এসব লেখার বিপদ আমি জানতাম। তবু অভ্যাস ছাড়তে পারিনি। কেবল নিজের বুদ্ধিতে আজেবাজে খাতার পাতায়, একোণা-ওকোণা করে, আঁকাবাঁকা লাইনে, কখনো কালো কালিতে, কখনো রঙিন কালি দিয়ে প্রায় ছবির মতো করে দিনের ঘটনাকে ইঙ্গিতে লিখে রাখার চেষ্টা করেছি। রুমীর নাম উল্লেখ করতে হলে উল্টে লিখেছি ‘মীরু’। মুক্তিযোদ্ধাদের যদি পাঁচশ টাকা পাঠিয়েছি তো লিখেছি, পাঁচখানা কাপড় লন্ড্রিতে দেয়া হয়েছে। বুদ্ধিতে যেমন কুলিয়েছে তেমন করে লিখে রেখেছি। ভেবেছি, যদি হামলা হয়, যদি এ কাগজ হানাদারদের হাতে পড়ে, তবে এরা একে পাগলের আঁকাবুঁকি ছাড়া আর কিছুই ভাববে না।” *পাঠ্য প্রতিক্রিয়াঃ লেখিকা যখন উত্তাল মার্চের কথা বলেন তখন উত্তপ্ত বাতাস হালকা ছুঁয়ে যায় আমাকেও। জননী যখন ৭ই মার্চের কথা লেখেন তখন আমিও যেন নিজেকে আবিষ্কার করি রুমী-জামী-শরীফ কিংবা কাজের লোক সুবহান-বারেকের পাশে, অধীর আগ্রহে বসে থাকি ‘শেখের’ বক্তৃতা শুনব বলে। স্পষ্ট দেখতে পাই সেই মানুষগুলোকে যারা চব্বিশ ঘণ্টার পথ পায়ে হেঁটে গামছায় চিড়ে-গুড় বেঁধে সেদিন হাজির হয়েছিল রেসকোর্স ময়দানে। তখন আমার জন্মও হয়নি। অথচ বইটি পড়তে গিয়ে ২৫ শে মার্চের কালো রাত আমার সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে। নিজের কাছে প্রশ্ন করি, আসলে কি কালো ছিল রাতটা? নাকি আগুনের লেলিহান শিখা আর রক্তের ফাগুন ধারায় সেজেছিল সে রক্তকরবী! বইয়ের পাতা উল্টাতেই পুড়ে যেতে দেখি ঘরবাড়ি, বস্তি, কাঁচা-বাজার। সেই সাথে মানুষও। মুহুর্তে মুহুর্তে গুলিতে কেঁপে উঠতে দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। আরও এগোলে আঁৎকে উঠি পাকিস্তানী নরপিশাচদের হাতে নির্মমভাবে নিরস্ত্র বাঙালিদের জবাই হতে দেখে। বইয়ের পাতায় পাতায় দেখতে পাই বিহারিদের নৃশংসতা, ধারালো ছুরির দেবে যাওয়া তাজা মানুষের গলায়। বইটা শেষ করার পর আমার অবস্থাও এরকম যে,বেশী খুশী হতে পারছি না, শেষের দিকের বিজয়ের দিনগুলার বর্ণনা পড়েও। এর জন্যে যে মূল্য দিতে হয়েছে তা যে একটু বেশীই চড়া।এমন অনেক অনেক আত্ম উৎসর্গের হাত ধরে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা। কত মা যে তাঁর সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন, তার সবটুকু লেখা নেই সেভাবে। কিন্তু আমরা জানি, আমাদের আত্মার অংশ সবুজের বুকের লাল অংশটুকু কত কত বুকের রক্তে লাল হয়েছে। কত লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া সে পতাকা, স্বাধীনতা। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর আশ্চর্য নির্মোহ লেখনী দিয়ে লিখে গেছেন ১৯৭১ এর সেই উত্তাল দিনের ঘটনাচক্র। তাঁর শোক, তাঁর কষ্টের হাহাকারকে শব্দের আড়ালে রেখেই তিনি লিখে গেছেন দিনপুঞ্জীর মত এই অনন্য সাধারণ বইটি, যার নাম "একাত্তরের দিনগুলি"। যে সন্তানকে তিনি দেশ মাতৃকার জন্য উৎসর্গ করেন, তাঁর নাম শহীদ শাফি ইমাম রুমী। কী প্রখর সম্ভাবনাময় এক তরুণ ছিলেন রুমী। যাঁর পড়তে আসবার কথা ছিল ইলিনয় ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে। কিন্তু দেশে তখন যুদ্ধের ডামাডোল শুরু হয়ে গেছে। স্বার্থপরের মত রুমী পালিয়ে না গিয়ে যুদ্ধে যাবার জন্য তৈরি হন, বাকিটা তো ইতিহাস। সে ইতিহাসের ধারাবাহিকতার এক নিবিড় প্রামান্য দলিল "একাত্তরের দিনগুলি।" এই বই বার বার পড়া যায়। আবারও পড়বো নিশ্চয়ই। *লেখক পরিচিতিঃ জাহানারা ইমাম জন্ম : ৩ মে ১৯২৯ সুন্দরপুর, মুর্শিদাবাদ। ব্যক্তিত্বময়ী জাহানারা ইমাম দীর্ঘ সময় স্কুলকলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। একজন সংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে বিভিন্ন সংগঠনের মধ্য দিয়ে মানুষের মনোজগতে তিনি পৌছে দিয়েছিলেন তার অধীক জ্ঞান সম্ভার। একাত্তরে বাঙালীর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সঙ্গে তিনি একাত্বতা ঘোষণা করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে চরম মৃত্যু, দুঃস্বপ্নভরা বিভীষিকার মধ্যে জাহানারা ইমামের ত্যাগ ও সতর্ক সক্রিয়তা দেশপ্রেমের সর্বোচ্চ উদাহরণ হয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের শহীদের বেদনা বিধুর মাতৃহৃদয় এবং ইমামকে কেন্দ্র করে,শহীদ রুমীর মাতা পরিণত হয় শহীদ জননীতে । নব্বই দশকে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির উত্থানে জনমনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয় তার পটভূমিতে ১৯৯২-এর,১৯ জানুয়ারী ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠিত হলে জাহানারা ইমাম এর আহবায়ক নির্বাচিত হন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের দাবীতে দেশব্যাপী ব্যাপক গণআন্দোলন পরিচালনা করেন। তাঁরই নেতৃত্বে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী ময়দানে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে একাত্তরের ঘাতকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়,গণআদালত।সাহিত্যকৃতির জাহানারা ইমাম বিভিন্ন সময় নিম্নোক্ত পুরস্কার /পদকে ভূষিত হন- •বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮) •কমর মুশতরী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮) •বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১) •আজকের কাগজ হতে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা পুরস্কার (বাংলা ১৪০১ সনে) •নারী গ্রন্থ প্রবর্তনা (১৯৯৪) •স্বাধীনতা পদক (১৯৯৭) •রোকেয়া পদক (১৯৯৮) •অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (২০০১) •রোটারাক্ট ক্লাব অব স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ জন্য ১৯৯০ সালে তিনি বাঙলা একাডেমী পুরস্কার পান। গ্রন্থসমূহ : গজ কচ্ছপ, সাতটি তারার ঝিকিমিকি, নিঃসঙ্গ পাইন, ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস, প্রবাসের দিনগুলি, অন্য জীবন, বুকের ভিতরে আগুন (১৯৯০) নাটকের অবসান (১৯৯০), দুই মেরু (১৯৯০),জাগ্রত ধরিত্রী (১৯৬৮),তেপান্তরের ছোট্ট শহর (১৯৭১),নদীর তীরে ফুলের মেলা (১৯৬৬) ইত্যাদি। --------মৃত্যু : ২৬ জুন ১৯৯৪ *নিজস্ব মতামতঃ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখিকা জাহানারা ইমামের পুরো পরিবার কি পরিমান সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে যোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য সেটা এই বই পড়লে সবার ই বুঝতে পারার কথা। অন্য সব পরিবারের মতো এই পরিবারের পার্থক্য ছিলো এটাই যে, চাইলেই পুরো পরিবার দেশ ত্যাগ করে ভালোভাবে থাকতে পারার সামর্থ্য থাকার পরেও তারা এই দেশের জন্যই ছিলেন। নিজেদের টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য তো করেছেন ই আরো প্রস্তুত ছিলো অগ্রীম সব ব্যবস্থার সাথে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকারের উচিত ছিলো এদের স্মৃতিচারনে কোন কিছু প্রতিষ্ঠা করা যেন দেশের মানুষ আরো বিস্তৃতভাবে জানতে পারে পুরো পরিবার কে, কিন্তু এটা তারা করেন নাই। অবেশেষে রুমির ছোট ভাই জামি নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেন স্মৃতি জাদুঘর। তবে এটার পুরোপুরি উদ্যোক্তা সরকার হলে বেশী ভালে হতো যা আমার মনে হয়।। বইয়ের পরিচিতিঃ "বইয়ের নামঃ একাত্তরের দিনগুলি লেখকের নামঃ জাহানারা ইমাম ব্যাক্তিগত রেটিংঃ ৯/১০ প্রথম প্রকাশঃফেব্রুয়ারি ১৯৮৬ (সন্ধানী প্রকাশনী) অনলাইন পরিবেশকঃ rokomari .com/ প্রকাশনীঃ চারুলিপি চারুলিপি প্রকাশনায় প্রথম প্রকাশঃ২০১৮ ধরনঃ মুক্তিযুদ্ধের ডায়েরি,চিঠি ও স্মৃতিচারন মুদ্রিত মুল্যঃ৩৫০ টাকা রকমারি মুল্যঃ২৬৩ টাকা পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ৩১২ প্রচ্ছদশিল্পীঃ ধ্রুব এষ ভাষাঃবাংলা ISBNঃ 9789845982306"
Was this review helpful to you?
or
মনে ধরার মত একটি বই, পড়ে খুবই ভাল লেগেছে.................
Was this review helpful to you?
or
#রকমারি_বইপোকা_রিভিউ_প্রতিযোগিতা ... "আমি জোরে দুই চোখ বন্ধ করে বললাম। 'না, তা চাই নে। ঠিক আছে, তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানী করে। যা, তুই যুদ্ধে যা।" মনের টুঁটি চেপে ধরে মুখ দিয়ে বের করে দেয়া কটা লাইন। আর তার পরপরই উপস্থিত সকলের মাঝে থমথমে নীরবতা। শিউরে উঠলেন জননী নিজেও। একি বলা হলো! কোরবানী শব্দটা কেন যে উচ্চারিত হলো! ঘটনার শুরুটা মার্চের এক তপ্ত দুপুরে। পুরো ঢাকা তখন নাকি খইয়ের মতো ফুটছে। সেই তপ্ততার আঁচ এসে লাগলো একটা ছোট্ট পরিবারেও। ছিমছাম ছোট্ট একটা পরিবার। সদস্য সংখ্যা যার মাত্র চারজন। জনক, জননী আর তাদের দুই পুত্র- রুমী, জামি। একটা পোষা কুকুর আর বাগানের কিছু গোলাপও আছে। কিন্তু সবচাইতে দামী গোলাপ দুটোর একটা গোলাপ হারিয়ে গেলো একাত্তরের মাতাল করা দিনে! হারিয়ে গেলো? না, ঠিক তা তো নয়! হারিয়ে তো যায় না বলে, চুপিসারে। সে তো চুপিসারে যায় নি। ছোটবেলা থেকে জননী শিখিয়েছে, অপরাধ করলেও সেটা গোপন করা যাবে না। জননীর বনি প্রিন্স জননীর সে আজ্ঞা ভোলেনি কখনো। আর সবার মতো বিছানায় কোলবালিশ শুইয়ে পালায় নি সে। জননীকে মৃদু অথচ দৃপ্ত কণ্ঠে বলেছে, "আম্মা, আমি যুদ্ধে যেতে চাই।" যুদ্ধে গেলো বনি প্রিন্স। মা তার ফটো বাঁধাই করে টেবিলে সাজিয়ে রাখে। কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়ানো হাস্যোজ্জ্বল একটি ছবি। ক্যাপশনে লেখা- "আবার আসিব ফিরে..." বনি প্রিন্স কি ফেরে? হয়তো স্বাধীন বাংলার সবাই আজ সেই জননীকে চিনি। জননীর গোলাপ বাগানের বনি প্রিন্সটাকে চিনি। সেই বনি প্রিন্সটা ফিরেছিলো না কি ফেরেনি কখনো, হয়তো তাও জানি। তবু বারবার পড়তে ইচ্ছা করে, সন্তানের প্রতীক্ষায় উন্মুখ এক জননীর বিরহগাঁথা- "একাত্তরের দিনগুলি" পাঠ প্রতিক্রিয়ার কথা বলতে গেলে বলবো, এই বইটা আমাকে অনেক প্রভাবিত করেছে। "রুমী"-- আমার সবচেয়ে পছন্দের ব্যক্তিত্ব। আমার মুখে শুনে শুনে আমার বন্ধুবান্ধবদেরও মুখস্ত হয়ে গেছে, "আমি রুমী হতে চাই।" হায়রে! আমি কিভাবে রুমী হবো! বইটা পড়ে রুমীকে যে অনন্যতায় আবিষ্কার করেছি, সে উচ্চতায় পৌঁছানো আমার সাধ্যাতীত। তবু সারাটাক্ষণ বুকের মাঝে প্রিয় ব্যক্তিত্বকে লালন করি। মায়ের জন্মদিনে মা পাগল যে ছেলেটা মা কে দিয়েছিলো এই সুখবর- "...আম্মা। আমার যাওয়া ঠিক হয়ে গেছে।" নিছক আবেগ দিয়েই লেখা হয় নি বইটা। দিনলিপির মতো করে লিখে যাওয়া ঘটনাগুলোকে বই আকারে প্রকাশের আগে বহু তথ্যাবলী ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন লেখিকা। আবেগ যেন তথ্যের বিকৃতি না ঘটায়, খেয়াল রাখার চেষ্টা করেছেন সেদিকে। আর তাইতো শুধু এক শোকাতুর জননীর বেদনার ইতিহাস নয়, বরং বইটা হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধেরও এক অনন্য দলিল! হয়ে উঠেছে সন্তানকে স্বাধীনতা সংগ্রামে কোরবান করে দেয়া সাহসী সহস্র জনক-জননীর প্রতিনিধি! যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পড়তে ভালোবাসেন, স্বাধীনতা যুদ্ধকে জানতে ভালোবাসেন, তাদের জন্য অবশ্যই পড়ার মতো এবং একাধিকবার পড়ার মতো এই বই- "একাত্তরের দিনগুলি।" পুনশ্চঃ জাহানারা ইমাম সমগ্রের মধ্যে এই বইটা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। প্রথমে সমগ্রটাই পড়েছিলাম এবং তাতে এই বইটা না পেয়ে বিরক্ত হয়েছিলাম। জাহানারা ইমামের ছেলে জামী অবশ্য কারণস্বরূপ লেখিকার ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেছেন। পরে যখন এই বইটা পড়লাম তখন বুঝলাম, আসলেই বইটাকে কোনো সমগ্রের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত নয়। কারণ বইটা নিজ মাহাত্ম্যে নিজেই একটি সমগ্র! ... বইয়ের নামঃ একাত্তরের দিনগুলি লেখিকাঃ জাহানারা ইমাম প্রকাশনীঃ সন্ধানী প্রকাশনী মূল্যঃ ৩০০/- (মলাট মূল্য) রেটিংঃ ৫/৫
Was this review helpful to you?
or
১৯৭১ সালের সেই মহান মুক্তিযুদ্ধেরর প্রতিটা কাহিনী নিয়ে লেখা এই বই। এটাকে ঠিক বই বলা যায় না। বলা যায়, একটা দিনলিপি। প্রতিটা দিন, সময়, বার দিয়ে দিয়ে লেখিকা সেসব ভয়াল দিনগুলোর কথা লিখে রেখেছেন। শ্রদ্ধেয় জাহানারা ইমাম একজন সংগ্রামী দেশপ্রেমিকের স্ত্রী তার থেকেও বড় কথা তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধার গর্বিত মা। তিনি এই বইটিতে প্রতিটা দিনের খুটিনাটি এমনভাবে লিখে রেখেছেন যা পড়ার সময় চোখের সামনে যেন ভেসে উঠে সেসব ভয়াবহ দিন। জাহানারা ইমাম দুই সন্তানের মা। বড় ছেলে রুমি, ছোট ছেলে জামি। দুই ছেলেকেই ভীষণ ভালবাসেন। তবু রুমি একটু বেশিই প্রিয়। সেই ছেলে যখন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়াশোনা বাদ দিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি চায় মায়ের অন্তর কেপেঁ উঠে অজানা আশঙ্কায়। তবুও ছেলেকে কুরবান করেন দেশের প্রতি। কতোটা শক্তির অধিকারী হলে মা তার ছেলেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কাহিনী লিখে রাখতে পারেন? চোখের সামনে পাকিস্তানিরা কলিজার টুকরাকে ধরে নিয়ে যায়, স্বামী মৃত্যুবরণ করেন, অসুস্থ শ্বশুর, নিজের বৃদ্ধা মায়ের দেখাশোনা করেন। এতদিক সামলানোর পরও রুমির খোজেঁ ছুটে বেড়ান চারিদিকে। হানাদার বাহিনীর প্রতিটা অত্যাচারের বর্ণনা এই বইতে লেখা। শুধু এখানে জাহানারা ইমাম তার নিজের পরিবারের কথাই না লিখেছেন আরো মুক্তিযোদ্ধাদের কথা। এক কথায়, ঐতিহাসিক দলিল বলা যায় এই "একাত্তরের দিনগুলি" বইটিকে।
Was this review helpful to you?
or
বইয়ের নামঃ একাত্তরের দিনগুলি লেখকঃ শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ধরনঃমুক্তিযুদ্ধের ডায়েরি/দিনলিপি/দলিল/স্মৃতিচারণ/ নন ফিকশন প্রকাশনীঃসন্ধানী প্রকাশনী মূল্যঃ৩০০ টাকা (রকমারি মূল্যঃ২২৫ টাকা) প্রথম প্রকাশঃ ১৯৮৬ পৃষ্ঠা ঃ ২৬৮ স্বাধীনতা তুমি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি। সংক্ষেপ ঃ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের লেখা বই, না বই না, দিনলিপি.. ...।। উনিশশো একাত্তর সালের দিনলিপি। তাই নাম একাত্তরের দিনগুলি , একাত্তরের দিনগুলি’ বইটি ডায়েরীর আদলে লেখা। প্রায় প্রতি দিনের ঘটে যাওয়া ঘটনা কে তারিখ দিয়ে লিখে গেছেন ডায়েরির পাতাই, কিভাবে সম্ভব ছিল লেখা? এত প্রাণ শক্তির অধিকারিণী তিই। বেশ শিক্ষিত প্পরিবারের, মুক্তি যুদ্ধ চলাকালীন নিজের বাড়ি, শ্বশুর, নিজের মা সহ কত মানুষ কে একসাথে দেখাশোনা করে গেছেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রায় সব বড় ঘটনাই দিন অনুযায়ী অত্যন্ত সুন্দরভাবে সাথে উঠে এসেছে।যেমন ২রা মার্চ পতাকা উত্তোলন থেকে শুরু করে ৭ মার্চ এর ভাষণ...।। অত্যন্ত মেধাবী ছেলে রুমি, মা অন্তপ্রাণ।অত্যন্ত মেধাবী, রাজনীতি সচেতন ছেলে, দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রবল। ১৯৭১ সাল, উত্তাল দেশ, উত্তাল ঢাকা।। জাহানারা ইমাম বাংলা মায়ের এক প্রতিচ্ছবি, দেশের জন্য ছেলেকে উৎসর্গ করেছেন, লিখেছেন বইটি। আই এস পাশ করে “ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ” এ ভর্তি ক্লাস শুরুর অপেক্ষা একদিন তার যুদ্ধে যাবার সুযোগ এসে গেল। কিন্তু রুমী মাকে না জানিয়ে কোন করত না, তাই মায়ের কাছে এলো অনুমুতি নিতে, পেলোও, মা তাকে বলেছিল “যা তোকে দেশের জন্য উৎসর্গ করলাম”... মেলাঘরে চলে গেলো সে.........।। একদিন শহীদ হন “শফি ইমাম রুমী”। ডায়েরি তে ক্রমে ক্রমে এসেছে, নাসিরুদ্দিন বাচ্চু, আজাদ, জুয়েল সহ আরো কত মানুষ... কেবল সন্তান হারানোর গল্প না এটি...। এক মা এর মা থেকে সমগ্র শহীদের জননী হয়ে ওঠা... কত প্রাণশক্তি ছিল তার......।। হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার অকাট্য প্রমাণ পাবেন এই বইটি তে...। যুদ্ধের মাঝামাঝি ছেলে, যুদ্ধ শেষে স্বামী কে হারানো এই মা, এই জননী কিভাবে শহীদ জননী হয়ে উঠলেন, জানতে হলে বইটা পড়বেন। #পাঠ_প্রতিক্রিয়াঃ বইটা আমি পেয়েছিলাম একটা রচনা প্রতিযোগিতায় প্রহম হয়ে, ২০১০ সালে, বইটা পাওয়ার পর আমি টানা দু বার পড়ি। প্রতিবার যখন পড়ি তখণ মনে হয় নতুন করে জানছি সব, আমার চোখের সামনে বোধহয় ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে......।। মৃত্যুর পরেও আজ আমাদের মাঝেই আছেন শহীদ জননী.........।। বুকে পাথর চাপা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কাজ করে গেছেন, নিজের শ্বশুর কে সামলেছেন.........। নিজের মা কে দেখেছেন, কিভাবে পেরেছিলেন???? আসলে মন্তব্য করতে গিয়ে কি বলব আমি জানিনা, বলব বইটা পড়েন, পস্তাবেন না। দেশ কে জানবেন, হয়তো দেশের প্রতি আরো একটু ভালবাসা বাড়বে............। রেটিংঃ ৫/৫
Was this review helpful to you?
or
#রকমারি_বইপোকা_রিভিউ_প্রতিযোগিতা বইয়ের নামঃ একাত্তরের দিনগুলি লেখকঃজাহানারা ইমাম ধরনঃমুক্তিযুদ্ধের ডায়েরি,দলিল ও স্মৃতিচারণ প্রকাশনীঃসন্ধানী প্রকাশনী মূল্যঃ৩০০ টাকা (রকমারি মূল্যঃ২২৫ টাকা) .br শহিদ জননী জাহানারা ইমাম লিখেছেন বইটি। উনিশশো একাত্তর সালের দিনলিপি। একাত্তরের দিনগুলি ।তিনি বাঙলার হাজার মায়ের মতো তাঁর শ্রেষ্ঠ ত্যাগটি স্বীকার করেছেন- সন্তানকে পাঠিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে, আর ফেরেনি সন্তান- শহিদ হয়েছেন রুমী। . একাত্তরের দিনগুলি’ বইটি ডায়েরীর আদলে লেখা। এখানে পরিচ্ছেদের প্রথমেই বিভিন্ন দিনের তারিখ দেয়া এবং নিচে সেই দিনের ঘটনাপ্রবাহ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এর মাঝে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রায় সব বড় ঘটনাই দিন অনুযায়ী অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উঠে এসেছে। ডায়েরীতে যেমন ৭ মার্চের শেখ মুজিবর রহমানের রেসকোর্স ময়দানের ভাষণের কথা বলা হয়েছে, তেমনি ভাষণ পরবর্তী মার্চের দিনগুলোতে কীভাবে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন অশুভ আশঙ্কা ঘনীভূত হয়েছিলো সেই গল্পও একান্তভাবে উঠে এসেছে। . রুমী জাহানারা ইমামের বড় ছেলে। অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন এবং মেধাবী ছেলে সে। যুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানী অত্যাচারী শাসকদের প্রতি সে তীব্র ঘৃণা অনুভব করতো। তারপর যুদ্ধ যখন শুরু হল তখন পরিচিত ঢাকাকে এই ভয়ানক তাণ্ডবলীলায় বিপর্যস্ত হতে দেখে, চেনা মানুষগুলোকে নরপশুদের হাতে খুন হতে দেখে রুমী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলো না। অবশেষে তার যুদ্ধে যাবার সুযোগ এসে গেল।কিন্তু রুমী মাকে না জানিয়ে কোন কিছু করার ছেলে না। তাই সে মায়ের কাছে আসলো যুদ্ধে যাবার অনুমতি নিতে। আর জাহানারা ইমাম পড়লেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি। একদিকে দেশের প্রতি দায়, অন্যদিকে মায়ের ভালোবাসা। শেষ পর্যন্ত জাহানারা ইমামের বিবেকবোধ জয়ী হল, দেশপ্রেম জয়ী হল। তারপর রুমীদের মেলাঘরে ট্রেনিং নেয়া, ঢাকার মধ্যে করা দুঃসাহসী অপারেশনের গল্প আর একদিন অসতর্কতার কারণে হানাদারদের হাতে ধরা পড়ে যাওয়া সবই এই বইয়ে বিস্তৃতভাবে উঠে এসেছে। অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বরে বিজয় আসে। কিন্ত রুমী আর ফিরে আসেনি। #পাঠ_প্রতিক্রিয়াঃমানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়— এই অমর পঙক্তির মর্মার্থ সামনে রেখে আমরা স্মরণ করতে পারি এক বাঙালি নারী, গৃহবধূ, লেখিকা এবং লড়াকু জননী জাহানারা ইমামকে। স্বাধীনতা — উত্তর বাংলাদেশে এক জাহানারা ইমাম মুক্তিযুদ্ধ পক্ষের মানুষের কাছে হয়ে ওঠেন প্রেরণা ও আস্থার ধ্রুবলোক। তাঁর মধ্য দিয়ে সব অপূর্ণতা পূর্ণ, খন্ড অখন্ডের সঙ্গতি পেয়ে থাকে; আর তিনি জীবনবেদ থেকে উৎসারিত জায়মান চেতনা ছড়িয়ে দেন দুঃসময়ে অসহায় মানবাত্মার সম্পূর্ণ মুক্তির উদ্দেশ্যে।একাত্তরের দিনগুলি বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের দলিল।মুক্তিযুদ্ধে বিষয়ক যাই পড়ি না কেন কোন গল্প বা উপন্যাস আমার ভেতর কেমন যেন হয় কান্নাটা যেন গলা পর্যন্ত এসে আটকে থাকে কিন্ত এই বই পড়ে আর আটকায়নি।সরাসরি চোখে চলে এসেছে।না পড়ে থাকলে পড়ে দেখতে পারেন অসাধারণ একখান বই। হাপি রিডি.....
