User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
মোট ১৩টি প্রবন্ধের সমাহারে ঋদ্ধ এই গ্রন্থ। লেখক মাহবুব আলমের ভাষায়, ‘ইতিহাসের প্রশস্ত রাজপথের’ সন্ধান দেওয়ার পাশাপাশি তাঁর ‘আলো-আঁধারি’ ছাওয়া ‘অলিগলিতে ঢুকলে মিলবে অনেক চমক, অনেক অজানা তথ্য আর প্রায় ভুলে যাওয়া অনেক কাহিনি, সামনে এসে দাঁড়াবে দেখা-না দেখা নানা চেহারা।’ সত্যিই তাই। গ্রন্থের প্রথম লেখা ‘শায়েস্তা খানের শেষ ইচ্ছা’ দিয়েই শুরু করা যাক। লেখক শুধু উপরিভাসাভাবে শায়েস্তা খানের আমলে এই বাংলা মুলুককে ‘জিন্নাত-উল-বিলাদ’ বা ‘দুনিয়ার স্বর্গে’ পরিণত করার কথাই বলেননি, বলেছেন তাঁর পারিবারিক সুখদুঃখের কথাও। বলেছেন তাঁর সেই বিখ্যাত উইলের কথা, যাতে প্রতিফলিত তাঁর সুদৃঢ় ইমানদারির বিষয়টি। তাঁর সেই উইলের এক জায়গায় তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘যদি লোভবশত কেউ অন্যের অংশের ওপর অন্যায় দাবি করে তা হলে সে যেন এই দলিলটি দেখে—যেখানে তার অংশ ঠিকমতো বলে দেওয়া হয়েছে।’ দীর্ঘ ৮০ বছর বয়সে অপরিসীম মর্যাদা নিয়ে শায়েস্তা খান ছেড়েছিলেন তাঁর সুবেদারির পদ। তাঁর বিদায় পর্বে তাঁকে শেষ বিদায় জানাতে ঢাকাবাসী বিরাট এক মিছিলে সমবেত হয়েছিল। ‘বাবু-ইংরেজি আর সাহেবি-বাংলা’ এই গ্রন্থের সবচেয়ে রসাল নিবন্ধগুলোর একটি। ১৯ শতকের মাঝামাঝি ‘জাত খোয়ানোর ভয় আর খ্রিষ্টান হওয়ার আশঙ্কা’ কাটিয়ে বাঙালি ইংরেজি শিখতে উঠেপড়ে লেগে গেল। এসবেরই মূলে ছিল ‘সামাজিক প্রতিপত্তি ও সরকারি চাকরি পাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা’। বড় রসাল ভঙ্গিতে বাঙালির সেই ইংরেজি শিক্ষার আদিপর্বের বর্ণনা তুলে ধরেছেন মাহবুব আলম। তিনি জানাচ্ছেন, ‘বাবু-ইংলিশের বিচিত্র রসের দু-একটি উদাহরণ হাজির না করা পর্যন্ত এই আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। প্রথম গল্পটি এ রকম—শোনা যায় সে আমলে চাকরি পাওয়া নিয়ে খুব কড়াকড়ি হতো।...তাই অনেক চাকরিপ্রার্থী অগ্রিম খবরের সন্ধানে শ্মশানঘাটে গিয়ে সদ্যোমৃত চাকরিজীবীদের নামধাম খুঁজে বের করত, মৃত ব্যক্তি কোন দপ্তরে, কী পদে চাকরি করেছিলেন—সব জেনে দরখাস্ত পাঠাত মৃতের চাকরিস্থলে। ইংরেজি ভাষায় লেখা সেই দরখাস্তের শুরুটি ছিল এ রকম—‘লার্নিং ফ্রম বার্নিংঘাট (শ্মশানঘাট) দেট এ পোস্ট হ্যাজ ফলেন ভ্যাকেন্ট, আই বেগ টু অ্যাপ্লাই ফর দি সেম।’ এ রকম আরও একটি রসাল উদাহরণ আছে এই গ্রন্থে। ইংরেজদেরও বাংলা ভাষা শেখার হাস্যকর দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন লেখক। এই নিবন্ধের ইতি টানছেন এই বলে, ‘ঊনিশ শতকের মধ্যেই বাবু ইংলিশ ইতিহাসের হাস্যকর অধ্যায়ে’ পর্যবসিত হয়। তত দিনে বাঙালি যেমন ইংরেজিতে, তেমনি ইংরেজদেরও কেউ কেউ বাংলা ভাষায় ঈর্ষণীয়ভাবে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। ‘আঠারো-ঊনিশ শতক: বাংলায় বিদেশি শিল্পীরা’ এই গ্রন্থের দীর্ঘ নিবন্ধগুলোর অন্যতম। সচিত্র এই নিবন্ধে বাংলা ও ভারতের মাটিতে ভাগ্যান্বেষণে আসা এবং এই দেশের ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ুকে ভালোবেসে যাঁরা ছবি এঁকেছিলেন, তাঁদের বিবরণ তুলে ধরেছেন প্রায় সবিস্তারে। তবে, আমার জানা মতে, আরেক কবি ও চিত্রকর ঢাকা ও কলকাতায়ও এসেছিলেন এ দেশের পশুপাখির ছবি আঁকার জন্য। কলকাতায় আলীপুর চিড়িয়াখানায়ও এমন একজন পশু ও প্রাণীর ছবি আঁকার কাজে নিয়োজিত হয়েছিলেন। তিনি ভুবন বিখ্যাত লিমেরিকের স্রষ্টা এডোয়ার্ড লিয়র। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কোথাও তাঁর নামের হদিস নেই। বাংলায় বিদেশি শিল্পীদের তালিকায় তাঁর নামও সংযোজন করার অনুকূলে গবেষণা হলে খুশি হওয়ার কারণ ঘটবে। মাহবুব আলম যে নিষ্ঠায় বাংলায় বিদেশি শিল্পীদের শৈল্পিক প্রয়াস নিয়ে লিখেছেন, সে জন্য তাঁকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাতে হবে। ‘ভিক্টোরিয়ার অতিথি রানী সুনীতি’, ‘কোথায় যেন হারিয়ে গেছে...’, ‘তিন সাহিত্যিকের চাকরি-কাহিনী’ ও ‘ “ধানুরি” করিরাজ: সেকাল একাল’ শীর্ষক নিবন্ধগুলো বিষয়-বৈচিত্র্যে ও তথ্যের বিচারে এতটাই সমৃদ্ধ যে, অবাক হতে হয় মাহবুব আলমের ইতিহাসের বিচিত্র গলিঘুঁজিতে পদচারণের ও সেখান থেকে তথ্য আহরণের প্রাণান্ত প্রয়াসের পরিচয় পেয়ে। যেমন—‘তাহাদের ঘরের কথা’ শীর্ষক নিবন্ধের কথাই ধরা যাক। ইতিহাসখ্যাত ব্যক্তিবর্গের সহধর্মিণীদের সুখ-দুঃখ-বেদনা, বঞ্চনা ও লাঞ্ছনার এবং তাঁদের নেপথ্য-ভূমিকা নিয়ে মাহবুব আলম পৃথক একটি গ্রন্থ রচনা করতে পারেন। এই নিবন্ধে তিনি দ্বারকানাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা লিখেছেন। তুলে ধরেছেন তাঁদের সঙ্গে তাঁদের সহধর্মিণীদের সম্পর্কের বিবরণ। জ্বলজ্বলে প্রদীপ যেন কথিত মনীষীরা এবং তার নিচে প্রগাঢ় অন্ধকারের মতো তাঁদের সহধর্মিণীরা। ‘তাহাদের ঘরের কথা’ পড়তে পড়তে পাঠককুল নিশ্চিতই একটুখানি হলেও বিষাদমগ্ন হবেন। ‘চিত্রপরিচালক রবীন্দ্রনাথ’-এ তুলে ধরা হয়েছে বিশাল রবীন্দ্র-প্রতিভার আরও একটি দিকের কথা, যে বিষয়টি নিয়ে তেমন আলোচনা চোখে পড়ে না। ‘পথের পাঁচালী: অপু-দুর্গার নেপথ্য কাহিনি’, ‘ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ’ ও ‘মির্জা শেখ ইতেশামুদ্দীন/লন্ডনে বাদশার বাঙালি দূত’ শীর্ষক নিবন্ধগুলো পাঠককে সামাজিক ইতিহাসের এমন সব তথ্যের জগতে নিয়ে যাবে, যার পাঠে মন অনাবিল আনন্দে ভরে উঠবে। দূর ও অনতিঅতীত উজ্জ্বল হয়ে উঠবে পাঠকের মন ও মননে। মাহবুব আলম আমাদের সেই বিরল ইতিহাসকারদের একজন, ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে যাঁরা অক্লান্ত অভিযাত্রীর মতো। আমাদের আলোচ্য গ্রন্থের পরতে পরতে তার ছাপ সুঅঙ্কিত।