User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
শিক কাবাব, ঢাকাই পরোটা, মুরগী মুসল্লম, আলু গোস্ত, মাংসের কোরমা, পেঁয়াজ-ঘিয়ে দুম্বার মাংস, বোম্বাই সাইজ শামী কাবাব, কোফতা-পোলাও, আস্ত মুরগি রোস্ট... দাঁড়ান, দাঁড়ান! ভাববেন না খাবারের রেসিপি লিখতে বসেছি। এটা শতভাগ বইয়ের রিভিউ। কিন্তু বইটা পড়তে গিয়ে এরকম অসংখ্য খাবারের নাম বারবার সামনে এসেছে। মনোযোগ দিয়ে পড়ার সময় যদি এমন সব খাবারের বর্ণনা চোখে পড়ে, কেমন লাগে বলুন! পেটটা কি খিদেয় মোচড় দিয়ে ওঠে না? আমার বেলায় তো পেটে ইঁদুরের লাফালাফি শুরু হয়েছিল! তবে সত্যি বলতে কী, বইয়ের সবকিছুই ভীষণ উপভোগ্য ছিল। পড়তে কোনো অসুবিধা হয়নি। বরং নেহারিতে থাকা অমৃত সমান মজ্জারসের মতো গিলে-শুষে খেয়েছি প্রতিটি পৃষ্ঠা। রম্য সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম সৈয়দ মুজতবা আলী। তার লেখা ‘দেশে বিদেশে’ বইটি বাংলা ভাষার অন্যতম জনপ্রিয় ভ্রমণ কাহিনি, যা ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সালের আফগানিস্তান ভ্রমণের উপর রচিত। এ বইটিকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ভ্রমণ কাহিনি হিসেবে গণ্য করা হয়। আজ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে অন্য কোনো ভ্রমণ কাহিনি এর মতো এতটা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। সৈয়দ মুজতবা আলী মাত্র তেইশ বছর বয়সে শান্তি নিকেতন থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর তিনি আফগানিস্তানের কাবুল কৃষি কলেজে ইংরেজি এবং ফারসী ভাষার শিক্ষক হিসেবে শুরু করেন কর্মজীবন। তার স্বপ্ন- কাবুলে অধ্যাপনা করে যে অর্থ সঞ্চয় হবে, পরবর্তীতে সেটা ব্যবহার করে উচ্চতর শিক্ষার জন্য জার্মানি যাবেন। দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে এক বাঙালি যুবকের পশ্চিম ভারত থেকে আফগানিস্তান যাত্রাকালের স্মৃতি বিজড়িত, অভিজ্ঞতাপূর্ণ, জীবন গল্পের লিপিবদ্ধ রূপ ‘দেশে বিদেশে’। কলকাতা হতে পেশাওয়ার, খাইবার পাস হয়ে জালালাবাদ, কাবুল যাত্রা এবং কাবুলে শিক্ষকতা কালীন সময়ের জীবন-যাপন নিয়েই মূল কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। লেখকের যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা, স্থানীয় ইতিহাস ঐতিহ্য এবং কাবুলের স্মৃতিকথা- এই তিনটি বিষয়ের উপর পুরো বইটি রচিত। হাওড়া স্টেশন থেকে রেলগাড়িতে চড়ে পেশাওয়ার পথের যাত্রা কাহিনি দিয়ে গল্প শুরু। হাস্যরসপ্রিয় তরুণ লেখক একের পর এক বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন। স্থান, কাল, পাত্র কিচ্ছু বাদ যাওয়ার জো নেই। এর মাঝেই এক বিলেতি সাহেবের কাছ থেকে ভোজের নেমন্তন্ন। বাঙালি হিসেবে লেখকও কম যান না। নিজের খাবার নিয়ে মিলেমিশে খেতে বসলেন। বাকি পথে সফর সঙ্গী হলেন এক সর্দারজিসহ বেশ কয়েকজন পাঠান। শুরু হলো আড্ডা। দুনিয়ার নানান গল্প পাঠানদের ঝুলিতে। অদ্ভুত সেই গল্পের সত্য-মিথ্যা নিয়ে লেখক যখন সন্দিহান, তখন সর্দারজি দারুণ এক উদাহরণ টেনে বললেন- “গভীর বনে রাজপুত্তুরের সঙ্গে বাঘের দেখা। বাঘ বলল, আমি তোমাকে খাবো। এ হলো গল্প। তাই বলে বাঘ মানুষ খায় সেও কি মিথ্যা কথা?” তর্ক-গল্পে লেখক কুপোকাত হলেন। সর্দারজির হাত থেকে রক্ষা পেলেন পেশাওয়ার পৌঁছানোর পর। তবে পাঠান মুলুকে প্রবেশ করে বন্ধুবর শেখ আহমদ আলীর জিম্মায় পড়লেন। দু-তিনদিনের সফর গিয়ে দাঁড়ালো এক সপ্তাহে। কোনোভাবেই আহমদ আলীর আতিথিয়েতা উপেক্ষা করার সুযোগ হলো না। পেশাওয়ার শহর, সেখানকার মানুষ, তাদের ইতিহাস কপচে অষ্টম দিনে মুক্তি মিলল। কিন্তু লেখকের কপাল বলে কথা! পেশাওয়ার থেকে বন্ধু আহমদ আলী তাকে যে মুড়ির টিনে তুলে দিলেন তার ড্রাইভার ষাটোর্ধ্ব বয়সী এক শিখ সর্দারজি, নাম অমর সিং। জানতে পারলেন, অভিজ্ঞ এই ড্রাইভার সাহেব চোখ বন্ধ অবস্থাতেও কাবুল পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। সমস্যা শুধু একটাই। তিনি রাতকানা মানুষ! এর পরের যাত্রা রীতিমতো শ্বাসরুদ্ধকর। নুড়ি পাথর, কাঁচা ভাঙা রাস্তা, অসম্ভব গরম, পাহাড় মরুভূমি পেরুনোর যে ভয়ংকর বর্ণনা পাওয়া যায়, তাতে কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে। সর্দারজির পাশে কোনোরকমে জান হাতে নিয়ে বসে লেখক যেভাবে খাইবাস পাস এলাকা অতিক্রম করলেন, তা যেন পুলসিরাত পার করার মতো উত্তেজনায় ভরপুর। স্মরণ করিয়ে দিই, যে সময়কার অভিজ্ঞতা-স্মৃতি তুলে ধরা হয়েছে সেটা আজ থেকে প্রায় ৯০ বছর পূর্বেকার। পেশাওয়ারের সুদীর্ঘ এই যাত্রার প্রথম বিরতি পাওয়া গেল জালালাবাদ পৌঁছানোর খানিক আগে। মরুপ্রান্তরে নিরাপত্তা প্রহরী সজ্জিত বিশাল এক দুর্গের সামনে এসে থামলো গাড়ির চাকা। জানা গেল, পাসপোর্ট না দেখিয়ে দুর্গ অতিক্রমের সুযোগ নেই। কৌতুহল এবং আগ্রহ নিয়ে লেখক সাহেব গাড়ি থেকে নেমে প্রথমে বাঁ পাশের কাবুল নদী দেখে মুগ্ধ হলেন। এরপর দুর্গে ঢুকে কর্মরত অফিসারের ব্যবহার ও আতিথিয়েতায় মুগ্ধ হলেন আরেক দফা। তাদের আলাপচারিতায় বেদনাবিধুর