Was this review helpful to you?
or
বইটি প্রচলিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে অনেকটাই সাঙ্ঘরশিক। ২৫সে মার্চের পড়ে অর্থাৎ ২৭সে মার্চ থেকে জাহানারা ইমাম প্রায় প্রত্যেকদিন তার ছেলেদের নিয়ে গাড়িতে করে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়াতেন। কখনো যেতেন আত্মীয় স্বজনদের বাসায়, কখনো যেতেন হাসপাতালে অসুস্থ বা আহত রোগী দেখতে। বেপারটা রাজনীতিবিদদের বর্ণিত মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বেমানান। কারণ এত বর্বরতা, এত হত্যাযজ্ঞের মধ্যেও গাড়িতে করে ঘুরে বেরানর কিভাবে পরিবেশ থাকতে পারে, তা বোধগম্য নয়। জাহানারা ইমামের ছেলে রুমি মিলিটারিদের কাছে ছিল মোস্ট ওয়ান্টেড। এ কারণে তাকে মিলিটারিরা গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। জাহানারা ইমাম মিলিটারিকে ফোন করে তার ছেলেদের জন্য কিছু খাবার কিনে দিতে বললে পাকিস্তানি মিলিটারি জাহানারা ইমামের ছেলেদের কিছু খাবার কিনে দেয়। এ ঘটনাটি সত্যিকার অর্থেই অবিশ্বাস্য। শুধু তাই নয় যেখানে এদের আটকে রাখা হয়েছিল জাহানারা ইমাম তাদের মুক্তির জন্য শেখান পর্যন্ত যেতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং একের পড় এক মিলিটারির সঙ্গে এ ব্যাপারে সরাসরি এবং ফোনে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এরকম অসংখ্য ঘটনা বইটিতে রয়েছে যা পাঠকে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ফেলে দেবে কারণ এখানে এরকম অনেক বিষয় রয়েছে যা কিনা মুক্তিযুদ্ধের বর্তমান সময়ে প্রচলিত ধারনার সঙ্গে পুরোটাই শাঙ্ঘরশিক। বইটা পড়ার মত এবং মুক্তিযুদ্ধের উপর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দলিলতো বটেই।
Was this review helpful to you?
or
১৯৭১ সালের প্রতিটি দিনে তার জীবনের এবং তার দেখা ঘটনা গুলোর স্মৃতিচারনে একটি বই “একাত্তরের দিনগুলি” মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কেও একটি সম্যক ধারনা অর্জন করা সম্ভব শহীদ গেরিলা শাফী ইমাম রুমির মাতা জাহানার ইমামের এই বইটি থেকে। ছেলেরা ঘরে বসে গেরিলা পরিকল্পনা করছে আম্মা তাদের জন্য চা-নাশতার ব্যবস্থা করছেন। নিজের ছেলে জীবন হাতে নিয়ে যুদ্ধ করছে তার মা তাকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন মাতৃস্নেহের চেয়ে দেশপ্রেমকে বড় চোখে দেখে। এমন দেশপ্রেমিক দৃঢ়চেতা একজন নারী শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। এমনকি তৎকালীন রাষ্ট্রপতির সাধারন ক্ষমার আওতায় ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ থাকার পরেও এই মা তার ছেলের জন্য ক্ষমা চাননি পাকিস্তানী হানাদার শাসকগোষ্ঠির কাছে, কারন তাতে তার ছেলের অসম্মান হয়। ছেলে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গেছে তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে গেরিলা পুত্রের মাথা নিচু করেননি জাহানারা ইমাম। "সারা ঢাকার লোক একই সঙ্গে হাসছে আর কাঁদছে । স্বাধীনতার জন্য হাসি। কিন্তু হাসিটা ধরে রাখা যাচ্ছে না। এত বেশী রক্তে দাম দিতে হয়েছে কান্নার স্রোতেও হাসি ডুবে যাচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে। " বইটা শেষ করার পর আমার অবস্থাও এরকম। বেশী খুশী হতে পারছি না, শেষের দিকের বিজয়ের দিনগুলার বর্ণনা পড়েও। এর জন্যে যে মূল্য দিতে হয়েছে তা যে একটু বেশীই চড়া। নি:সন্দেহে আমার পড়া সেরা মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি। আমি মুক্তিযদ্ধ দেখি নি। কিন্তু বইটা পড়ার সময় মনে হচ্ছিল যে যা ঘটছে একদম আমার চোখের সামনে ঘটছে। আমিও অংশ নিচ্ছি। বইটা পড়ার পর বুঝলাম যে শুধু ফ্রন্ট এই না প্রতিটা বাঙ্গালী ভেতরে ভেতরে যে যেভাবে পেরেছে যুদ্ধ করেছিল শত্রুবাহিনীর সাথে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সকল বাঙ্গালীর প্রতি শ্রদ্ধা।
Was this review helpful to you?
or
মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়' — বইটি পড়ার শেষে এই অমর উক্তিটিই করতে ইচ্ছে করে বারবার। মুক্তিযুদ্ধের ভয়াল সেই বাস্তবতা আর লেখিকার ব্যক্তিগত শোকস্মৃতি তাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় আমাদের সকলের টুকরো টুকরো অগণিত দুঃখবোধের অভিজ্ঞতার সঙ্গে। কিছুই আমরা ভুলবো না, কাউকে ভুলবো না, এই অঙ্গীকারের বাহক জাহানারা ইমামের গ্রন্থ নিছক দিনলিপি নয়, জাতির হৃদয়ছবি ফুটে উঠেছে এখানে। বাকি মায়েদের মতই রুমীর মা-ও প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন তাঁর রুমীকে। কিন্তু ভাগ্যের দোলাচলে শহীদ রুমীর মাতা পরিণত হয় শহীদ জননীতে। শুধু ভালোবেসে নয়, মাঠে নেমে দৃপ্ত কন্ঠে সেই ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। তার সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনায় এই বইটি হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের এক প্রামাণ্য দলিল। যার কাব্যমূল্যও কম নয়। বাস্তব জীবনের টুকরো টুকরো এই দিনলিপিগুলো ভয়াবহভাবে জীবন্ত। বইটি নিয়ে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিই নিজের অনুভূতির কথা জানিয়েছেন। হুমায়ুন আহমেদ বলেছেন- ”ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, তিনি দেখছেন। কিন্তু দেখছেন দূর থেকে। যদিও এই গল্প একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত গল্প। জননীর তীব্র শোক ও বেদনার গল্প। নিজের গল্প দূর থেকে দেখতে পারেন তাঁরাই, যাঁরা বড় শিল্পী “। সচিত্র সন্ধানীর সাইয়িদ আতিকুল্লাহ বলেছেন- ” ’৭১ — এর ঢাকা শহরের অবস্থা এবং গেরিলা তৎপরতা বুঝবার জন্য এই বইটি অত্যন্ত মূল্যবান বলে বিবেচিত হবে। ঢাকায় গেরিলাদের তৎপরতা নিয়ে এত ভাল বই এখন পর্যন্ত আর কেউ লিখেছেন বলে জানিনে। দলিল-প্রমাণাদি সম্পর্কে উদাসীন বাঙালিদের জন্য জাহানারা ইমাম এক অমূল্য দলিল উপহার দিয়েছেন। মনোজ্ঞ বলে এ দলিলের প্রতি উদাসীন থাকা সহজ হবে না কারো পক্ষে।”
Was this review helpful to you?
or
osadharon akta boi
Was this review helpful to you?
or
Jahanara imam k salute and soto salam. Tar Akattorer dinguli boitir jonno. Tar ai boiti nisok dinlipi noy, jatir hridoysobi phute uthese akhane. Jahanara imamer sele rumi amader ohonkar bisesh kore amader moto torunder jonno. Rokomarike thanks tader jonno ami onek valo boi er sondhan peyesi tonmodhe ati best.
Was this review helpful to you?
or
একাত্তর... একটি মাত্র শব্দ কিন্তু বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট! ❝একাত্তরের দিনগুলি❞- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ডাইরির অংশবিশেষ যা তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখেন, আছে কিছু চিঠিও। বইটিতে ফুটে উঠেছে সেসময়ের বাঙালিদের করুন আর্তনাদ। একদিকে হায়েনারা আক্রমণ করে একের পর এক ধ্বংসযজ্ঞের পৈশাচিক দামামা বাজিয়ে চলছে তো অপরদিকে একে একে কেড়ে নিচ্ছে কারো প্রিয়জনদের। এমনি এক সংকটকালের বেদনা এক মায়ের। যিনি মাতৃভূমি আর সন্তানের ভালোবাসার বাঁধনে আটকে পড়েছেন। হায়েনারা দেশ খুবলে খাচ্ছে যেমন দেখতে পারছেন না তেমনি যুদ্ধে যদি সন্তানকে হারিয়ে ফেলেন এই ভয় তিলেতিলে যেন অস্থির করে তুলে শহীদ জননীকে। কিন্তু দেশপ্রেমের কাছে নতিস্বীকার করে সন্তানপ্রেম। কিন্তু মায়ের মন কি সন্তানের চিন্তা থেকে কখনও মুক্ত হয়? উৎকন্ঠিত দিন পার করেন, অপেক্ষায় থাকেন রুমি স্বাধীন বাংলাদেশ নিয়ে ফিরে আসবে। কিন্তু কোনো বড় অর্জনের পিছে কি কোনো বড় ত্যাগ থাকে না? কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা কি এত সহজেই পেয়েছি আমরা? লাখো শহীদের আত্মত্যাগ, কোটি স্বজনের আর্তনাদ, শত শত বীরাঙ্গনার আহাজারি কি ছিলো না মহান স্বাধীনতার মূল্য? কম করে হলেও তিন-চারবার পড়া হয়ে গেছে। কিন্তু যতবারই পড়ি কষ্ট-আতংক যেন নতুন করে ছুঁয়ে যায়। কি ভয়ানক-বীভৎসই না ছিল সেদিনগুলো! কল্পনাকেও যেন হার মানায়। যাঁদের উপর সে নিদারুণ ঝড় বহে গেছে তাঁরাই জানেন কী ছিলো ❝একাত্তরের দিনগুলি❞... যদিও ডায়েরি আকারে লেখা তবুও সহজ-সাবলীল লেখনশৈলী কথাসাহিত্যিক জাহানারা ইমামের। লেখনী এতটাই জীবন্ত যেন পাঠক নিজেই অনুভব করতে পারবেন বিভীষিকাময় সেই দিনগুলি। ভালোমন্দ বহু ঘটনার বিবরণ রয়েছে বইয়ে। রাতের পর যেমন দিন আসে তেমনি কালো রাত পেরিয়ে স্বাধীনতার সূর্য উদয় পর্যন্ত ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা বলে গেছেন শহীদ জননী। তিনি হারিয়েছেন অনেককিছুই। প্রিয়জনদের হারানোর কষ্ট একদিকে এবং অন্যদিকে দেশকে নতুনভাবে ফিরে পাওয়ার আনন্দ! আমরাও হারিয়েছি আমাদের বীরদের কিন্তু অমরত্ব লাভ করেছেন তাঁরা তাঁদের সীমাহীন ত্যাগের জন্য। চিরস্থায়ী আবাস গড়েছেন তাঁরা কোটি কোটি হৃদয়ে। বাংলাদেশের সাহিত্যের এক অমর সৃষ্টি ❝একাত্তরের দিনগুলি❞। যা শুধু পাঠককে ভাবাবেই নয় বরং নিয়ে যাবে দেশ গঠনের সেই সময়ে যাঁদের অবদানেই পেয়েছি আমরা কাঙ্ক্ষিত দেশ ও স্বাধীনতা। বই: একাত্তরের দিনগুলি লেখক: জাহানারা ইমাম জনরা: মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক স্মৃতিকথা প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী প্রকাশনী: সন্ধানী প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬ পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২৬৮ মুদ্রিত মূল্য: ৩০০/- রিভিউয়ার: রাফিয়া রহমান
Was this review helpful to you?
or
জাহানারা ইমাম আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের হাতে গোনা কয়েকজন খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী নারীর তালিকায় প্রথম সারিতে থাকবেন। বাংলাদেশের যুদ্ধ পূর্ববর্তী তৎকালীন সমাজে একজন নারী হিসেবে তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে ছিলেন অদম্য প্রতিভার স্বাক্ষরকারী। ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ পাশ করেন। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন বি.এড ডিগ্রি। ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে 'সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন' ডিগ্রি অর্জন করে এসে ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। কর্মজীবনের শুরুর দিকে জাহানারা ইমাম ময়মনসিংহ শহরের বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসাবে ১৯৪৮ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। এরপর ঢাকায় ফিরে এসে ১৯৫২ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ছিলেন বুলবুল একাডেমি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষকও। টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক হিসেবেও ছিলেন দু'বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটেও খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছিলেন। তাঁর লেখা 'একাত্তরের দিনগুলি' বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লেখা অন্যতম সেরা একটি বই। বইটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ১ তারিখ হতে ডিসেম্বর মাসের ১৭ তারিখ পর্যন্ত জাহানারা ইমামের ডায়েরীতে লেখা বিভিন্ন ঘটনাবলী দিয়ে এই বইটি সাজানো হয়েছে। বইটির প্রতিটি ঘটনাই বাস্তব ও চিরন্তন সত্য। যুদ্ধকালীন জাহানারা ইমাম ও তাঁর পরিবারকে ঘিরে ঘটে যাওয়া অবাক করা ও শিহরণ জাগানো বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বইটি ভরপুর। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনা, মুক্তিযোদ্ধাদের বর্ণনা, হানাদারদের নির্যাতন, বিহারী, রাজাকার, আল বদর, শান্তি বাহিনীর নির্যাতনসহ বিভিন্ন ঘটনা এর মধ্যে উঠে এসেছে। ইতিহাসের নিজস্ব কোন গ্রহণযোগ্য প্রেক্ষাপট নেই। বিভিন্ন মানুষের চোখে ইতিহাসের ঘটাগুলো বিভিন্ন রকম হয়ে ধরা দেয়। ইতিহাস বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে লেখা হয়ে থাকে। তাই ইতিহাসের উপর প্রচুর পড়াশোনা করা ছাড়া সেগুলোকে একসূত্রে বাঁধা সম্ভব নয়। একজন মানুষের বর্ণনা, মতামত বা চিন্তা, চেতনা আরেকজন মানুষের ধারণার সাথে মিলে যাবে এমন কোন কথা নেই। কথাগুলো লেখার কারণ হচ্ছে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানার জন্য কোন কোন বই পড়া উচিত এসব খোঁজেন। আসলে এসব জানার জন্য নির্দিষ্ট কোন বই নেই। আপনাকে প্রচুর পড়তে হবে। বিভিন্ন মানুষের মতামত ও প্রেক্ষাপট থেকে লেখাগুলো পড়তে হবে। তারপর আপনার পড়া বইগুলো থেকে ইতিহাসের সূত্র উদ্ভাবন করে নিতে হবে। স্বামী ইঞ্জিনিয়ার শরীফ ইমাম, বড় ছেলে শাফী ইমাম রুমী এবং ছোট ছেলে সাইফ ইমাম জামীকে নিয়ে জাহানারা ইমামের সংসার। তাঁরা ছিলেন তখনকার এলিট ফ্যামিলি। সমাজের উচ্চ পর্যায়ের সকল ব্যাক্তিবর্গের সাথেই তাদের ছিল মেলামেশা ও উঠাবসা। তৎকালীন বুদ্ধিজীবী শিক্ষক, চিকিৎসক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক সবার সাথেই তাদের আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। কি নেই তাদের? বাড়ি, গাড়ি, অগাধ টাকা-পয়সা এবং উন্নত জীবনধারনের সকল উপকরণই তাদের ছিলো। ১৯৭১ সালে তাদের বড় ছেলে শাফী ইমাম রুমীর বয়স ছিল মাত্র বিশ বছর। ১৯৬৮ সালে আদমজী পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজ হতে মেট্রিকুলেশন পাস করেন রুমি। শুধু পাসই না। তিনি তৎকালীন পাকিস্তান শিক্ষা বোর্ডে মেধা-তালিকায় তৃতীয় স্থান দখল করেছিলেন। আই.এস.সি পরীক্ষায় স্টার মার্কস পেয়ে উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে রুমী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বুয়েট) ভর্তি হন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়েও পেয়েছিলেন সুযোগ। হয়েছিলেন ভর্তি। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেখানে ক্লাস শুরুর কথা থাকলেও আর কখনও যাওয়া হয় নি। দেশপ্রেমিক রুমী ভোগ বিলাসের জীবন নিয়ে নিজের পরিবারের সাথে মেতে থাকে নি। বহু কষ্টে তাঁর মাকে রাজি করিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার অনুমতি পেয়েছিল সে। সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের মেলাঘর থেকে ২ নং সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশারফ এর অধীনে ট্রেনিং নিয়ে ঢাকায় ফিরে এসে ক্র্যাক প্লাটুনে নাম লিখিয়ে হয়ে ওঠেন দূর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধা। রুমী ও তার দলের ঢাকায় আসার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে হামলা করা। কিন্তু সুযোগের অভাবে তারা তা করে উঠতে পারছিল না। তাই ঢাকার বুকে অন্যান্য খন্ড খন্ড গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল তারা। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে ধানমন্ডিতে তাঁর সহযোগী গেরিলা যোদ্ধাদেরকে সাথে নিয়ে রুমী সবচেয়ে সফল অভিযানটি পরিচালনা করেন। অভিযান পরিচালনা করে ফেরার সময় সেখানে একটি পাকিস্তানী সেনা জিপ তাদের বহনকারী গাড়ির পিছু নিলে তিনি তা দেখতে পেয়ে গাড়ির পেছনের কাচ ভেংগে 'দেখো দেখো, একটি জিপ আমাদের অনুসরণ করছে' বলে স্টেন গান ব্রাশফায়ার করেন। তার গুলিতে পাকিস্তানি মিলিটারি জিপের ড্রাইভার নিহত হয় এবং তাদের গাড়ি ল্যাম্পপোস্টে যেয়ে ধাক্কা খায়। বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা তার গুলিতে মারা যায়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ২৯ আগস্ট রাতে রুমী তার নিজ বাসাতেই অবস্থান করছিলো। মধ্যরাতে হানাদাররা তাদের বাসা ঘিরে ফেলে। হানাদাররা রুমী, তার বাবা শরীফ ইমাম, ছোট ভাই জামী এবং তাদের বাসায় বেড়াতে আসা এক কাজিনকে ধরে নিয়ে যায়। সে রাতে হানাদাররা শহরের আরো অন্যান্য জায়গায় অভিযান চালিয়ে আলতাফ মাহমুদ, আবুল বারাক, আজাদ ও জুয়েলসহ আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে গ্রেপ্তার করেছিল। সেই রাতের অভিযানটির ব্যাপারে পাকিস্তানিরা জেনে গেলে দেশপ্রেমিক রুমী আর কারও নাম স্বীকার না করে নিজের কাঁধে এর সম্পূর্ণ দায়ভার বহন করে নেন। রুমীর পরিবারের বাকিরা নির্মম অত্যাচার সহ্য করে কয়দিন পরে মুক্তি পেলেও আগস্টের ৩০ তারিখের পর আর কখনও খোঁজ পাওয়া যায়নি রুমীর। বইটি পড়লে মুক্তিযুদ্ধে জাহানারা ইমামের পরিবারের অবদান সম্পর্কেও জানা যাবে। এ পরিবারটি মুক্তিযুদ্ধে বিশাল অবদান রেখেছে। প্রতিনিয়তই মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বাসায় এসেছে। খাওয়াদাওয়া করেছে। ঔষধ, সোয়েটার, সিগারেট সহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র নিজ বাসায় লুকিয়ে রেখেছেন। আশেপাশের অনেক মানুষকে যুদ্ধের শেষের দিকে ভারতীয় বিমান হামলার সময়ে তাদের নিজ বাসায় আশ্রয় দিয়েছেন। রুমীর বাবা শরীফ ইমাম নিজের জীবন বাজি রেখে শহরের বিভিন্ন ব্রিজ ও কালভার্টের ব্যাপারে মুক্তিবাহিনীর কাছে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন। এছাড়াও তাঁর বন্ধু ও সহকর্মীরা মিলে মুক্তিবাহিনীকে টাকা-পয়সা দিয়ে সহায়তা করেন। বইটি পড়লে মনে হবে ১৯৭১ এর পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি। পাকিস্তানিদের টর্চার, হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও ও অত্যাচারগুলো নিজ চোখে দেখা যাবে। জানা যাবে গণহত্যার বিভৎস বর্ণনা, বিহারীদের নির্বিচারে নিরস্ত্র বাঙালী হত্যা করা, আল বদর, রাজাকার ও শান্তি বাহিনীর দেশদ্রোহীতার নির্মম ইতিহাস। 'একাত্তরের দিনগুলি' বইটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী। বই - একাত্তরের দিনগুলি লেখিকা - জাহানারা ইমাম প্রকাশকাল - ফেব্রুয়ারী ১৯৮৬ প্রকাশক - সন্ধানী প্রকাশনী পৃষ্ঠা - ২৬৮
Was this review helpful to you?
or
একাত্তরের দিনগুলি বাংলাদেশি কথাসাহিত্যিক জাহানারা ইমাম রচিত একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। প্রত্যেকের একবার এটি পড়া উচিত! গল্পটি নাটকীয়, স্বাধীনতা-সংগ্রামের খাঁটি ইতিহাস। বইটি আপনাকে সেই সময়ে ঢাকায় কী চলছিল এবং বিশেষত কীভাবে মুক্তিবাহিনী পরিচালিত হয়েছিল সে সম্পর্কে জানাবে ।
Was this review helpful to you?
or
শোককে শক্তিতে রূপান্তর করার কথা আমরা প্রায়ই বলে থাকি। একাত্তরের দিনগুলির লেখক জাহানারা ইমামের জীবনে এটি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। একাত্তরে সবকিছু হারিয়ে তিনি নতুন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করেছেন। তাঁর বইটি পাঠ করা রীতিমতো একটি অভিজ্ঞতা। ওই দিনলিপির প্রথমেই তিনি তাঁর ভয় ও শোকের যাত্রা শুরু করেন এবং এই বইয়ের শেষের পৃষ্ঠাগুলোতে দেখা যাচ্ছে যে তিনি তাঁর পুত্র ও স্বামীকে হারিয়ে আপন শক্তিতে জ্বলে উঠেছেন। তাঁর দিনলিপির প্রথম পৃষ্ঠা শুরু হচ্ছে ১৯৭১-এর পয়লা মার্চ সোমবার, আর শেষ হচ্ছে ওই বছরের ১৭ ডিসেম্বর শুক্রবার। রমনার মাঠে যেদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে তার পরের দিন। এই নয় মাসের মধ্যে একদিন আগস্ট মাসে পাক হানাদার বাহিনী তাঁর স্বামী এবং পুত্রদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। কয়েক দিন পর অনেক নির্যাতনের শেষে তাঁর স্বামী শরিফ ইমাম এবং দ্বিতীয় পুত্র জামী এবং অন্য কয়েকজন ফিরে আসেন। কিন্তু রুমি আর ফিরে আসেনি। যুদ্ধের শেষের দিকে তাঁর স্বামী হূদযন্ত্রের প্রক্রিয়া শেষ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ১৪ ডিসেম্বর যেদিন পাকিস্তানের দোসর রাজাকার আল-বদরেরা ঢাকার বাড়ি বাড়ি থেকে দেশের বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে হত্যা করে, সেদিন শরিফ ইমামের লাশ দাফন করতে বের হয়ে যায় জাহানারা ইমামের আত্মীয়স্বজনেরা। দুই দিন পরে দিনলিপি শেষ হওয়ার এক দিন পর সাতমসজিদ রোডের রায়েরবাজারে বধ্যভূমিতে ১৪ তারিখে ধরে নিয়ে যাওয়া বুদ্ধিজীবীদের গলিত লাশ পাওয়া যায়। রুমির দেহ সেখানে বা অন্য কোথাও পাওয়া যায়নি। আরও পরে তিনি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রধান হয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হন। সেই সময় বিএনপি সরকারের সঙ্গে জোটবদ্ধ কয়েকটি দলের মানুষেরা ওঁর নাম বিকৃত করে বলত ‘জাহান্নামের ইমাম’। এসবে ওঁর কিছুই যেত-আসত না। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন এবং কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হননি। যদিও অজান্তে তখন তাঁঁর দেহে মরণব্যাধি ক্যানসার বাসা বেঁধেছে। যাই হোক, ফিরে যাই আবার ওই বইটির কথায়। কীভাবে আবেগবর্জিত ভাষায় একেকটি দুঃখের দিনের কথা লিখে যাচ্ছেন লেখক যে পাঠকের পক্ষে আশ্চর্য হওয়া ছাড়া আরও কিছু করার থাকে না। একটি দিনের বর্ণনা এ রকম, ‘১৪ই ডিসেম্বর, মঙ্গলবার ১৯৭১: শরিফকে বাসায় আনা হয়েছে সকাল দশটার দিকে। মঞ্জুর, মিকি… এরা দু’জন ওদের পরিচিত ও আত্মীয় পুলিশ অফিসার ধ’রে গাড়িতে আর্মড পুলিশ নিয়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একটা পিকআপ যোগাড় করে হাসপাতাল থেকে ওকে নিয়ে এসেছেন। ‘সকাল বেলা প্লেনের আনাগোনা একটু কমই ছিল। আজ কারফিউ ওঠে নি। তবু আমাদের গলিটা কানা বলে, খবর পেয়ে সব বাড়ির লোকেরা এসে জড়ো হতে পেরেছেন। খবর পেয়ে আনোয়ার তার বোর্ড অফিসের মাইক্রোবাসটা অনেক ঝঞ্ঝাট করে নিয়ে এসেছে। সঙ্গে এসেছে শেলী আর সালাম। ওই মাইক্রোবাস পাঠিয়ে মা আর লুলুকে আনা হয়েছে ধানমন্ডীর বাসা থেকে। মঞ্জুর তার গাড়িতে কয়েকটা ট্রিপ দিয়ে এনেছেন বাঁকাকে, ফকিরকে, আমিনুল ইসলামকে। ডব্লিউ আর খান যোগাড় করে দিয়েছেন…’ এ পর্যন্ত বোঝাই যাচ্ছে না যে মৃত শরিফকে আনা হয়েছে, না জীবিত কিন্তু অসুস্থ শরিফকে আনা হয়েছে। এমন নির্মোহ ভাষায় লেখা বইটি। সত্যিকার বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আমরা যারা দেশে ছিলাম, ভারতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারিনি, প্রতিদিন মধ্যরাতে দরজায় কড়া নাড়া শোনার ভয়ে কাটিয়েছি, এই বইয়ে আমাদের প্রত্যেকের কথাই বলা হয়েছে। আজ যাঁরা এই বইটি পড়েননি তাঁদের প্রতি অনুরোধ, রুমির মায়ের এই দিনলিপি পড়ুন—তাহলেই পরিষ্কারভাবে জানতে পারবেন সেদিনের পরিস্থিতি।
Was this review helpful to you?
or
আমি একাত্তর দেখিনি,কিন্তু অনুভব করেছি বিভিন্ন বই-পত্র,চিথি,দলিল পড়ে এবং তার সূচনা হয়েছিল জাহানারা ইমামের 'একাত্তরের দিনগুলি' বইটি পরে।এই বইটি মূলত একটি দিনপঞ্জিকা।তাই এটিকে আরও বেশি আপন লেগেছে।মনে হচ্ছে,এইতো আমার পাশের বাড়ির রুমি ভাইয়া যুদ্ধ করতে গেছেন,আর তাঁর পরম স্নেহময়ী জননী রুমি ভাইয়ের জন্য দিনরাত অপেক্ষা করে চলেছেন-কবে আসবে রুমি,কখন আসবে রুমি??? "একাত্তরের দিঙ্গুল"বইতি একটি ঐতিহাসিক দলিল।ইতিহাস,রাজনীতি,মুক্তির চেতনা প্রভৃতি বিষয়গুলোর সাথে খুব কাছ থেকে ব্যক্তিসত্তার যোগসূত্র স্থাপন করাতা অনেকাংশেই সহজ করে দিয়েছে এই অনবদ্য;(আমার চোখে অমর)বইটি। শিশু কিশোর যুবক যুবতী সকলের চেতনাকে পুনরজাগরনের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার ক্ষেত্রে এই বইটির গুরুত্ব যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবে... আশা কঋ বইটি সবাই পড়বেন...