জীবনের কথা উঠে আসে। বিশেষ করে এই অংশটি হৃদয়স্পর্শী- “আমি (লেখক) আমার ভাঙা ভাঙা ফারসীতে জিজ্ঞাসা করলুম, সঙ্গীহীন জীবন কি কঠিন বোধ হয় না? (অফিসার) বললেন, আমার চাকরী পল্টনের, ইস্তফা দেবার উপায় নেই। কাজেই বাইরের কাবুল নদীটি নিয়ে পড়ে আছি। রোজ সন্ধ্যায় তার পাড়ে গিয়ে বসি আর ভাবি যেন একমাত্র নিতান্ত আমার জন্য সে এই দুর্গের দেয়ালে আঁচল বুলিয়ে চলে গিয়েছে।” যাত্রাপথে লেখকের বক্তব্যে বিভিন্ন জানা-অজানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসে। সেসময়ে আফগানিস্তানের ইতিহাস তেমন লেখা হয়নি। তাদের প্রাচীন ইতিহাস পোঁতা আছে সে দেশের মাটির তলায় আর ভারতবর্ষের পুরাণ মহাভারতে। আফগানিস্তান গরীব দেশ। ইতিহাস গড়ার জন্য মাটি ভাঙবার ফুরসৎ আফগানদের নেই। মাটি যদি তারা নিতান্তই খোঁড়ে, তবে সেটা কাবুলী মোন্-জো-দড়ো বের করার জন্য, নয়তো কয়লার খনি পাবার আশায়। পুরাণ ঘাঁটাঘাঁটি করার মত পাণ্ডিত্য কাবুলীর তখনো হয়নি। তাদের পূর্বসূরীদের তথ্য ঘাটতে গেলেও বিপদ। দক্ষিণে (আধুনিক) মধ্য ও দক্ষিণ-আফগানিস্তান তথা পশ্চিম-ভারতের গ্রীক রাজাদের কোনো ভালো বর্ণনা পাবার উপায় নেই। শুধু এক বিষয়ে ঐতিহাসিকের তৃষ্ণা তাঁরা মেটাতে জানেন। কাবুল থেকে ত্রিশ মাইল দূরে বেগ্রাম উপত্যকায় এঁদের তৈরি হাজার হাজার মুদ্রা প্রতি বৎসর মাটির তলা থেকে বেরোয়। খ্রীষ্টপূর্ব ২৬০ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ১২০ রাজ্যকালের ভেতর অন্তত ঊনত্রিশজন রাজা ও তিনজন রানির নামচিহ্নিত মুদ্রা এযাবৎ পাওয়া গেছে। এগুলোর উপরে গ্রীক ও খরোষ্ঠী এবং শেষের দিকের মুদ্রাগুলোর উপরে গ্রীক ও ব্রাহ্মী হরফে লেখা রাজারানির নাম পাওয়া যায়। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির কথা পুরো বইজুড়েই। তবে লেখকের সাবলীল বর্ণনা আর প্রাঞ্জল উপস্থাপনায় সেগুলো পড়তে বেগ পেতে হয় না। সেইসাথে প্রবল রসবোধ আর হাস্যরসাত্মক ঘটনা তো আছেই। বইয়ের চৌদ্দতম অধ্যায় পর্যন্ত ভ্রমণ যাত্রার বর্ণনা পাওয়া যায়। মূলত পনেরোতম অধ্যায় থেকে কাবুলের গল্প শুরু। এখান থেকে বইটিকে আর ভ্রমণকাহিনি মনে হয় না। বরং পরিণত হয় স্মৃতিকথায়। তখনকার মানুষের সামাজিক অবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অবস্থার বিশদ বিবরণ মেলে। একারণেই হয়তো বইটিকে বলা হয়েছে আফগানিস্তানের লিখিত দলিল। এবার কাহিনি যত এগোয়, কাবুলের রূপরস ততটাই সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। আফগানদের জাতি-উপজাতি, সংস্কৃতি, ভূ-প্রকৃতির বর্ণনার পাশাপাশি তাদের জীবন-যাপন, ভাষা, খাদ্যাভাস, ইত্যাদির সঙ্গে পরিচয় মেলে। লেখক যখন ফুল-ফলের বর্ণনা দেন, তার ঘ্রাণও যেন নাকে এসে লাগে। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সী, আরবিসহ যতগুলো ভাষার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়; সবগুলোর মাঝে লেখক এক অদ্ভুত মেলবন্ধন তৈরি করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ওমর খৈয়াম, কবি সাদী, বৈষ্ণব পদাবলীসহ অসংখ্য চেনা-অচেনা ব্যক্তিবর্গের কবিতা, গান, প্রবাদ, বক্তব্যকে প্রাসঙ্গিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। লেখক কাবুল শহরে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। যার কারণে বিভিন্ন দেশের শিক্ষক, গভর্নর, ক্ষমতাশীল মানুষদের সঙ্গে তার ওঠা-বসা ছিল। তখনকার শিক্ষা ব্যবস্থার দৃশ্য অতটা সহজ স্বাভাবিক ছিল না। সভ্য দেশের শহরবাসীরা গ্রামের জন্য স্কুল, হাসপাতাল, রাস্তা-ঘাট বানিয়ে দিয়েছিল। কাবুলের গ্রামে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। কতকগুলো ছেলে সকালবেলা গাঁয়ের মসজিদে জড়ো হয়ে গলা ফাটিয়ে আমপারা মুখস্থ করে- এই হলো বিদ্যা চর্চা। তাদের তদারককারী মোল্লাই গাঁয়ের ডাক্তার। অসুখ-বিসুখে তাবিজ-কবচ তিনিই লিখে দেন। ব্যামো শক্ত হলে পানি-পড়ার বন্দোবস্ত করেন আর মরে গেলে তিনিই তাকে নাইয়ে ধুইয়ে কবর দেন। মোল্লার ভরণ-পোষণ করে গাঁয়ের লোকজনই। এই ছিল তখনকার অবস্থা। আফগানিস্তানের শাসন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেন রাজা-বাদশারা। ক্ষমতাশীলদের মাঝে দ্বিধা দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে সবসময়। লেখকের বর্ণনাতেই সেসময়কার ক্ষমতার পালাবদলের বীভৎস দৃশ্য ফুটে উঠেছে। বাদশাহ হাবিবুল্লাহ, রাজা আমান উল্লাহ, রাজার বড়ভাই মুইন-উস-সুলতান যে যেভাবে পেরেছে ক্ষমতার কলকাঠি নেড়েছে। বিশেষ করে আমান উল্লাহর ইউরোপ ভ্রমণ এবং পরবর্তীতে ইউরোপের আদলে আফগানিস্তান সংস্কার শুরু করলে লেজে-গোবরে অবস্থা তৈরি হয়। তার অদ্ভুত সব নিয়ম-কানুনের কাছে কাবুলের সাধারণ জনগণ অসহায় বোধ করে। সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। কাঠের শেষ পেরেক ঠুকে দেয় বাচ্চা নামক ডাকাত সর্দার। তার আকস্মিক আক্রমণে কাবুল শহর লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। ডাকাতের ক্ষমতার কাছে পরাজিত হয়ে রাজা আমান উল্লাহ পালিয়ে যায়। শাসন ক্ষমতা কিছুদিন