Was this review helpful to you?
or
জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটি খুব সাধারণ এক গল্পের অসাধারণ আখ্যান হয়ে উঠার কাহিনী। এক সাধারণ বাঙালি নারীর ব্যক্তিগত ডায়েরীর বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় দলিল হয়ে উঠার গল্প। জাহানারা ইমামের একজন সাধারণ মা থেকে শহীদ জননী হয়ে উঠার দিনলিপি। ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটিতে জাহানারা ইমাম মায়ের মমতা নিয়ে, বাঙালি নারীর শাশ্বত মহিমা নিয়ে, দেশপ্রেমিকের ভালোবাসা নিয়ে একাত্তরের দিনগুলোর গল্প আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটি ডায়েরীর আদলে লেখা। এখানে পরিচ্ছেদের প্রথমেই বিভিন্ন দিনের তারিখ দেয়া এবং নিচে সেই দিনের ঘটনাপ্রবাহ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ডায়েরীর তারিখ শুরু হয়েছে মার্চের প্রথম দিক থেকেই আর শেষ হয়েছে ডিসেম্বরের একদম শেষে গিয়ে। এর মাঝে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রায় সব বড় ঘটনাই দিন অনুযায়ী অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উঠে এসেছে। ডায়েরীতে যেমন ৭ মার্চের শেখ মুজিবর রহমানের রেসকোর্স ময়দানের ভাষণের কথা বলা হয়েছে, তেমনি ভাষণ পরবর্তী মার্চের দিনগুলোতে কীভাবে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন অশুভ আশঙ্কা ঘনীভূত হয়েছিলো সেই গল্পও একান্তভাবে উঠে এসেছে। তারপর ২৫শে মার্চের কাল রাতের বর্ণনা বেশ বিস্তৃতভাবে এসেছে। জাহানারা ইমাম বিভিন্নজনের কাছে থেকে ২৫ মার্চ রাতের যে সব ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা শুনেছিলেন সে সবও তিনি ‘একাত্তরের ডায়েরী’ বইটিতে লিপিবদ্ধ করেছেন। তাই সে রাতের নৃশংসতার প্রায় সব দিকই এখানে উঠে এসেছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের হত্যাকাণ্ড, পুরান ঢাকার হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের হত্যাকাণ্ডের বীভৎসতার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ছোঁয়াও পাওয়া যাবে এই বইয়ে। তার পরপরই চলে আসে এই ডায়েরীর মূল আলোকপাত যেই ব্যাপারে সেই রুমীর কথা। রুমী জাহানারা ইমামের বড় ছেলে। অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন এবং মেধাবী ছেলে সে। যুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানী অত্যাচারী শাসকদের প্রতি সে তীব্র ঘৃণা অনুভব করতো। তারপর যুদ্ধ যখন শুরু হল তখন পরিচিত ঢাকাকে এই ভয়ানক তাণ্ডবলীলায় বিপর্যস্ত হতে দেখে, চেনা মানুষগুলোকে নরপশুদের হাতে খুন হতে দেখে রুমী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলো না। অবশেষে তার যুদ্ধে যাবার সুযোগ এসে গেল। সে বন্ধুদের মাধ্যমে একদিন ট্রেনিংয়ে যাবার সুযোগ পেল। কিন্তু রুমী মাকে না জানিয়ে কোন কিছু করার ছেলে না। তাই সে মায়ের কাছে আসলো যুদ্ধে যাবার অনুমতি নিতে। আর জাহানারা ইমাম পড়লেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি। একদিকে দেশের প্রতি দায়, অন্যদিকে মায়ের ভালোবাসা। শেষ পর্যন্ত জাহানারা ইমামের বিবেকবোধ জয়ী হল, দেশপ্রেম জয়ী হল। তারপর রুমীদের মেলাঘরে ট্রেনিং নেয়া, ঢাকার মধ্যে করা দুঃসাহসী অপারেশনের গল্প আর একদিন অসতর্কতার কারণে হানাদারদের হাতে ধরা পড়ে যাওয়া সবই এই বইয়ে বিস্তৃতভাবে উঠে এসেছে। অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বরে বিজয় আসে। কিন্তু রুমী আর ফিরে আসে না। তাছাড়া ১৪ই ডিসেম্বর গভীর রাতে জাহানারা ইমামের স্বামীও না ফেরার দেশে চলে যান সবাইকে রেখে। যে কোন মহান আখ্যানের মত এই দুঃখবোধ সাথে নিয়েই ডায়েরীটি শেষ হয়। যে সব পাঠক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ব্যাপারে জানতে আগ্রহী, কিন্তু শুধু শুধু খটমটে ইতিহাস পড়তে যাদের অনীহা তাদের জন্যে জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ একটি অবশ্যপাঠ্য বই। এখানে দিনলিপির ছলে গভীর মমতায় যুদ্ধদিনের কথাগুলো দক্ষ শিল্পীর কলমের আঁচড়ে উঠে এসেছে।
Was this review helpful to you?
or
সদ্য এইচ,এস,সি পাশ করা তুখোড় ছাত্র রুমী। উচ্চশিক্ষিত ও ধনী সচ্চল পরিবারে খুব আদরে বড় হওয়া রুমী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার প্রাক্কালে শুরু হয়ে যায় দেশের মুক্তিযুদ্ধ। পাক হায়েনাদের ২৫শে মার্চ কালোরাত্রিতে অতর্কিত হামলায় রাজধানী ঢাকা তার বুকে ধারন করা মানুষসহ জ্বলে-পুঁড়ে ছারখার। বেঁচে থাকা অন্যান্য মানুষদের মত ভয়, ঘৃনা, ক্রোধ, উৎকন্ঠায় দিশেহারা সেও। “দেশকে শত্রুমুক্ত করতে হবে” এমন অনুভূতিতে অনুপ্রানিত হয়ে যুদ্ধে যাবার জন্য মনস্থির করে ফেলেছে রুমী। তবে মা’কে না জানিয়ে কিছু করা যাবে না। মা তাকে ছোটবেলা থেকে শিক্ষা দিয়েছে এমন কিছু না করতে, যা তাদের কাছে লুকাতে হয়। মাকে যুক্তি দিয়ে রাজি করিয়ে তবেই সে যুদ্ধে যাবে। কিন্তু মা এত সহজে রুমিকে যুদ্ধে যেতে দিলে তো! রুমিও নাছোড় বান্ধা ! মাকে তার ইচ্ছে ও যুক্তি দিয়ে হ্যাঁ বলিয়েই ছাড়বে। বিশ্বখ্যাত ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি আই,আই,টি’তে সেপ্টেম্বর থেকে রুমির ক্লাস শুরু। দেশের অবস্থার কথা ভেবে মা রুমিকে এপ্রিলেই তার ইউনি’তে পাঠিয়ে দেবেন ঠিক করলেন। অন্যদিগে রুমি তার সিদ্ধান্তে অটল। মাকে সে বোঝাল,এখন দেশের বাহিরে গিয়ে চার বছর পর ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে এসে বেশ সুখের জীবন কাটাতে পারে সে।কিন্তু দেশমাতাকে রক্ষা না করার দায়ে সে সারাটা জীবন বিবেকের দংশনে দংশিত হবে। মা,তুমি কি চাও আমি নিজের কাছে অপরাধী হয়ে যাই? মা শুধু নিশ্চুপ হয়ে রুমির কথা শুনে। অবশেষে মাস খানেক পর রুমির ইচ্ছেকে মেনে নিয়ে মা বল্লেন,”যা---দেশের জন্য তোকে কোরবানি করে দিলাম”। ছোট্ট একটা ব্যাগ নিয়ে রুমি চলে যায় ভারতীয় সীমান্ত মেলাঘরে। প্রায় দু’মাস সেখান থেকে যুদ্ধ করে ঢাকাতেই ফিরে আসে “বিচ্চু গেরিলা “ হিসেবে। বন্ধুরাসহ কয়েকটা অপারেশন করে বেশ কিছু হায়েনাদের জাহান্নামে পাঠিয়ে দিয়েছে সে। তার সাহস ও কাজের জন্য বন্ধুদের কাছে হিরো রুমী। অবশেষে এক মধ্যরাতে পুরো বাড়ি ঘিরে বাবা ও ভাইসহ রুমিকে এরেষ্ট করে নিয়ে যায় মিলিটারিরা। হায়েনাদের নির্মম অত্যাচারে শহীদ হয় রুমী। এভাবে একটি টগবগে তরুন ছেলের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়াটাকে মূল হিসেবে ধরে সেক্টর ২’তে ঢাকাকেন্দ্রিক গেরিলা তৎপরতার বিবরন দিয়ে সাজানো হয়েছে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের “একাত্তরের দিনগুলি” বইটি। বইটির প্রথম দিগে লেখকের লিখনিতে বেশ মজা পাচ্ছিলাম। মাঝের পৃষ্ঠাগুলোতে রোমাঞ্চিত হয়ে শেষের দিগে ঘটনার বর্ণনায় কান্না ধরে রাখতে পারিনি। একাত্তরের সেই দিনলিপিগুলো জীবন্ত হয়ে আমাকে কাঁদিয়ে গেলো এই ২০১৩’তে। কী এক সম্ভাবনাময় ও সমৃদ্ধ জীবনের আহবানকে পায়ে ঠেলে দেশের জন্য নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিলো এই রূমী! যাদের এমন অসামান্য আত্মত্যাগের জন্য আমরা আজ স্বাধীন,স্বাধীনতার যুদ্ধে শহীদ সেই সকল রুমীদের চরনে আবারো হাজার সালাম।
Was this review helpful to you?
or
এই বইটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা একটা দিন পঞ্জিকা। ঐ সময়ের আমাদের সোনালি দিনের পর পাকিস্তানি দের অত্যাচার এবং ছেলে হারানর কষ্টই এই বইটা তে ফুটে উঠেছে।
Was this review helpful to you?
or
এক একটি দিনলিপি। প্রাত্যহিক জীবনের ভাষায় রচিত। বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ এক অর্জনের ইতিহাস এ দিনলিপির বিষয়বস্তু। এটি কোনো মহাকাব্য নয়; এর অন্তঃস্রোতে যখন তখন শিল্পের মহাবাদল নেমে আসেনি। তারপরও- এটি সকল মহাকাব্যের অতীত, বান-ভাসানো এক মহার্ঘ শিল্পের প্রণয়োচ্ছ্বাসে ঋদ্ধ, বিদগ্ধ। বাঙলা ১৩৯২ সনের ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৬) মাসে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়; এখনও নতুন। বৈশাখ, ১৪১৭ সনে প্রকাশিত এর অষ্টাবিঙশতি মুদ্রণের প্রচ্ছদ করেছেন কাইয়ুম চৌধুরী। রজত জয়ন্তী সঙস্করণটি সন্ধানী প্রকাশনীর প্রকাশ- মূল্য দুইশত সত্তর টাকা। ‘মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ ও জীবিত গেরিলাদের উদ্দেশে’- উৎসর্গপত্র। পহেলা মার্চ থেকে সতেরোই ডিসেম্বর পর্যন্ত এখানে লিপিবদ্ধ। দিনলিপি ছাপিয়ে বইটি হয়ে উঠেছে জাতির হৃদয়ছবি। শহিদ জননী জাহানারা ইমাম লিখেছেন বইটি। উনিশশো একাত্তর সালের দিনলিপি। একাত্তরের দিনগুলি । জাহানারা ইমাম জন্মগ্রহণ করেন ৩ মে ১৯২৯ সালে; সুন্দরপুর মুর্শিদাবাদে। দীর্ঘ সময় শিক্ষকতা করেছেন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। একজন সাঙস্কৃতিক কর্মী হিসেবে বিভিন্ন সঙগঠনের মধ্য দিয়ে মানুষের মনোজগতে তিনি পৌঁছে দিয়েছিলেন তাঁর অধীত জ্ঞান সম্ভার। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে তিনি বাঙলার হাজার মায়ের মতো তাঁর শ্রেষ্ঠ ত্যাগটি স্বীকার করেছেন- সন্তানকে পাঠিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে, আর ফেরেনি সন্তান- শহিদ হয়েছেন রুমী; আমাদের চেতনার আকাশ শহিদ জননী জাহানারা ইমাম । নিটোল ব্যক্তিত্বের সাথে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা আর চিন্তার সুরসুতার মণিকাঞ্চনে জাহানারা ইমামের সাহিত্য মূর্ত হয়ে ওঠে। গজ কচ্ছপ, সাতটি তারার ঝিকিমিকি, নিঃসঙ্গ পাইন, ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস, প্রবাসের দিনগুলি, অন্য জীবন প্রভৃতি গ্রন্থগুলো তাঁর সাহিত্যপ্রতিভার উজ্জ্বল ও বর্ণিল সাক্ষর। তবে যে গ্রন্থটিতে তিনি হৃদয়কে পাথর করেছিলেন, বুকের গহীনে বহন করা বেদনাকে সঙহত করে দুঃখের নিবিড় অতলে ডুব দিয়েছিলেন আর তুলে এনেছিলেন বিন্দু বিন্দু মুক্তোদানার মতো অভিজ্ঞতার সকল নির্যাস- সেই ‘একাত্তরের দিনগুলি’ একদিকে যেমন বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য-অসামান্য দলিল, তেমনি বাঙলা সাহিত্যের এক বিজয়তোরণ। এ গ্রন্থে একদিকে যেমন রয়েছে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার চিত্র, পারিবারিক সৌহার্দ্যরে বহমানতা, ইতিহাসের আকাশছোঁয়া সৌধ- তেমনি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান চিহ্নিতকরণও এ গ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। উনিশশো একাত্তর সালের মার্চ মাস থেকে পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্র, সাতই মার্চের উত্তাল জনতরঙ্গের আঁচড়, তেইশে মার্চ প্রতিরোধ দিবসে একটি পারিবারিক আবহের প্রেক্ষিতে গোটা জাতির অবস্থার সত্য-অবলোকন, পঁচিশে মার্চে পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো নারকীয় গণহত্যা, তৎকালীন গণমাধ্যমের সত্য-অসত্য সঙবাদ পরিবেশন, বাঙালির প্রবাদপ্রতিম প্রতিরোধ, কোজাগরী পূর্ণিমার পূর্ণ শারদচন্দ্রের দ্যুতির মতোন একজন বঙ্গবন্ধু, সেক্টর টু- ঈশ্বরের মতো খালেদ মোশাররফ, মায়াময়ী রঙধনুর প্রহেলিকার মতো গেরিলা বাহিনী, স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্র, স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি- রাজাকার-আলবদর-আলশামস, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড, সাতকোটি বিপন্ন কোকিলের ঐকতানে ইতিহাস কাঁপানো মহামহীরূহ বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ এবঙ তারপর সবকিছু ছাপিয়ে এবঙ সাথে নিয়ে একজন রুমী উঠে আসেন আমাদের বুকের আঙিনায়- দুইশত সত্তর পৃষ্ঠার এই বইটিতে জাহানারা ইমামের ইতিহাস-কথন চৌরাসিয়ার বাঁশির মতোন আমাদের ঘিরে রাখে, আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। দুই একটি পারিবারিক ঘটনা পরিক্রমার মধ্য দিয়ে বইটি শুরু হয়, এবঙ ধীরে ধীরে তা প্রবেশ করে ইতিহাসের আলোকোজ্জ্বল গহবরে। পহেলা মার্চ, উনিশশো একাত্তর- সোমবার; এখন থেকেই বইটির শুরু। শুরুর বাক্যে আমরা যাঁকে পাই- রুমী- এরপর পুরো গ্রন্থেই রুমী জীবন্ত থাকেন, যেমন আছেন এখনও এবঙ থাকবেন অনন্তকাল। গ্রন্থটির প্রথম বাক্য- আজ বিকেলে রুমী ক্রিকেট খেলা দেখে তার বন্ধুদের বাসায় নেয় আসবে হ্যামবার্গার খাওয়ানোর জন্যে। (পৃষ্ঠা ১১) বস্তুত সেজন্যেই জাহানারা ইমাম গিয়েছিলেন জিন্না এভিনিউয়ের- যা এখন বঙ্গবন্ধু এভিনিউ- পূর্ণিমা স্ন্যাক্সবারে। এই স্ন্যাক্সবারটি এখনও আছে। বইয়ের শুরুতেই বাঙালির প্রতিরোধ আন্দোলনের একটি গার্হস্থ্য চিত্র পাই। রাজপথে আন্দোলন চলছে, চলছে স্বাধীন বাঙলার পতাকা উত্তোলনের কাজ- এবঙ এরই মাঝে একজন জাহানারা ইমাম- একজন মা, একজন স্ত্রী, একটি পরিবারের কর্ত্রী- তিনি দুই সপ্তাহ ধরে খুঁজে ফিরছেন পূর্ব পাকিস্তানের তৈরি সাবান, তেল, টুথপেস্ট, বাসন-মাজা পাউডার এবঙ আক্ষেপ নিয়ে বলেছেন ‘কিন্তু পাই না’। এই বোধটিও বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক- যদিও অনেক অর্বাচীনের দৃষ্টিতেই এটি ছোটো মনে হতে পারে। এর ফলাফল কতোদূর ছিলো- সেটাও প্রথমদিকেই খুঁজে পাওয়া যায়। জাহানারা ইমাম লিখেছেন- একমাত্র ইভা বাসন মাজা পাউডারটাই এখানকার তৈরি.. ..পিয়া নামের এক ঢাকাই টুথপেস্ট বাজারে বের হবো হবো করে এখনও বের হতে পারছে না, আল্লাহই মালুম কি কঠিন বাধার জন্য! (পৃষ্ঠা ১১) অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটি স্বনির্ভরতার সাহসী পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছিলো, এবঙ এটাও স্পষ্ট যে- পশ্চিম পাকিস্তানি বর্বর শাসকগোষ্ঠী তাতে ভীত সন্ত্রস্ত ছিলো। তাই ‘কঠিন বাধা’ দিয়ে তারা স্বাধীনতার স্বপ্নের মূলোৎপাটন করতে চেয়েছিলো। পহেলা মার্চে রুমী-জামী স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে গিয়েছিলো। সেখান থেকে বাড়ি ফেরে রাত আটটারও পরে। একা। বন্ধুদের নিয়ে নয়- রাষ্ট্রের পরিস্থিতি রুমীকেও ভাসিয়ে নেয়। কিন্তু মা তো ঠিকই সাড়ে চারটার মধ্যে দুই ডজন হ্যামবার্গার বানিয়ে ওভেনে মৃদু গরমে রেখে দিয়েছেন। তাই মায়ের অভিমান হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু রুমীও জানতেন; জাহানারা ইমাম লিখেছেন- রুমী আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে দুই হাত তুলে, মুখে হৃদয় গলানো হাসি ভাসিয়ে.. .. (পৃষ্ঠা ১২) তারপর ‘সবকিছুর স্কুপ-নিউজ’ দেবার প্রতিশ্রুতিতে মায়ের অভিমান ভাঙায় রুমী। রুমীর পরিবেশিত ‘স্কুপ-নিউজ’ থেকেই জানা যায় ‘খেই ফুটছে সারা শহরে’ - জানা যায় ‘গুলিস্তানের মোড়ে কামানের ওপর দাঁড়িয়ে মতিয়া চৌধুরী’র আগুনের হলকার মতো বক্তৃতা। রুমী নিজেই বললো- সাধে কি আর ওঁকে সবাই অগ্নিকন্যা বলে (পৃষ্ঠা ১২) এরপর দৈনন্দিন জীবন এগিয়ে যেতে থাকে। আমরা জানতে পারি জাহানারা ইমামের পরিবারের সাথে একজন বিদেশীও থাকতেন। তাঁর নাম কিটি। যদিও দোসরা মার্চেই কিটির প্রসঙ্গ আসে, কিন্তু তাঁর পরিচয় পাওয়া যাবে পাঁচ মার্চ, শুক্রবারের দিনলিপি থেকে। জাহানারা ইমাম লিখছেন- কিটি আমেরিকান মেয়ে- একটা স্কলারশিপ নিয়ে এদেশে এসেছে ডিসেম্বরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে মুনীর চৌধুরীর আন্ডারে ‘সমাজ-ভাষাবিজ্ঞানে বাংলার মান নির্ধারণ’ বিষয়ে গবেষণা করার জন্যে। ন’টা ভাষা জানে। বাংলা ভাঙা ভাঙা বলতে পারে। তাড়াতাড়ি বাংলা শেখার জন্যে কোনো বাঙালি পরিবারে বাস করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলো কিটি। (পৃষ্ঠা ১৮) এই বক্তব্য থেকে দুটো বিষয় নির্ধারণ করা যায়- একটি প্রাসঙ্গিক, অন্যটি অপ্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিক বিষয়টি হলো- মুনীর চৌধুরী কোন মানের শিক্ষক ছিলেন- তা তাঁর জীবনী বা রচনা পড়লেই বোঝা যায়- কিন্তু তিনি কতোটা আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষক ছিলেন- তার একটি নিদর্শন এই কথাগুলো। যেসব মূর্খ এবঙ ‘টোকাই গবেষক’ দের কেউ কেউ মনে করে বাঙলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোনো মেধাবৃত্তিক উপযোগী ভূমিকা রাখেনি - তাদের এই বইটি কয়েকশবার পড়া উচিত। আল-বদরের অমানুষগুলো এই মহান শিক্ষক মুনীর চৌধুরীকে হত্যা করে- চৌদ্দই ডিসেম্বর, উনিশশো একাত্তর সালে। আর অপ্রাসঙ্গিক বিষয়টি হলো- আজকাল প্রায়শ আলোচনাতেই দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এটা সত্য- মান নিন্মমুখী ; তবে এটাও মানতে হবে- যে বিশ্ববিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিগত চল্লিশ বছরে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর মতো কোনো শিক্ষক তৈরি করতে পারেনি- তাদের সুউচ্চ বোধসম্পন্ন শিক্ষার্থী আশা করাটা বাতুলতা মাত্র। বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক হলেও ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থের বিবেচনায় এড়িয়ে যাবার নয়। ছয় মার্চে জাহানারা ইমাম লিখেছেন- রুমী গতবছর আই.এস.সি পরীক্ষা দেবার পর থেকে শরীফের অফিসে টুকটাক ড্রইং এর কাজ করে। .. ..রেজাল্ট বের হবার পর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছে গত বছর অক্টোবরে.. ..বিভাগীয় প্রধানের বিশেষ অনুমতি নিয়ে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকনমিকস বিভাগে ক্লাশও করে। (পৃষ্ঠা ২০) এই বিষয়টি এখন একেবারেই অসম্ভব। বর্তমান বাস্তবতা এমন নিষ্ঠুর যে- এখানে আন্তঃবিভাগীয় স্নাতোকোত্তর করাও সম্ভব না। অতএব যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ। আমাদের স্বার্থপর মনন কেবল আমরাই গঠন করছি না- আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও দায়ী- মানতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব সময়ে বাঙালির প্রস্তুতির বেশ কয়েকটি ধাপ উঠে আসে গ্রন্থের মার্চের দিনগুলোর স্মৃতিচারণে। ঊনিশ মার্চের দিনলিপি থেকে জানা যায়- একটি অভিনব স্টিকারের কথা। ‘একেকটি বাংলা অক্ষর একেকটি বাঙালির জীবন’। স্টিকারটি পরিকল্পনা ও ডিজাইন করেছিলেন পটুয়া কামরুল হাসান (২ ডিসেম্বর, ১৯২১ - ২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৮)। তিনি ‘বাংলার পটুয়া সমাজ’ বলে একটি সমিতিও গঠন করেন- যাঁরা শাপলা ফুলকে সঙগ্রামী বাঙলার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করবার প্রস্তাব দেয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্বকে তুঙ্গে তুলে দেয় ঢাকা টেলিভিশন। তখন এর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন শিল্পী মোস্তফা মনোয়ার (জন্ম: ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৫)। তেইশে মার্চের প্রতিরোধ দিবসে একটি অবিস্মরণীয় প্রতিবাদ হয় তাঁর নেতৃত্বে। রাত সাড়ে নয়টার মধ্যেই টেলিভিশনের অনুষ্ঠান শেষ হবার কথা থাকলেও- সেদিন অনুষ্ঠান চলে চব্বিশ মার্চের প্রথম প্রহর পর্যন্ত। জাহানারা ইমাম লিখেছেন এর পেছনের কারণটি। .. ..