মুইন-উস-সুলতান এর উপর সোর্পদ হলেও শেষ পর্যন্ত সেও পালিয়ে যায়। শহরে লুটপাট ও অচলাবস্থা তৈরি হবার পর বিদেশি কূটনৈতিক যারা ছিলেন তারা একে একে দেশ ছাড়েন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ভারতীয় ও অন্যান্য বিদেশি শিক্ষকেরা আটকা পড়ে যান। এই সময়টাতে তাদের দুঃখ-দুর্দশার অন্ত রইল না। একদিকে যেমন খাদ্য সংকট, অপরদিকে মৃত্যুভয়। এমন দুর্বিষহ অবস্থার ভুক্তভোগী ছিলেন লেখক নিজেও। পরবর্তীতে বহু কষ্টে নিজের দেশে ফেরার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু যে ভ্রমণের শুরুটা হয়েছিল অতি আনন্দে, সেটা শেষ হয়েছে কষ্ট এবং লাঞ্ছনায়। আফগানিস্তান ও তার শহর কাবুল পর্বের ইতি টানবো একজন বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের পরিচয় দিয়ে। তার নাম আবদুর রহমান। সহজ সরল অথচ শত গুণের অধিকারী এই মানুষটি লেখকের কাবুলে পদার্পণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাশে ছিল। বিশালদেহী আবদুর রহমানের উচ্চতা ছ’ফুট চার ইঞ্চি, যা লেখক নিজের হাতে ফিতা দিয়ে মেপে দেখেছেন। রান্নাবান্না, ঘরের কাজকর্মসহ প্রায় সবকিছু দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল তার একার কাঁধে। বিনা প্রশ্নে বিনা সঙ্কোচে যেকোনো কাজ সাফল্যের সঙ্গে সম্পাদন করতো। তার কাছে অসাধ্য বলতে কিছুই ছিল না। লেখক তাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বলেছেন ‘হরফন-মৌলা’ বা ‘সকল কাজের কাজী’। আবদুর রহমান শুধুমাত্র লেখকের কর্মচারী ছিল না। সে ছিল বন্ধু বা ভাইয়ের সমান। যার হৃদয় বরফের থেকেও শুভ্রতর। বিশাল এই পৃথিবী অসংখ্য সীমারেখায় বিভক্ত। প্রতিটি সীমারেখার মাঝে আবার অসংখ্য মানুষের বসবাস। জাতিগত, প্রথাগত, সংস্কৃতি, ধর্ম, শিক্ষা-দীক্ষা, আচার ব্যবহার, অভ্যাসে কত শত ভিন্নতা। কিন্তু ভিন্নতার মাঝেও মিল থাকে। থাকাটাই স্বাভাবিক। দিনশেষে আমরা মানুষই তো। তবে ভূ-খণ্ড আর প্রকৃতির যে পরিবর্তন, সেটা মানুষকে এবং তাদের জীবনকে করেছে বৈচিত্রময়, রহস্যময়। সেই রহস্য ও বৈচিত্র কারও নজর এড়ানোর সুযোগ নেই। মানবজীবনে এগুলো এক ধরনের অভিজ্ঞতা। যা জীবনকে পরিণত করে। লেখক তার ভ্রমণ জীবনের এমন অভিজ্ঞতাকে অবহেলায় হারিয়ে যেতে দেননি। বরং যত্নের সঙ্গে লিপিবদ্ধ করেছেন। সময়, স্থান ও কালের আপন মহিমায় ‘দেশে বিদেশে’ ভ্রমণ কাহিনি হওয়া সত্বেও এটি আফগানিস্তানের লিখিত ইতিহাসের একটি অনবদ্য দলিল হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে। লেখকের রম্য রসাত্মক বর্ণনা, পরিচিত কিংবা অপরিচিত মানুষের সাথে রসালাপ, ঘটনার চমৎকার উপস্থাপন, ভ্রমণের সময় বিভিন্ন স্থানের বর্ণনা এবং শেষ পর্যায়ে এসে আফগানিস্তান ছেড়ে আসার করুন স্মৃতি অসাধারণভাবে তুলে ধরা হয়েছে এই ভ্রমণ কাহিনিতে। সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘দেশে বিদেশে’ বাংলা সাহিত্যকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি কুঁড়িয়েছে কালজয়ী সাহিত্যের খেতাব। জীবনে একবার হলেও চমৎকার এই বইটি সকলের পড়া উচিত। হ্যাপি রিডিং। . বই: দেশে বিদেশে লেখক: সৈয়দ মুজতবা আলী প্রচ্ছদ: খালেদ চৌধুরী ধরন: ভ্রমণকাহিনি প্রকাশনী: স্টুডেন্ট ওয়েজ পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২০৮ মলাট মূল্য: ২৫০ টাকা
Was this review helpful to you?
or
#রকমারি_বইপোকা_রিভিউ_প্রতিযোগিতা বইয়ের নাম --- দেশে বিদেশে লেখক—সৈয়দ মুজতবা আলী প্রকাশনী—স্টুডেন্ড ওয়েজ ( বর্তমানে অবশ্য বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র রিপ্রিন্ট শুরু করেছে ) ধরন—ভ্রমনকাহিনি মূল্য – ২৫০ টাকা ( ২৫% অফে রকমারিতে মূল্য ১৮৮ টাকা ) বাংলা সাহিত্যে যদি ‘ভ্রমণসাহিত্যের অলিখিত সম্রাট’ বলে কেউ থাকেন , তবে আমার মতে সেটা সৈয়দ মুজতবা আলীর হওয়া উচিত । ভ্রমণসাহিত্য বললে আমাদের মনে সাধারনত ভাসে সেই চিরাচরিত গৎ -বাধাঁ রুটিন , আর তা হল --- লেখকের জার্নি কিভাবে হল , কোনো টুরিস্ট স্পট কিংবা প্রাকৃতিক দৃশ্যের সামনে লেখক এর দাঁত বের করা হাসি ( :P কিংবা অবস্থাভেদে মুখগম্ভীর করা ; যদি তিনি একটু বয়স্ক হয়ে থাকেন ) , সেই জায়গার কয়েকজন বাচ্চাকাচ্চার সাথে ছবি তোলা , খাওয়াদাওয়ার বিবরন , তারপর রিটার্ন জার্নির কাহিনি এবং জায়গাটি যে আসলে কত সুন্দর তা এক-দুলাইনে প্রসব করা--- এই হল সংক্ষেপে । :P ভ্রমনসাহিত্য আমার ভাল লেগেছে যাদের তাদের মধ্যে সৈয়দ মুজতবা আলী , মঈনুস সুলতান , হুমায়ুন আহমেদ এরা উল্লেখযোগ্য । তবে আজকে আমি মুজতবা স্যারের ‘দেশে বিদেশে’ বইটা নিয়ে কথা বলব । দেশে বিদেশে --- নামটা শুনলেই মনে হয় যেন লেখক অসংখ্য দেশের ভ্রমনকাহিনি একত্র করেছেন । আমি আরো ভেবেছিলাম যে উনার ‘জলে-ডাঙ্গা’ বইটির দ্বিতীয় অংশটুকু , মানে সিকুয়াল হচ্ছে এটি । তাই বইটি প্রথম কেনার পরে হতাশই হয়েছিলাম । কিন্তু বইটির প্রথম পাতাতেই ডুবে গিয়েছিলাম এর রস-রসিকতায় পরিপূর্ন সংলাপে আর কাহিনিতে । কাহিনীর শুরু হয় লেখকের ট্রেনের সঙ্গী একজন ফিরিঙ্গি সাহেবের সাথে । কথায় কথায় তাদের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেলে একজন আরেকজনের সাথে খাবার লেখকের ভাষায় “ব্রাদারলি ডিভিশন “ করে নিতে রাজি হন । এরপরের অংশটুকু বই থেকেই তুলে দিচ্ছি --- “ সন্ধ্যা হতে না হতেই সায়েব এক প্রকান্ড চুবড়ি( টিফিনবক্স ) খুলে বলল, তার ‘ফিয়াসে’ নাকি উৎকৃষ্ট ডিনার তৈরি করে সঙ্গে দিয়েছে এবং তাতে নাকি পুরোদস্তুর পল্টন পোষা যায় । আমি আপত্তি জানিয়ে বললুম যে , আমিও কিছু সঙ্গে এনেছি , তবে সেটি নিতান্ত নেটিভ বস্তু , হয়ত বড্ড বেশি ঝাল । খানিক্ষন তর্কাতর্কির পর স্থির হল সব কিছু মিলিয়ে ব্রাদারলি ডিভিশন করে যার যা খুশি খাবে । সায়েব যেমন তার সব খাবার বের করতে লাগল আমার চোখ দুটো সঙ্গে সঙ্গে জমে যেতে লাগল । সেই শিককাবাব , সে ঢাকাই পরোটা , মুরগি মুসল্লম , আলু-গোস্ত । আমিও তাই নিয়ে এসেছি জাকারিয়া স্ট্রীট থেকে । এবার সায়েবের চক্ষুস্থির হবার পালা । ফিরিস্তি মিলিয়ে একই মাল বের হতে লাগল । এমনকি শিককাবাবের জায়গায় শামীকাবাব নয় , আলু-গোস্তের বদলে কপি-গোস্ত পর্যন্ত নয় । আমি বললুম , ‘ব্রাদার , আমার ফিয়াসে নেই , এসব জাকারিয়া স্ট্রিট থেকে কিনা ।‘ একদম হুবুহু একই স্বাদ । সাহেব খায় আর আনমনে বাইরের দিকে তাকায় । আমারও আবছা আবছা মনে পড়ল , যখন সওদা করছিলুম , তখন যেন এক গাব্দাগোব্দা ফিরিঙ্গি মেমকে হোটেলে যা পাওয়া যায় , তাই কিনতে দেখেছি । ফিরিঙ্গিকে বলতে যাচ্ছিলুম তার ফিয়াসে’র একটা বর্ননা দিতে কিন্তু থেমে গেলুম । কি আর হবে বেচারীর সন্দেহ বাড়িয়ে ---- তার উপর দেখি বোতল থেকে কড়া গন্ধের কি একটা ঢকঢক করে মাঝে মাঝে গিলছে । বলা ত যায়না , ফিরিঙ্গির বাচ্চা--- কখন রঙ বদলায় । “ একটা বইয়ের দ্বিতীয় পাতাতেই এসে যদি এরকম হাসা লাগে , তবে বোঝাই যাচ্ছে বইটা কেমন হবে । লেখক ট্রেনে উঠেছিলেন কাবুল শহরে যাওয়ার জন্য , কাবুলে তিনি অধ্যাপনা করবেন । কাবুলে যেতে যেতেই তার লেখার মধ্যে পাই পাঠান সর্দারজী , শেখ আহমদ আলী , অফিসার সাহেব , ড্রাইভার অমর সিং এর মত হরেক রকমের চরিত্র । লেখক আশেপাশের প্রকৃতির দৃশ্য দিয়েছেন , সাথে তিনি এদের প্রত্যেকটা চরিত্রের একেবারে গভীরে গিয়ে পৌঁছেছেন । লেখায় পরেই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল পেশোয়ারে মেহমানদারীর খাওয়াদাওয়া , আফগানিস্থানের পরিবেশ , মাঝেমধ্যে কোনো শব্দ কিংবা ইতিহাসের চুম্বকের মত বর্ণনা , জালালবাদের লোকজনের জীবনযাত্রা , পয়তাল্লিশ নম্বর কয়েদির করুন কাহিনি – এরকম অনেক কিছু । কাবুলে আসার পর আমরা গল্পে কাবুলের কিচ্ছাকাহিনীর কিছুটা পরিচয় পাই । কিভাবে কাবুলে এত সংগ্রাম , যুদ্ধ হল , সিংহাসন নিয়ে এত রক্তের বন্যা --- তার বর্ননা পাই এখানে । যাকগে , এবার বইয়ের অন্যতম এক আকর্ষনীয় চরিত্রের কথা বলি । সে মুজতবা আলীর চাকর । এর সম্পর্কে লেখক যে পরিচয় পান তা হল -- “ এর নাম আবদুর রহমান । আপনার সব কাজ করে দেবে --- জুতো বুরুশ থেকে খুনখারাবি । অর্থাৎ হরফন-মৌলা বা সকল কাজের কাজি । “ তার শারিরীক বর্ণনাতেও রয়েছে লেখকের মুন্সিয়ানা--- “ ছ’ফুট চার ইঞ্ছি । উপস্থিত লক্ষ্য করলুম লম্বাই মিলিয়ে চওড়াই । দুখানা হাত হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসে আঙ্গুলগুলো দুকাদি মর্তমান কলা হয়ে ঝুলছে । পা দুখানা ডিঙ্গি নৌকার সাইজ । কাঁধ দেখে মনে হল , আমার বাবুর্চি না হয়ে সে যদি আমীর আবদুর রহমান হত , তবে অনায়সে গোটা আফগানিস্থানের ভার বইতে পারত । এ কান ওঃ কান জোড়া মুখ --- হা করলে চওড়াচওড়ি কলা গিলতে পারে । এবরো-থেবড়ো নাক – কপাল নেই । রঙ ফর্সা , তবে শীতে গ্রীষ্মে চামড়া চিঁরে ফেরে গিয়ে আফগানিস্থানের রিলিফ ম্যাপের চেহারা ধরেছে । দুই গাল যেন কে থাবড়া মেরে লাল করে দিয়েছে – কিন্তু কার এমন বুকের পাটা ?? “ আবদুর রহমান এর রান্নার বর্ণনা শুনে আমারও খিদে লেগে গিয়েছিল । “ ছোটখাট এক গামলা ভর্তি মাংসের কোরমা বা পেয়াজ ঘিয়ের ঘন ক্কাথে সেরখানের দুম্বার মাংস – তার মাঝে কিছু কিছু বাদাম কিসমিস লুকোচুরি খেলছে , এক কোণে একটি আলু অপাংক্তেয় হয়ার দুঃখে মরার চেষ্টা করছে । আরেক প্লেটে গোটা আষ্টেক ফুল বোম্বাই সাইজের শামীকাবাব । বারকোশ পরিমাণ থালায় একঝুড়ি কোফতা পোলাও আর তার উপর বসে আছে এক আস্ত মুর্গির রোষ্ট । “ শুধু সেটাই না , লেখকের এত রান্না দেখে থ হয়ে যাওয়ার দৃষ্য দেখে আবদুর রহমান এর অভয়বানী – রান্নাঘরে আরো আছে । লিখতে গেলে আরো অনেক কিছু লেখা যায় । কিছু কিছু বই আছে যেটা নিয়ে বলতে গেলে অনেক কিছু বলা যায় , কিন্তু শেষ করা যায়না । দেশে বিদেশে সেরকমই একটি বই । এর একেকটি চরিত্র একেকটি রত্ন । কাবুল শহর এর কাঠিন্যের মধ্যেও যে কিছু রত্নের মত মানুষ লুকিয়ে আছে , তা বইটি পড়লেই বোঝা যায় । দোস্ত মুহম্মদের মত বন্ধু , মীর আসলমের মত গুরু , আবদুর রহমানের মত এক বন্ধু পেতে খুব মন চেয়েছিল যখন বইটি প্রথম পড়ি । আজও যখন বইটাতে হাত বুলাই , ঝটকা মেরে একে একে কাহিনীগুলো মনে পরে যায় । শুভ হোক বইপড়া
Was this review helpful to you?
or
#রকমারি_বইপোকা_রিভিউ_প্রতিযোগিতা বইয়ের নাম: দেশে বিদেশে লেখক: সৈয়দ মুজতবা আলী প্রকাশক: স্টুডেন্ট ওয়েজ পৃষ্ঠাসংখ্যা: ২০৮ মূদ্রিত মূল্য দুইশত পঞ্চাশ টাকা #'চাঁদনী থেকে ন'সিকে দিয়ে একটা শর্ট কিনে নিয়েছিলুম। তখনকার দিনে বিচক্ষণ বাঙালীর জন্য ইয়োরোপীয়ন থার্ড নামক একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান ভারতের সর্বত্র আনাগোনা করত। হাওড়া স্টেশনে সেই থার্ডে উঠতে যেতেই এক ফিরিঙ্গী হেঁকে বললে, 'এটা ইয়োরোপীয়নদের জন্য।' আমি গাঁক গাঁক করে বললুম, 'ইয়োরোপীয়ন তো কেউ নেই। চল, তোমাতে আমাতে ফাঁকা গাড়িটা কাজে লাগাই।' . এভাবেই শুরু বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক এবং সর্বাধিক জনপ্রিয় ভ্রমণকাহিনী 'দেশে বিদেশে'-এর। বিদগ্ধ সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতন এবং আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করার পরে আফগানিস্তান সরকারের অনুরোধে কাবুল যান এবং কাবুল কৃষিবিজ্ঞান কলেজে ইংরেজি ও ফার্সি ভাষার অধ্যাপক নিযুক্ত হন। তাঁর কলকাতা থেকে কাবুল অভিমুখে যাত্রা থেকে শুরু করে কাবুলে ১৯২৭-১৯২৯ দু'বছর অবস্থান এবং শেষে রাজনৈতিক ডামাডোলের কারণে আফগানিস্তান ত্যাগ পর্যন্ত সকল ঘটনা মূর্ত হয়ে উঠেছে এই বইয়ে। . সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন বহুভাষাবিদ, পন্ডিত। 'দেশে বিদেশে' উনার প্রথম বই হলেও উনার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এটাই। আফগান সরকারের অনুরোধে সাড়া দিয়ে লেখক ১৯২৭ সালে কাবুলে যাবার মনস্থ করেন। এ বই নিছক ভ্রমণকাহিনী নয়, আফগানিস্তান ইতিহাসের অসামান্য দলিল-ও বটে। লেখক আফগানিস্তানের ইতিহাসকে সংক্ষিপ্তাকারে অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সাথে পরিবেশন করেছেন, সেই সাথে তৎকালীন আফগান শাসন-ও তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে পূর্ণ অবয়ব নিয়ে। লেখক যাত্রাপথে বিচিত্র সব ঘটনার মুখোমুখি হন, বিচিত্র সব লোক এবং তাদের আচার-ব্যবহার লক্ষ্য করেন এবং সেগুলো সবই নিপুণ দক্ষতায় পরিবেশন করেন। তার ফলে বইটি হয়ে ওঠে সুপাঠ্য, সাবলীল। . বইয়ের কাহিনী হাওড়া স্টেশনে ফিরিঙ্গীর সাথে থার্ডে ওঠা এবং ডিনারের মজার ঘটনা দিয়ে শুরু। এরপরে কাহিনী তরতর করে এগিয়েছে, গাড়ির গতির সাথে। পথে পাঠান, পাঞ্জাবী, শিখদের সাথে দেখা। পেশোয়ারে এক বুড়ো সর্দারজী জুটল যিনি শুধু পাঠানমুল্লুক নন, বার্মা-মালয় সহ নানান দেশের সংস্কৃতির গল্প করে পাঠানদের মাঝে জাঁকিয়ে বসলেন। পাঠানদের মেহমানদারীতে লেখক মুগ্ধ, সে মুগ্ধতা আরো বাড়ল যখন পেশোয়ারে লেখকের বন্ধু, সি.আই.ডি. ইন্সপেক্টর শেখ আহমদ আলীর সাথে দেখা হল। লেখক মুক্তকন্ঠে পাঠানদের অভ্যর্থনা, অতিথি সৎকারের প্রশংসা করেছেন। . লেখকের সাথে আহমদ আলীর তুমুল আড্ডা জমে উঠল, আলোচ্য বিষয় দুনিয়ার সবকিছু! পেশোয়ারে অবস্থানের ফলে লেখকের পাঠানসমাজ নিয়ে বেশ ভাল ধারণা জন্মে গেল। তাঁদের আচার-ব্যবহার, পোশাক-পরিচ্ছেদ, খাদ্যাভ্যাস লেখক অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। পাঠানেরা অত্যন্ত অলস এবং আড্ডাবাজ। তাঁদের গায়ের জোর বেশি হলেও স্বভাব শান্ত, কিন্তু কেউ বেইমান বললে এবং ভাইকে বাঁচাতে হলে তাদের রক্ত লেখকের ভাষায় 'খাইবার পাসের টেম্পারেচার ছাড়িয়ে যায়'! লেখক বলেছেন, '...আর ভাইকে বাঁচাবার জন্য সে অত্যন্ত শান্তমনে যোগাসনে বসে আঙুল গোনে, নিদেনপক্ষে তাকে ক'টা খুন করতে হবে। কিন্তু হিসেবনিকেশে সাক্ষাৎ বিদ্যেসাগর বলে প্রায়ই ভুল হয় আর দুটো-চারটে লোক বেঘোরে প্রাণ দেয়'! লেখক যেখানেই অবস্থান করেছেন, সবকিছু অত্যন্ত খুঁটিয়ে দেখেছেন। তাই খাবার কায়দার মত ব্যাপার যেমন এসেছে, তেমনি অন্যের চিন্তা আর অনুভূতি-ও স্বচ্ছন্দে বলেছেন। . লেখকের আহমদ আলীর উঠোন পেরুতে গিয়ে পাক্কা সাতদিন লাগল। আটদিনের দিন এক শিখ প্রৌঢ় সর্দারজীর বাসে উঠিয়ে দেয়াতে খাইবার গিরিসংকট পার হয়ে কাবুল অভিমুখে যাত্রা শুরু হল। বাসভর্তি কাবুলি ব্যবসায়ী, আর লেখকের সহযাত্রী আফগান সরকারের এক কর্মকর্তা। একে তো প্রচন্ড গরম, তার উপরে টায়ার ফেঁসে গিয়েছিল। খাইবারপাস অতিক্রম করে লান্ডিকোটাল হয়ে দক্কা দুর্গে পৌঁছলেন তাঁরা। সেখানে দুর্গের অফিসার হাফিজ-সাদী পড়া শিক্ষিত লোক, তাই লেখকের সাথে একপ্রস্থ কাব্যালোচনা হয়ে গেল। তারপরে পাসপোর্ট দেখিয়ে জালালাবাদ অভিমুখে যাত্রা। জালালাবাদ পৌঁছবার আগে গাড়িতে সমস্যা হল, আর সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় রাতকানা সর্দারজী যাত্রা বিরতি ঘোষণা করলেন। ফলে ঠাঁই হল আফগান সরাইখানায়। আফগান সরাইখানা সম্পর্কে আহমদ আলী আগেই অবহিত করেছিলেন লেখককে। অত্যন্ত নোংরা পরিবেশ, বারো জাতের লোক পাওয়া যাবে; কিন্তু ভাষাশিক্ষা বা জ্ঞান অন্বেষণের জন্য এরকম সরাইয়ের তুলনা নেই। সরাইখানা থেকে কাবুল নদীর কৃপায় শস্যশ্যামল হওয়া জালালাবাদে পৌঁছলেন লেখক, সেখানে নিমলার বাগান নামক সম্রাট শাহজাহানের তৈরিকৃত উদ্যানে রাত্রিযাপন। ভোরে আবার যাত্রা শুরু এবং অবশেষে কাবুল