আজ দেখি মহোৎসব চলছে তো চলছেই। সুকান্তের কবিতার ওপর চমৎকার দুটো অনুষ্ঠান হলো। একটা- ‘ছাড়পত্র’, মোস্তফা মনোয়ারের প্রযোজনা। ডঃ নওয়াজেশ আহমদের ফটোগ্রাফির সঙ্গে কবিতার আবৃত্তি। আরেকটা- ‘দেশলাই’, বেলাল বেগের প্রযোজনা। সুকান্তের দেশলাই আবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে টিভি পর্দায় দেখা গেল অসংখ্য দেশলাইয়ের কাঠি একটার পর একটা জ্বলে উঠছে।.. ..এরপর শুরু হলো আবদুল্লাহ আল মামুনের এক নাটক- ‘আবার আসিব ফিরে’। .. ..নাটক ২৩ মার্চের রাত পৌনে এগারোটায় শুরু হয়ে শেষ হয় ২৪ মার্চের প্রথম প্রহরে। রাত বারোটা বেজে নয় মিনিটে ঘোষক সরকার ফিরোজ উদ্দিন সমাপনী ঘোষণায় বলেন- এখন বাংলাদেশ সময় রাত বারোটা বেজে নয় মিনিট- আজ ২৪ শে মার্চ বুধবার। আমাদের অধিবেশনের এখানেই সমাপ্তি। .. ..এতক্ষণে রহস্য বোঝা গেল। ২৩ মার্চ প্রতিরোধ দিবসে বীর বাঙালিরা টেলিভিশনের পর্দায় পাকিস্তানের পতাকা দেখাতে দেয়নি। (পৃষ্ঠা ৩৬) এ এক অবিস্মরণীয় প্রতিবাদ- মুক্তিযুদ্ধ কোনো বিছিন্ন ঘটনা নয়, একটি সুদীর্ঘ আন্দোলনের ফসল আর সে আন্দোলনের রশ্মি ছড়িয়েছিলো চারদিকে, স্পর্শ করেছিলো সমস্ত আকাশ। এ আন্দোলন ছিলো সর্বস্তরের জনগণের আন্দোলন- অধিকারের আন্দোলন। মার্চের অধ্যায়গুলোতে যদিও পাকিস্তানি বর্বর সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের টালবাহানার ইতিহাস বিধৃত হয়েছে, তবে যেহেতু দিনলিপি- সেহেতু ইতিহাসের সাল-তারিখ ধরে তা হয়তো আসেনি। কিন্তু বাঙালির স্বাধীনতার প্রস্তুতিপর্বকে যে পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী নানাভাবে প্রতিহত করতে চেয়েছে তার একটি ছোটো কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত পাওয়া যায় বাইশে মার্চের লেখায়। জাহানারা ইমামের জীবনসঙ্গী শরীফ ইমামের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখক লিখেছেন- মিরপুরে, চট্টগ্রামে, পার্বতীপুর-সৈয়দপুরে বাঙালি বিহারী খুনোখুনি রক্তারক্তি হচ্ছে- সেনাবাহিনী বিহারিদের উস্কানি আর সাপোর্ট দিচ্ছে। (পৃষ্ঠা ৩৪) পঁচিশে মার্চ তারিখের নৃশঙস গণহত্যার বিবরণ ছাব্বিশ মার্চ, শুক্রবার থেকে একত্রিশ মার্চ, বুধবার পর্যন্ত লেখাগুলোতে। সেখানে কামাল আতাউর রহমান নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগের এক স্নাতক পরীক্ষার্থীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বর্ণনা গা শিউরে উঠার মতো। উল্লিখিত শিক্ষার্থী মোহসীন হলের আবাসিক ছিলো- তাঁর জবানিতে জাহানারা ইমাম তুলে ধরেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণহত্যার বর্ণনা- তবে বিশদ অর্থে নয়। তবে ছাব্বিশে মার্চে লেখার একেবারে শেষ দুটো লাইনেই নৃশঙস গণহত্যার তীব্রতা লক্ষ্যণীয়। আবার আমরা সবাই নিচে নামলাম। দরজা খুলে উঠানে নেমে মিকির জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। মোমবাতির কাঁপা কাঁপা আলোয় দেখলাম মিকি মরে পড়ে আছে। (পৃষ্ঠা ৪২) মিকি তাঁদের গৃহপালিত কুকুরের নাম। একটি পশু- সেও সহ্য করতে পারেনি পঁচিশে মার্চের রাতের ভয়াবহতা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পশু বললেও- প্রাণীজগত লজ্জা পাবে। তিন দিনলিপির এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত অঙশে মুক্তিযুদ্ধের এক অবিনাশী তীব্রতা ধরা পড়ে। সেই থাকে উঠে আসে বিভিন্ন গণমাধ্যমের অপপ্রচার- নানা বিভ্রান্তির চিত্রও। চৌদ্দ এপ্রিলের লেখার শুরুটা বেশ চমকপ্রদ। রুমীর খুব মন খারাপ। (পৃষ্ঠা ৬১) কেনো মন খারাপ- সে আলোচনা জাহানারা ইমাম করেছেন, কিন্তু তার আগে রুমীর মনন বোধ ও পড়াশুনার একটি চিত্র উঠে এসেছে। রুমী আই.এস.সি পরীক্ষার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলো। সে হিসেবে তাঁর বয়স সহজেই অনুমেয়। কিন্তু এ সময়টাতেই তাঁর একটি দাঢ্য ব্যক্তিত্ব ও বোধ তৈরি হয়েছিলো। এর পেছনের কারণটি ছিলো তাঁর পড়াশুনা। জাহানারা ইমাম দশ মার্চে লিখেছেন- রুমীদের আলাপ-আলোচনার পরিধির মধ্যে পড়ে কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, মাও-সে-তুং। (পৃষ্ঠা ২৫) কেবল পড়াই নয়- তাঁর ধারণ ক্ষমতা ও বিচক্ষণতাও ছিলো প্রশঙসনীয়। জাহানারা ইমামের নন্দাই একরামের সঙ্গে তাঁর আলোচনাই সে স্বাক্ষ্য বহন করে। বাইশে মার্চে আমরা পাই- .. ..এই বয়সে এমন মাথা, এমন ক্লিয়ার কনসেপশান, বাউরে, আমি তো আর দেখি নাই। (পৃষ্ঠা ৩৩) বস্তুত সে কারণেই রুমীর মধ্যে একটি দূরদর্শিতা তৈরি হয়েছিলো; পঁচিশে মার্চের সকালে রুমীর সঙ্গে লেখকের আলাপচারিতায় আমরা দুটো বিষয় পাই। আম্মা বুঝতে পারছ না মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা ব্যর্থ হতে বাধ্য। এটা ওদের সময় নেবার অজুহাত মাত্র। ওরা আমাদের স্বাধীনতা দেবে না। স্বাধীনতা আমাদের ছিনিয়ে নিতে হবে সশস্ত্র সঙগ্রাম করে। .. .. তাহলে এখন উপায়? উপায় বোধ হয় আর নেই আম্মা। (পৃষ্ঠা ৩৭) উপায় সত্যিই ছিলো না। পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে বাঙালি প্রতিহত করে। মুক্তিযুদ্ধ হয় সে যুদ্ধের নাম। সে যুদ্ধে রুমীও একজন যোদ্ধা- বীর মুক্তিযোদ্ধা। রুমী তাঁর নিজের দুটো পরিচয় দিয়ে গেছে। একটি হলো সাতই মার্চের ভাষণের পর বাসায় এসে তাঁর বক্তব্যে- আমি কোনো দলভুক্ত নই, কোনো রাজনৈতিক দলের শ্লোগান বয়ে বেড়াই না। কিন্তু আমি সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন, মান-অপমান জ্ঞানসম্পন্ন একজন সচেতন মানুষ। (পৃষ্ঠা ২৩) তাঁর অন্য পরিচয়টি লেখার শেষের জন্যে তোলা রইলো। এই রুমী- সচেতন বোধ সম্পন্ন এক তরুণ; তাঁর মন খারাপের কথা আমরা জানতে পারি চৌদ্দই এপ্রিলে। এর কারণ হলো- চীন পাকিস্তানকে দৃঢ় সমর্থন দিয়েছে। লেখক লিখেছেন- চৌ এন লাই ঘোষণা করেছেন: স্বাধীনতা রক্ষার জন্য চীন সরকার পাকিস্তানকে পূর্ণ সহযোগিতা দেবে। .. ..প্রাণের বন্ধু বিপদের মুহূর্তে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। (পৃষ্ঠা ৬১-৬২) মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে চীন সরকারের ভূমিকা সবারই জানা- ইতিহাসেও লিপিবদ্ধ আছে। যদিও সেই বিশ্বাসঘাতক চীনের দালাল-মুরিদরা এখনও চৈনিক বাতাসে গা এলিয়ে দেয়। একই দিনের লেখায় জাহানারা ইমাম আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারনা করেছেন। দালালের প্রসঙ্গ যখন এসেই পড়লো, সেটিও আলোচনা হয়ে যাক- .. ..তিন চারদিন আগে ঢাকায় এক নাগরিক শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছে। কাগজে খুব ফলাও করে খবর ছাপা হচ্ছে। খাজা খায়রুদ্দিন এর আহবায়ক। সদস্য ১৪০ জন। তার মধ্যে স্বনামধন্য হচ্ছেন আবদুল জব্বার খদ্দর, মাহমুদ আলী, ফরিদ আহমদ, সৈয়দ আজিজুল হক, গোলাম আযম। (পৃষ্ঠা ৬২) তবে দালালদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে একটি চমৎকার অঙশ চোখে পড়বে আটাশ এপ্রিলের লেখার একেবারে শেষ অনুচ্ছেদে। .. ..আজ বিকেল চারটার সময় শান্তি কমিটির অন্যতম সদস্য জনাব আবদুল জব্বার খদ্দর বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। শ্রোতামণ্ডলী: তিনটি ট্রাফিক পুলিশ, একটি মিলিটারি পুলিশ এবং একটি আর্মি জওয়ান। (পৃষ্ঠা ৭০) রুমীর মুক্তিযুদ্ধে যাবার বিষয়ে জাহানারা ইমাম সম্মতি দেন একুশ এপ্রিল। তিনি লিখেছেন- .. ..দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা, তুই যুদ্ধে যা। (পৃষ্ঠা ৬৬) এরপর মন্ত্রের মতো করে আমরা পড়ে যাই কয়েকটি তারিখের দিনলিপি- আমাদের সামনে আসে লিয়ন উরিস এর লেখা ‘মাইলা-১৮’ আর কাহলিল জিবরানের ‘প্রফেট’ কবিতার অঙশ- যা বনি প্রিন্সের মতো প্রস্ফুটিত হয়ে আছে তেসরা মে- এর দিনলিপিতে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির উপর কী অবর্ণনীয় নির্যাতন হয়েছে- তা ‘একাত্তরের দিনগুলি’র পাতায় পাতায় উঠে এসেছে। বিশেষ করে জুলাই মাসের দিনলিপিগুলোতে মানবিক কষ্টের এক অসহ্য চিত্র উঠে আসে। সাত জুলাই তারিখের দিনলিপি পাঠে আমরা জাহানারা ইমামের জীবনসঙ্গী শরীফ ইমাম ও তাঁর বন্ধু বাঁকার দুঃসাহসিক অবদানের চিত্র পাই। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের অনুরোধেই সারা দেশের সবগুলো ব্রিজ কালভার্টের তালিকা বানানোর কাজ হাতে নেন তাঁরা। সেই সঙ্গে এগুলো ওড়ানোর ব্যাপারে কতোগুলো তথ্য। এখানে লক্ষ্য করতে হবে- মুক্তিযোদ্ধারা কেবল মুক্তিযুদ্ধই করেননি, স্বাধীনতার দুর্বার স্বপ্নকে তাঁরা বাস্তবতার ফ্রেমে বাঁধিয়েছিলেন। সে কারণেই তেসরা জুলাইয়ের লেখায় পাই- .. .ব্রিজের কোন কোন পয়েন্টে এক্সপ্লোসিভ বেঁধে ওড়ালে ব্রিজ ভাঙবে অথচ সবচেয়ে কম ক্ষতি হবে অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হবার পর খুব সহজে মেরামত করা যাবে.. .. (পৃষ্ঠা ১২৪) মুক্তিযুদ্ধের একচল্লিশ বছর পর প্রায়শই একটি প্রশ্ন মনে জাগে- পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী না হয় অন্ধ-বর্বর; কিন্তু সেখানকার সাধারণ জনগণ- তারা তো পারতো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে। আজকাল অনেকের কণ্ঠে ও কলামে অতীত ভুলে যাবার কুৎসিত নিনাদ বাজে- কিন্তু একটি প্রশ্নের উত্তর তারা এড়িয়ে যায়। যে মুক্তিযুদ্ধ সারাবিশ্বে আলোড়ন তৈরি করেছিলো, বিশ্ব গণমাধ্যমে যে গণহত্যার তীব্র নিন্দা হয়েছিলো- পাকিস্তানি জনগণ তা জেনেও কেনো প্রতিবাদ করলো না? এর উত্তর হলো- পাকিস্তানি জনগোষ্ঠীর ন্যাক্করজনক মানসিকতা এবঙ হীন মনোবৃত্তি। এরা মূলত অশিক্ষিত এবঙ অধিকাঙশই শিক্ষিতরাই খুব নিম্নমানের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে শিক্ষা অর্জন করেছে। ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে আমরা পাই- .. ..