পৌঁছানো। লেখক তাঁর শান্তিনিকেতনের ফার্সির অধ্যাপক বগদানফ সাহেবের নিবাস ফরাসি রাজদূতাবাসে উঠলেন। তিনি তৎকালীন সময়ে ফার্সি পড়ানোতে বিখ্যাত ছিলেন। চৌদ্দতম অধ্যায়ে লেখক আফগানিস্তানের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরেছেন, আর আফগানিস্তানের সাথে ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক সম্পর্ক তুলে ধরেছেন। এরপরেই পনেরতম অধ্যায়ে বইয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্র আবদুর রহমানের আগমন। লেখক কাবুল থেকে আড়াই মাইল দূরে এক গ্রামে বাসা পেলেন, আর সঙ্গে পেলেন সকল কাজের কাজী আবদুর রহমানকে। আবদুর রহমান ছ'ফুট চার ইঞ্চি লম্বা এক দৈত্যবিশেষ। লেখক তাঁর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন- তাঁর কাঁধ দেখে মনে হল সে যদি লেখকের বাবুর্চি আবদুর রহমান না হয়ে আমীর আবদুর রহমান হত, তবে অনায়াসে গোটা আফগানিস্তানের ভার বইতে পারত! অত্যন্ত বিনয়ী, কর্তব্যনিষ্ঠ, সরল আবদুর রহমান লেখকের দিকে তাকাত না সহসা, 'কার্পেটের অপরূপ রূপ' দেখত। প্রথমদিনেই বিভিন্ন প্রকারের খাবার যে পরিমাণে রান্না করেছিল এবং লেখকের বাধ্য হয়ে আকন্ঠ গিলতে হয়েছিল, সে বর্ণনা লেখকের কলমে অত্যন্ত স্বাদু গদ্যে ফুটে উঠেছে। সে বর্ণনা শুধু হাস্যরসে পূর্ণ নয়, খিদে উদ্রেককারী-ও বটে! লেখক তামাম কাবুলের সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছেন, সামাজিক জীবনের কাহিনী সুনিপুণভাবে বলেছেন। একে একে মীর আসলম, দোস্ত মুহম্মদ, আগা আহমদের বর্ণনা এসেছে। তাঁরা সবাই-ই স্বমহিমায় উদ্ভাসিত, ফুলদানিতে রাখা নানান বর্ণ-গন্ধের ভিন্ন ভিন্ন ফুল। আস্তে আস্তে লেখকের সাথে আরো অনেকের পরিচয় হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী মুইন-উস-সুলতানে বা যুবরাজ। লেখক এখানে আফগান রাজনীতির বর্ণনা দিয়েছেন, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, ক্ষমতার মোহ, ভারত-আফগান ইতিহাসের মেলবন্ধন অতি চমৎকারভাবে মূর্ত হয়েছে লেখকের মুন্সিয়ানায়। লেখক মুইন-উস-সুলতানের সাথে টেনিস খেলতেন। এরফলে আবদুর রহমান সহ অনেকের চোখেই তিনি সম্ভ্রমের পাত্র হয়ে পড়েন। অবশ্য আবদুর রহমান এমনিতেই লেখককে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু টেনিস খেলার সুবাদে কিভাবে এক চাষার সাথে লেখকের বন্ধুত্ব আস্তে আস্তে মিইয়ে যায় তার বর্ণনা শুনে দুঃখ লাগে, বাস্তবতা যদিও আমাদের দেশেও একই। বগদানফ, বেনওয়া, মৌলানা জিয়াউদ্দীন আর লেখকে মিলে 'চারইয়ারি' জমে উঠল, পরে দেখা হল রুশ দূতাবাসের কোষাধ্যক্ষ দেমিদফ আর তাঁর স্ত্রীর সাথে। দেমিদফ-দম্পতি অত্যন্ত আন্তরিক, সাহিত্যানুরাগী। শীতের ছুটি পেয়ে লেখক সাত মাস কাবুলে কাটানোর পরে দেশে ফিরলেন। আবার ছুটিশেষে কাবুল গমন। এরপরে শীতে জমে যাওয়া লেখককে নিয়ে আবদুর রহমানের নর্তন-কুদন শুরু হল। লেখকের অসাধারণ বর্ণনা পড়ে 'ফ্রস্টবাইট'-এর সর্বোৎকৃষ্ট থেরাপি সম্পর্কে আর সন্দেহের অবকাশ থাকেনা। . আফগানিস্তানের ললাটে পাগলা আমানউল্লা থাকায়, আর তিনি পশ্চিমে ঘুরে এসে অনেক কিছু শিখে আসায় তার প্রচলন দেশে শুরু করলেন। বাদশার উপরে আর কথা কিসের! আর আমরাও সৈয়দ মুজতবা আলীর জাদুকরী লেখনীতে একে একে গোগ্রাসে গিলতে থাকলাম তা। রাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার ও যে এত রসময় করে লেখা যায় তা অন্য কোথাও বিরল। আমানউল্লার আদেশে কাবুলের রাস্তায় দেশি পোশাক নিষিদ্ধ হল, দেরেশি- স্যুটের প্রচলন শুরু হল। ফলাফল? 'একদিন সকালবেলা ঘুম ভাঙতে দেখি চোখের সামনে এক অপরূপ মূর্তি। চেনা চেনা মনে হল অথচ যেন অচেনা'। জবড়জং পোশাক পরে আবদুর রহমান হাজির! শুধু আবদুর রহমানই না, গোটা কাবুল শহরেই এমন। লেখক ততদিনে আফগানিস্তানকে আপন করে নিয়েছেন, তাই ওই উদ্ভট পোশাক দেখে ইউরোপীয়দের তামাশা দেখতে বেরুনোতে লেখক অত্যন্ত লজ্জাবোধ করলেন। এরপরে লেখকের কাবুলজীবন বেদনারসে সিক্ত। বাচ্চায়ে সকাও নামক ডাকাতসর্দার, গরীবের রবিনহুড, কাবুল আক্রমণ করল। তারপরেই দ্রুত রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন। বিদ্রোহ শুরু, আমানউল্লার পলায়ন, মুইন-উস-সুলতানের সিংহাসন গ্রহণ, বাচ্চার মুহুর্মুহু আক্রমণ, মুইন-উস-সুলতান ইনায়েতুল্লার সিংহাসন ত্যাগ করে ভারতবর্ষগমন, এবং ডাকু সর্দারের 'গাজী হবীবউল্লা খান নাম নিয়ে সিংহাসন দখল। এ সবকিছুই শুধু আমানউল্লার গরীব আফগানের পোশাক নিয়ে বিধিনিষেধ জারি করাতে হল। যাইহোক, নতুন বাদশাহের হুকুমে লুটতরাজ শুরু হল। স্কুল-কলেজ বন্ধ করার ফরমান জারি হল। বিদেশী অধ্যাপকেরা মহা ফাঁপরে পড়লেন। তাঁরা ব্রিটিশ লিগেশনের স্যার ফ্রান্সিসকে ধরলেন বিমানে করে ভারতবর্ষে পাঠিয়ে দিতে। স্যার ফ্রান্সিসের অহমে আঘাত করায় লেখককে ভারতে যাবার সুযোগ দেয়া হলনা, তিনি গৃহবন্দি হয়ে পড়ে রইলেন। চাকরি চলে যাওয়াতে দুঃখ-দুর্দশার শুরু হল। . লেখক খাদ্য-রসদে ঘাটতি পড়াতে আবদুর রহমানকে তাঁর জন্মভূমি পানশিরে চলে যেতে বলেন, মাইনে দেবার অপারগতার কথা বলেন। আবদুর রহমানের বুকে কথাটা শেল হয়ে বিঁধে, সে যে নেমকহারাম না তা বার বার বলে। অবশেষে লেখক ক্ষান্ত দেন। কিন্তু শুরু হয় দুঃসহ কষ্টে দিনাতিপাত। চা ফুরিয়ে যাওয়ায় শুধু রুটি আর নুন দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতে হয়েছিল। অনাহার আর অসুখে লেখক আর তাঁর বাসায় অবস্থানকারী মৌলানার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গিয়েছিল। 