ও দিকের (পশ্চিম পাকিস্তানের) লোকেরা কি বি.বি.সি, ভয়েস অব আমেরিকা, রেডিও অস্ট্রেলিয়া এসব শোনে না? শোনে, কিন্তু বিশ্বাস করে না। ওরা সরকারের ছেলে ভুলানো ছড়া শুনেই সন্তুষ্ট (পৃষ্ঠা ১৩৪) চার আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের দিনলিপিগুলো একই সঙ্গে প্রগাঢ় বেদনা ও মহিমান্বিত বিজয়োল্লাসের দলিল। একাত্তরের নয় আগস্ট ছিলো শহিদ জননী জাহানারা ইমামের চতুর্বিঙশ বিবাহবার্ষিকী। তিনি খুব আশা করেছিলেন সামনের বছরের জন্যে, রজতজয়ন্তী উৎসবটা খুব ধুমধাম করে পালন করবার প্রত্যাশায় তিনি সেদিনের দিনলিপি লিখেছিলেন। কিন্তু ওই যে- ট্র্যাজিডি ছাড়া মহাকাব্য হয় না; তাই আর জানা হয়নি- রজতজয়ন্তীর উৎসবটা তিনি করেছিলেন কি না। কতোটা কান্নায় তিনি স্মৃতিচারণ করেছিলেন শরীফ ইমামের? মেলাঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের দিনগুলোর এক নিটোল বর্ণনা পাওয়া যায় বিশ আগস্টের লেখায়। সেখানেই রুমীর বক্তব্য থেকে উঠে আসে কণ্ঠশিল্পী আজম খানের কথা। এক ভীষণ সাহসী গেরিলা যোদ্ধা আজম খান ও তাঁর উদাত্ত কণ্ঠের গান- ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থের মাধ্যমে আমাদের সামনে আসে নতুন এক ছবি হয়ে- কিঙবদন্তীর মতো। আগস্টের লেখাগুলোতে আমরা রুমীদের গেরিলা অপারেশনের ইতিহাস জানি- আবার মনে পড়ে শামসুর রাহমানের ‘গেরিলা’ কবিতাটির শেষ পঙক্তি- তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন সন্তান আমার। রুমী ধরা পড়ে উনত্রিশ আগস্টে, সেদিন রবিবার ছিলো। যার নেতৃত্বে ‘রুটিন সার্চ’ এর কথা বলে রুমী-তাঁর বাবা শরীফ ইমাম- তাঁর অনুজ জামীর সাথে মাসুম ও হাফিজ নামের দুজন আত্মীয়কে ধরে নিয়ে যায় বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী, তার নাম ক্যাপ্টেন কাইয়ুম। তারপর গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে রুমীকে আলাদা করে নেয় পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী। একত্রিশে আগস্ট ফেরত আসে সবাই- কেবল রুমী আসেনি। সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখেও কী অটল দৃঢ় ছিলো রুমী ও তাঁর সহযোদ্ধারা, তার একটি সাহসী আখ্যান ‘একাত্তরের দিনগুলি’। তবে এই আখ্যান কেবল রুমী ও তাঁর সহযোদ্ধাদের ঘিরে আবর্তিত হলেও এ দৃশ্য ছিলো সমগ্র বাঙলার আপামর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান- রক্তজবার মতো একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রত্যেকেই অজেয় সাহসের অনিন্দ্য সমার্থক। পহেলা সেপ্টেম্বরের লেখাটি বন্দী-নির্যাতনের দলিল- একেবারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোক প্রতিলিপি যেনো। সুরকার শহিদ আলতাফ মাহমুদকে তুলে নিয়ে যাবার ইতিহাসও পহেলা সেপ্টেম্বরের দিনলিপিতে জীবন্ত। ‘স্টেটম্যান্ট’ নেবার নাম করে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর নৃশঙস অত্যাচারের মাঝেও বাঙালি ছিলো অটল, ছিলো শাশ্বত সৌহার্দ্যরে ছায়া। পহেলা সেপ্টেম্বরের দিনলিপিতেই পাই- মেঝেয় মরার মতো ঘুমোনো লোকগুলো হঠাৎ সবাই একসঙ্গে উঠে বসে, হৈ হৈ করে নতুন বন্দীদের নাম, কুশল জিজ্ঞেস ক’রে সেবা-যত্ন করা শুরু করে দেয়। কার কোথায় ভেঙেছে, কোথায় রক্ত পড়ছে, কোথায় ব্যথা- খোঁজ নিয়ে কাউকে ব্যান্ডেজ করে, কাউকে ম্যাসাজ করে, কাউকে নোভালজিন খাওয়ায়। প্রথম চোটে সবাইকে পানি খাওয়ায়। যারা সিগেরেট খায় তাদের সিগেরেট দেয়। (পৃষ্ঠা ১৯২) চার সেপ্টেম্বর, শনিবারের লেখায় আমরা পাই বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের (মূল গ্রন্থে বানান লেখা হয়েছে মতিয়ুর রহমান) ইতিহাস। একই সঙ্গে এই ঘটনাকে একত্রিশ আগস্টের দৈনিক পাকিস্তান কীভাবে ব্যাখ্যা করেছিলো- তাও উল্লেখ আছে। পাকিস্তানের বর্বর সরকার মতিউর রহমানকে বিশ্বাসঘাতক বলেছিলো- এই প্রসঙ্গেই জাহানারা ইমাম লিখেছিলেন- যদি কোনোদিন পূর্ব বাংলার এই ভূখণ্ড স্বাধীন হয়, তবে মতিয়ুর রহমান- সেই স্বাধীন দেশ নিশ্চয়ই তোমাকে সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক খেতাবে ভূষিত করবে। (পৃষ্ঠা ১৯৯) বইটি পড়তে পড়তে একটি বিষয় সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যেতে পারে- অন্তত ব্যক্তিগতভাবে আমার সেই ধারণাটিই হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ যতোই বেগবান হচ্ছিলো, মূঢ় শত্রুর ঘাঁটি যতোই গেরিলাদের অভেদ্য লক্ষ্যে চূর্ণ-বিচূর্ণ হচ্ছিলো, ততোই বাঙালির চেতনা ও মনস্তত্ত্ব হয়ে উঠছিলো টনটনে। এর অনেকগুলো প্রমাণই ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে রয়েছে। বিশেষ করে একুশে অক্টোবরে লেখা শেষ অনুচ্ছেদটি তারই চিহ্ন বহন করে- ফখরুজ্জামানের কেবিনে ঢুকে দেখি ডা. ফজলে রাব্বি তাকে দেখতে এসেছেন। শুনলাম ফখরুকে রাব্বি বলছেন, ‘যান, ভালো হয়ে ফিরে আসুন। এসে দেখবেন আমরা হয়তো অনেকেই নেই’। (পৃষ্ঠা ২২১) ঘটেছিলোও তাই- ডা. ফজলে রাব্বিকে আল-বদর বাহিনী হত্যা করে বিজয়ের প্রাক্কালেই। শহিদ রুমীর পরিবারের দৃঢ়তা এবঙ তাঁর আদর্শের প্রতি সম্মান প্রদর্শন পাঠককে যারপরনাই মুগ্ধ করে। সন্তানের আদর্শের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেই পাকিস্তানি সরকারের কাছে দয়া প্রদর্শনের আবেদন করেনি রুমীর পরিবার। প্রতিবাদ আর আদর্শের লড়াইয়ের এ এক অবিনশ্বর স্মারক। শরীফ ইমামের জন্মদিন ছিলো ত্রিশ অক্টোবর। জীবনসঙ্গী জাহানারা ইমাম তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন বায়তুল মোকাররমের ফুটপাতের দোকান থেকে সুন্দর চিকন কাজ করা সাদা একটি টুপি আর অন্ধকারে আলোর আভা দেখা যায়- এমন একটি তসবি। কিন্তু জামীর উপহারটা ছিলো অনন্য- ‘বিচ্ছু অ্যাকশানের একটা খবর’। তেরো ডিসেম্বরের লেখার মাঝামাঝি অঙশে আমরা প্রথম শরীফ ইমামের অসুস্থতার সঙবাদ পাই। আর চৌদ্দ ডিসেম্বরের শুরুর দুটি অনুচ্ছেদেই পাই তাঁর মৃত্যুর সঙবাদ। চারজনের পরিবারের দুজন অনন্তলোকে, বাকি দুজন- মা আর সন্তান রইলেন নতুন বাঙলাদেশকে বরণ করে নেবার জন্যে। তাই সতেরো ডিসেম্বর, শুক্রবারের লেখায় শহিদ জননী লিখছেন- চুল্লু এতদিন সেন্ট্রাল জেলে ছিল। ওকে জেল থেকে বের করে এনে রুমীর অনুরাগী এই মুক্তিযোদ্ধারা রুমীর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। (পৃষ্ঠা ২৭০) ‘একাত্তরের দিনগুলি’ মুক্তিযুদ্ধের এক কালানুক্রমিক ইতিহাস। ইতিহাসটি রচনা করেছেন এমন একজন- যিনি ও তাঁর পরিবার মুক্তিযুদ্ধের এক সাহসী প্রত্যয়াঙশ। যদিও দিনলিপি- অর্থাৎ ব্যক্তিগত শোকস্মৃতি, তবুও তা অনন্ত হয়ে যেনো জেগে রয়েছে আমাদের সকলের অনুভূতির সঙ্গে। বইটির গ্রন্থস্বত্ব ‘একাত্তরের দিনগুলি’ স্মারক ট্রাস্টের এবঙ আগেই উল্লেখ করেছি অষ্টাবিঙশতি মুদ্রণ (রজতজয়ন্তী সঙস্করণ) থেকে এই আলোচনাটি লেখা হয়েছে। কেবল ইতিহাসের সত্য নির্যাসটুকু নয়, উপস্থাপনার ধরণেও ‘একাত্তরের দিনগুলি’ সাহিত্যমান সম্পন্ন। বইয়ের বিভিন্ন্ স্থানে ব্যবহৃত বাগধারা-প্রবাদ প্রবচন-পুরাণ নির্ভর শব্দের সার্থক প্রয়োগ তার নমুনা। উদাহরণস্বরূপ- .. ..বলা যেতে পারে সবে ধন নীলমণি (পৃষ্ঠা ১১) .. ..পূর্ব পাকিস্তানে ভীমরুলের চাকে ঢিল ছুঁড়েছে (পৃষ্ঠা ১৪) .. ..দেখছো না, এখন উলট-পুরাণের যুগ চলছে (পৃষ্ঠা ২০) পড়াশোনা এতদিন শিকেয় তোলা ছিল, এবার টংয়ে উঠল। (পৃষ্ঠা ২০) ওটা থাকলে লখিন্দরের লোহার ঘর বানিয়েও লাভ নেই (পৃষ্ঠা ৩১) .. ..আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে জ্বলন্ত বালিতে খৈ ফুটছে (পৃষ্ঠা ৩৪) .. ..মাছের মাকে নাকি শোক করতে নেই (পৃষ্ঠা ৮২) কানু ছাড়া গীত নেই (পৃষ্ঠা ৮৩) যার কাজ তারে সাজে, অন্য লোকে লাঠি বাজে (পৃষ্ঠা ১০২) সরু চুলে বাঁধা ডেমোস্থিনিসের খাঁড়া ঝুলছে মাথার ওপর (পৃষ্ঠা ১২৪) একা রামে রক্ষা নাই, সুগ্রীব দোসর? (পৃষ্ঠা ২৪২) কয়েকটি স্থানে এর মুদ্রণ প্রমোদ অত্যন্ত অমার্জনীয় মনে হয়েছে। বিশেষ করে যে প্রবাদপ্রতিম মানুষটিকে ঘিরে এই আখ্যান- শহিদ রুমী, তাঁর নামের বানানে কখনো রুমি (পৃষ্ঠা ১৪) আবার কখনো রুমী ব্যবহারটা অবশ্যই দৃষ্টিকটু- যদিও তাঁর নামের সঠিক বানান রুমী। তাছাড়া আরও কয়েকটি স্থানের মুদ্রণ প্রমোদ চোখে পড়ার মতো। উদাহরণস্বরূপ- শে-াগান- যার সঠিক রূপ ‘শ্লোগান’ (পৃষ্ঠা ১৫) এতে পানি কেন?- যার সঠিক রূপ ‘এতো পানি কেন?’ (পৃষ্ঠা ৬৭) এখনো আছে নি- যার সঠিক রূপ ‘এখনো আসে নি’ (পৃষ্ঠা ১১১) প্রবোধকুমার স্যান্যাালের- যার সঠিক রূপ হবে ‘প্রবোধকুমার স্যান্যালের’ (পৃষ্ঠা ১১২) উদ্দার- যার সঠিক রূপ হবে ‘উদ্ধার’ (পৃষ্ঠা ১৯৬) বন্ধু-বান্ধুব- যার সঠিক রূপ হবে ‘বন্ধু-বান্ধব’ (পৃষ্ঠা ২৪৪) ‘ছাপাখানার ভূত’ সম্বন্ধে পাঠক অবশ্যই সচেতন, তবে অষ্টাবিঙশতি মুদ্রণেও যদি এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হয়- তবে ভূত তাড়ানো ওঝার বিকল্প দেখা বাঞ্ছনীয়। পাঁচ বলেছিলাম- শহিদ রুমীর দুটো পরিচয় তিনি নিজেই দিয়ে গেছেন; প্রথমটি উল্লেখ করা হয়েছে- আর দ্বিতীয়টি পাওয়া যায় ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থেই। রুমীর ছবির মাঝে জীবনানন্দ দাশের কবিতার পঙক্তি- আবার আসিব ফিরে.. .. এই রুমী- তিনি কথা দিয়ে গেছেন, তিনি আবার আসবেন এই বাঙলায়। শহিদ জননী একত্রিশে অক্টোবরের দিনলিপির শেষ লাইনে লিখছেন- .. ..রুমী নেই, বদি নেই, জুয়েল নেই কিন্তু যুদ্ধ আছে- স্বাধীনতার যুদ্ধ। (পৃষ্ঠা ২৩২) এই স্বাধীনতা যুদ্ধের অমোঘ বলয়েই দৃঢ় সঙগ্রামের প্রতীক হয়ে আছেন মুক্তিযোদ্ধারা; আর তাঁদের বিস্ময়কর অবদানে ঋদ্ধ হয়ে আছে আমাদের বাঙলাদেশ। ‘একাত্তরের দিনগুলি’ আমার সবচেয়ে প্রিয় বইগুলোর একটি। আমি আমার সাধ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি এর আলোচনাটি লিখবার। বস্তুত সে কারণেই- লেখাটি দীর্ঘ হয়েছে। একাত্তর সালে সাতকোটি বাঙালির যৌথ খামারে রচিত হয়েছিলো যে মুক্তিযুদ্ধ, আজ দীর্ঘ একচল্লিশ বছর পরও সেই ইতিহাসের কার্নিশেই নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচে ষোলো কোটি বাঙালি এবঙ আগামীতেও বাঙালি বেঁচে থাকবে তার এই ঋদ্ধ ইতিহাসের করতলে। যদি কোনোদিন এই ইতিহাসের সত্যপথ থেকে তার পদস্খলন ঘটে- সেদিনই নিঃশেষ হবে বাঙালি; তাই ‘একাত্তরের দিনগুলি’ আমাদের পথপ্রদর্শক, আমাদের অনুপ্রেরণার অখ- আকাশ। আমি প্রতীক্ষায় রইলাম- ‘একাত্তরের দিনগুলি’র হীরকজয়ন্তী সঙস্করণ নিয়ে কোনো একটি আলোকোজ্জ্বল মেধাবী আলোচনার নিবিড় সৌন্দর্যে বিলীন হয়ে যাবে আমার এই ব্যর্থ আলোচনাটি। আমি ব্যর্থতা সেদিন সুখী হবে। সৌন্দর্যে বিলীন হবার চেয়ে সুখ আর নেই।