'কথায় কথায় দু'জনাতে তর্ক লাগে, মৌলানার দিকে তাকালেই আমার মনে হয় ওরকম জঙলী দাড়ি মানুষ রাখে কেন, মৌলানা আমার চেহারা সম্বন্ধে কী ভাবতেন জানিনে, তবে প্রকাশ করলে খুব সম্ভব খুনোখুনি হয়ে যেত'। এই দুর্দিনে জার্মান রাজদূতের সাহায্য পেলেন লেখক, জার্মানিতে যাবার জন্য শিক্ষাবৃত্তি পাবার সম্ভাবনা জাগল। রাজদূতাবাস থেকে ফেরার পথে প্রথমবার আটজন ডাকুর সামনে পড়ে যান তিনি, এবং তাঁর বাঙ্গাল চেহারা আর ভয়ার্ত চোখ দেখে তাদের হাস্যরসের ফলেই বেঁচে যান। পথে আবার আরেকদল ডাকাতের সাথে দেখা যাদের সাথে এক ছোকরা অফিসার ছিল। লেখকের সৌভাগ্য, সে তাঁর এক প্রাক্তন ছাত্র যে কিনা অল্পবয়সেই কর্ণেলে উন্নীত হয়েছে। সে-ই লেখককে বাড়িতে পৌঁছে দিল, সেইসাথে অনেক খাবার সওগাত হিসেবে নিয়ে আসল। লেখক-ও বহুদিন পরে পেটপুরে খেতে পারলেন। এরপরেই ব্রিটিশ রাজদূতাবাসের পিয়ন এসে খবর দিল প্লেনে লেখক আর মৌলানার জন্য দুটো আসন বরাদ্দ হয়েছে। আবদুর রহমান অনেক কাকুতিমিনতি করেছিল, লেখকের সাথে ভারতবর্ষে আসার জন্য; বাবা-মা-স্ত্রী রেখে হলেও। কিন্তু এটা অসম্ভব ছিল। তাই লেখক আদেশ করেছিল তাকে ওখানেই থাকতে এবং সুযোগ হলেই পানশিরে ফিরে যেতে। তারপরে সকাল হতেই অতি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র বেঁধেছেঁদে তাঁরা বিমানে যাবার জন্য রওয়ানা করলেন। যাবার বেলায় লেখকের বিদায়সম্ভাষণের প্রত্যুত্তরে আবদুর রহমান মন্ত্রোচ্চারণের মত একটানা 'আপনাকে খোদার হাতে সমপর্ণ করলাম, সায়েব' বলতে লাগল। লেখক মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন আবদুর রহমানের ভালবাসা, দুঃসময়েও সে চলে যায়নি; নিজে না খেয়েও লেখককে খাইয়েছিল। তাই বলেছেন- চাণক্য যে সমস্ত পরীক্ষার কথা বলেছেন আবদুর রহমান সব ক'টাতেই উর্ত্তীর্ণ হল। মৌলানা জানালার পাশের সীটটা লেখককে ছেড়ে দিলে তিনি তাকিয়ে দেখেন বিমান চলতে শুরু করার পরেও আবদুর রহমান তাঁর পাগড়ির ন্যাজ মাথার উপরে তুলে দুলিয়ে দুলিয়ে তাঁকে বিদায় জানাচ্ছে। লেখকের শেষ কথা ক'টি তাই মর্মস্পর্শী। 'বহুদিন ধরে সাবান ছিল না বলে আবদুর রহমানের পাগড়ি ময়লা। কিন্তু আমার মনে হল চতুর্দিকের বরফের চেয়ে শুভ্রতর আবদুর রহমানের পাগড়ি, আর শুভ্রতম আবদুর রহমানের হৃদয়'। . ৭/৮ বছর আগে যখন বইটি প্রথম পড়েছি, তখনই এটি আমার মনোজগতকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। এখন পড়ে আরো ভাল লেগেছে। সৈয়দ মুজতবা আলী একজন বহুভাষাবিদ, পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। এ বইয়ের প্রতি বাক্যে ফুটে উঠেছে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য, অসামান্য রসবোধ। তিনি যেকোনো জটিল বিষয়কে অতি স্বাদু গদ্যে, মজলিশি ঢঙে পরিবেশন করতে পারতেন। ভ্রমণসাহিত্য যদি পাত্র হয়, তবে এ বই অতি উত্তমরূপে রন্ধনকৃত শাহী বিরিয়ানি; পাত্রে কানায় কানায় পরিপূর্ণ। স্পাই থ্রিলারে যেমন শত বিপদেও নায়কের মৃত্যু হয়না, তেমনি ভ্রমণকাহিনী মানেই লেখক শত বিপদ ঘটলেও তা পাড়ি দিয়ে এসেছেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাস্তবতা কল্পিত কাহিনীকে হার মানায়। এ বইয়ের আবদুর রহমান হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া একজন লোক। বিশ্বাস, সারল্য আর কর্তব্যনিষ্ঠা, সেইসাথে অপরিসীম ভালবাসা তাঁকে মহান করে তুলেছে। তাই আবদুর রহমানের কষ্টে, লেখকের সাথে বিচ্ছেদে পাঠকহৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। দুটো চিনেমাটির ডাবরে দুটো পান্তুয়া ভেসে ওঠার দৃশ্য তাই দেখতে ইচ্ছে হয়, তাঁর নয়নের ভাবের খেলায়। এ বই আফগান ইতিহাসের অসামান্য দলিল যেমন, তেমনি ভ্রমণকাহিনীর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শুধু সাহিত্যের মান বিচারে নয়, ভাষার লালিত্যে, পাঠকের মনে বিমলানন্দ আনাতে এ বইয়ের তুলনা নেই। তাই রেটিং করতে হলে সর্বোচ্চটাই দিতে হবে, ৫/৫। স্টুডেন্ট ওয়েজ ছাড়াও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এ বই বের করেছে, রকমারিতে সার্চ দিয়ে দেখেছি। স্টুডেন্ট ওয়েজ সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনাসমগ্রই বের করেছে। তবে কিছু মূদ্রণপ্রমাদ দেখে আমি হতাশ। বেশ কয়েক জায়গায় বানান ভুল আছে। এমনিতে এ বইয়ের অনেক শব্দের বানান আধুনিক নিয়মে পরিবর্তিত হয়েছে। তারপরেও, আমার মনে হয় মনোযোগ দিয়ে কেউ পুরো বইটা পড়লে মূদ্রণপ্রমাদগুলো চোখে পড়ত। আমাদের দেশের প্রকাশনায় এসবে সতর্কতার যথেষ্ট অভাব। বাংলা সাহিত্যের অমূল্য এক সম্পদেও এটা ভাবা যায়না! কেউ যদি রিডার্স ব্লকে ভুগে, তবে এ বইটি তুলে নেবার আহ্বান জানাব আমি। ব্লক কেটে যাবে, অদ্ভুত ভাললাগায় ছেয়ে যাবে মন। পরীক্ষা প্রার্থনীয়!
Was this review helpful to you?
or
সৈয়দ মুজতবা আলী বাংলা সাহিত্যে ভ্রমণকাহিনীর সেরা লেখক। তিনি তার ভ্রমণকাহিনীগুলোতে তার বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেন। দেশে বিদেশে শুধু সৈয়দ মুজতবা আলীরই না বরং বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ভ্রমণকাহিনীর একটি। এই বইয়ে লেখক তার ভ্রমণকৃত সব যায়গার পরিবেশ, সেখানকার মানুষের আচরণ-স্বভাব,যোগাযোগ ব্যবস্থা, সংস্কৃতি ইত্যাদি তুলে ধরেছেন। তার লেখনিতে ভ্রমণস্থানের রূপক প্রসংশা ও বর্ণনার বিষয়টি কম দেখা যায়। এতে করে কোনো স্থানের আসল চিত্রটা যেন পাঠকের চোখের সামনে ভাসমান হয়ে উঠে। তিনি তার ভ্রমণকাহিনীগুলোতে অহেতুক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যেরও কথা বলেন না। সঠিক উপমা দিয়েই তিনি কোনো স্থানের বর্ণনা দেন।
Was this review helpful to you?
or
পড়া শুরু করেছি, ক'দিন হলো| ক্রমেই তাঁর লেখার ভক্ত হয়ে যাচ্ছি| লেখক কিন্তু অত্যন্ত রসিক!
Was this review helpful to you?
or
সৈয়দ মুজতবা আলী'র 'দেশে বিদেশে' বইটি যখন পড়া শুরু করি, বইটির নাম দেখে প্রত্যাশা হয়েছিল বেশ কয়েকটি দেশ ভ্রমণের কাহিনী পড়তে পারব। কারন নাম 'দেশে বিদেশে', হয়তো লেখক একই সফরে বেশ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। যখন লেখক পাকিস্তানে তথা তৎকালীন ভারতবর্ষ হতে আফগানিস্তানে প্রবেশ করেন তখনো প্রত্যাশা অব্যাহত ছিল। কিন্তু ঘটনা প্রবাহে যখন বুঝতে পারলাম ভ্রমণের ব্যপ্তি মাত্র দুটি দেশেই তখন কিছুটা হতাশ হয়েছিলাম। তবে ভুল ভাংতে বেশি দেরি হয় নি। কারন আফগানিস্তান রাজনৈতিক ভাবে একাটি দেশ হতে পারে, কিন্তু রং-এ, রূপে, বৈচিত্রে, জাতিতে, ভাষায় গোটা বিশেক দেশকে হারিয়ে দিতে পারে। তাই বইটির নাম যদি বহুবচনে রাখা না হত তবে যেন আফগানিস্তানকেই অপমান করা হত। পাকিস্তানও (ভুতপূর্ব ভারতবর্ষ) কম যায় না। তার নমুনা সে দেখিয়েছে পেশোয়ারে- ডজনখানেক ভাষা, অর ততগুলো জাতি, ততগুলো জীবন দর্শন। অর এই বইয়ের মূল ভেন্যু কাবুলতো বিচিত্রতায় অনন্য। পাঠান, হাজারা, তাজিক, ভারতীয় আর তাদের সাথে ভীর জমিয়েছে আরও বিচিত্র ইউরোপীয় তামাসা দর্শকগণ। সব মিলিয়ে আফগানিস্তান ঠিকই দেশ বিদেশ। আফগানিস্তান সম্পর্কে ধারণা ছিল দেশটি উষর, মরুময়, ছায়াহীন, প্রাণহীন, জীবন স্পন্দন যেখানে রসহীন পাথর। আর এমন একটা দেশের ভ্রমণ কাহিনী পড়া, সে তো ভ্রমণের চেয়েও কঠিন। আফগানিস্তানের সৌভাগ্য, আর এই পাঠকও সেই সৌভাগ্যের অংশীদার যে ভ্রমণকারীর নাম সৈয়দ মুজতবা আলী। কোন ভ্রমণকারী যদি ভ্রমণস্থলকে উপভোগ করতে না পারে, তার কাদা, তার বালু, তার পাহাড়, তার ফুল, তার কাটায় যদি সৌন্দর্য অনুভব করতে না পারে তবে সেটি তার অন্তরের দীনতা। লেখক আফগানিস্তানে সেটি পেরেছেন তিনি প্রাণহীন মরুতেও সৌন্দর্য দেখেছেন। একই সাথে তার বর্ণনা করার ক্ষমতাকেও বিবেচনায় আনতে হয়। তিনি দক্কা দূর্গের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কাবুল নদীর যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে কাবুল নদীকে মনে হয় যেন স্বর্গের নহর। এই ভ্রমণ কাহিনী যদি কোন রসবোধহীন লেখকের পাল্লায় পড়ত তবে তা হতো পুষ্টিহীন পাঠের অযোগ্য অখাদ্য। তিনি তার পুরো বৃত্তান্তটি এমন রসময় করে বর্ণনা করেছেন মরুর দেশটিকে মোটেও প্রণহীন, উষর, বিস্বাদ মনে হয় না। তিনি মরুতে মধু'র চাষ করেছেন। পাকিস্তান সহ আফগানিস্তানের মানুষ, তাদের দৈনন্দিন জীবন যাপন, মনন, ধ্যান ধারনা, জীবনবোধ. কাবুলের বাজার, আফগানিস্তানের ঘটনাপন্জী, প্রতিটি বিষয় তিনি যথাযোগ্য মর্যাদায় রসময় করে তুলে এনেছেন। তার বর্ণনায় আফগানিস্তান যেন তুলে ধরেছে তার আপন রুপ অকৃপণতায়। আফগানিস্তান হয়তো সবার কাছে নিজেকে প্রকাশ করে না। লেখক এক যায়গায় একটি ব্যক্তিগত বিষয় উপস্থাপন করে দ্বিধান্বিত হয়েছেন। কিন্তু তিনি যদি পরবর্তী প্রজন্মের ভ্রমণ কাহিনী পড়তেন তবে দেখতেন ভ্রমণকারী তার ভ্রমণসাথীর ব্যাগের চাবি হারানোর ঘটনাটি তুলে ধরেছে গুরুত্ব সহকারে। বাদ যায় না একটি ঘটনাহীন দিনের বর্ণনাও। বইটি শুধু একটি ভ্রমণকাহিনী নয়, একটি অনন্য ইতিহাস গ্রন্থও বটে। আজো বাংলায় আফগানিস্তানের ইতিহাসের ভাল কোন বই নেই। বোধকরি এই দৈন্য প্রায় প্রতিটি ভাষার। বৃটিশদের কাছে থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পরের রাজতন্ত্রের পালাবদলের সেই ঘটনগুলি লেখক দেখেছেন খুব কাছ থেকে। শেষের দিকের এই রাজনৈতিক ঘটনাবলী ও লেখকের উদ্ধার পাওয়ার কাহিনী রোমান্ঞউপন্যাসের স্বাদ দেয়। লেখক কত সালে আফগনিস্তান গিয়েছিলেন, কত দিন ছিলেন এসব ব্যাপারে সামক্য ধারণা পাওয়া যায় না। লেখক কোথাও সন তারিখ উল্লেখ করেন নি। তবে বোধকরি ঘটনাবলী গত শতকের তিরিশের দশকের। বইটি পড়ার শেষে আব্দুর রহমানের স্মুতি সবাইকে নাড়া দেবে। লেখক বলেছেন ...চর্তুদিকের বরফের চেয়েও শুভ্রতর অবদুর রহমানের পাগড়ি, আর শুভ্রতম অবদুর রহমানের হৃদয়।