User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
বাবা দিয়েছিলেন ‘জোনাকি’। কিন্তু ১২ মাসই অসুখ-বিসুখ লেগে থাকত মেয়েটির, ছুটোছুটির সামর্থ্যহীন। গলার শব্দেও কমজোর। তাই সুন্দর নামটা সইল না। জোনাকির বদলে জুটল শুটকি। বাড়িতে দুধ দিতে আসা হিন্দুস্থানি গোয়ালারা পর্যন্ত ডাকত এ নামে। যোগ হলো আরও দুটি নাম, নকরানি ও লাকড়ি। সেই মেয়েটিই শেষ জীবনে এসে আত্মজীবনীতে দিয়েছেন নিজ শরীরের বর্ণনা, শরীরটা ছিল যেন ছোটখাটো একটা তালপাতার সেপাই। সরু ঘাড়-গলা, বেঢপ বড় মাথা আর কাঠি কাঠি হাত-পা, একেবারে রীতিমতো এক ‘আগলি ডাকলিঙ।’ তো এই মেয়েটি এ কালের কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান। জন্ম পশ্চিম বঙ্গের ভবানীপুরে, চিকিৎসক বাবার সন্তানের অবোধবেলা কেটেছে ভবানীপুর হাসপাতালে। স্মৃতি হাতড়ে জীবনের স্মৃতিগ্রন্থে হাজির করেছেন শৈশবমাখা নাম—বেনীমাধব স্ট্রিট, হরিশ মুখার্জি রোড, জগুবাবুর বাজার, দ্বারিক ঘোষের মিষ্টির দোকান, আলিপুর চিড়িয়াখানা, ঘোড়দৌড়ের মাঠ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, কালীঘাটের ব্রিজ, গড়ের মাঠ…। মানুষের বেলায় দারুণ অমিশুক থাকলেও শৈশবের স্মৃতিতে মিশে আছে ঠিকই, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের স্মৃতি। সাইরেনের বিকট চিৎকার, বোমার গগনবিদারী আওয়াজ, জাপানি বোমারু বিমানের গুট গুট শব্দ আর অ্যান্টি-এয়ারক্রাফটের ঘন ঘন কড়া ধমক…। রিজিয়ার মা ছিলেন পদ্মাপারের অভিজাত রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে, অথচ কলকাতায় নিজেকে মানিয়ে নিয়ে ‘আধুনিকা’। হঠাৎ আশ্চর্য খবর রটল, জাপানিরা এবার অন্য রকম বোমা ফেলবে, দেখতে খেলনা পুতুলের মতো। শিশুদের সাবধানে রাখতে বলা হলো মায়েদের। যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যেও তিনি শোনান ‘কলকাতা’র নামকরণ নিয়ে মজার এক গল্প। সুতানুটি গোবিন্দপুরের জলা-জঙ্গল কিনেছিলেন ইংরেজ জব চার্নক। সেটিই এককালে হয়ে উঠল বিশিষ্ট নগরী কলকতা। সুতানুটি থেকে কলকাতা হলো কীভাবে? গল্পটি শুনুন, এক ইংরেজ সাহেব এলেন সুতানুটির ঘেষোডাঙায়। সেখানে ঝোপজঙ্গল থেকে গরুর জন্য ঘাস কেটে ফিরছিল একলোক। কাউকে না পেয়ে সাহেব লোকটিকেই জিজ্ঞেস করল, ‘এ জায়গাটার নাম কী?’ লোকটা তো আর ইংরেজি বুঝত না, ফলে সে ভাবল, সাহেব বুঝি জানতে চাইছে, ঘাসগুলো কবে কাটা। তখন বেশ করে জবাব দিল, ‘কাইল কাটা’। আর সাহেব বুঝল, ‘ক্যালকাটা’। এ রকম গল্প আরও কটি আছে। হাওড়া ব্রিজের গল্পটিও বেশ অদ্ভুত-আজগুবি। যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গেই আছে অভিবাসান্তরের ইতিহাস। রিজিয়ার লেখক হওয়ার প্রসঙ্গটি আছে এভাবে, ‘পূর্বপুরুষের দেশ থেকে এনেছিলাম গ্রামীণ জীবনাচারের অভিজ্ঞতা, সেইসঙ্গেই হয়তো নিজের মধ্যে বয়ে এনেছিলাম ঐতিহ্যগত মেধা ও জেনেটিক বিজ্ঞানের অবদান জিন। সে সুবাদে হয়তো দাদার “জিন” আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল তাঁর লেখার কলমটি। আমাকে হতে হলো কালি-কলমের মানুষ। হলাম লেখক।’ লেখক না হলে হতেন চিত্রকর বা ভাস্কর। পেনসিল স্কেচের দারুণ নেশা ছিল তাঁর। লিখেছেন, ‘এখনো কখনো কখনো ভাবি, চিত্রকর বা ভাস্কর হলেই নিজের সঠিক প্রতিভাটি প্রকাশ করতে পারতাম।’ ‘সেথা সব পড়শি বসত করে’ পর্বে আছে রিজিয়ার বেড়ে ওঠার জগৎ। ফরিদপুরের সংস্কৃতি, প্রকৃতি, প্রতিবেশই লেখকের পড়শি। এর ভেতর দিয়েই জীবনের পরিণতি-বিকাশ। প্রকৃতির সঙ্গে জীবনে মিশেছে গানের স্রোত—লোকসংগীত ও শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের সুর। দেশভাগের পর চারপাশে শুরু হয় ‘পাকিস্তানকরণ’। পোশাক, সংস্কৃতিতে আগ্রাসন, রবিঠাকুরের সংগীতের বদলে স্কুলের অ্যাসেম্বিলিতে কবি গোলাম মোস্তফার গান নির্ধারণ, নজরুলপনা ইত্যাদি। জানতে বাধ্য করা হচ্ছিল আল্লামা ইকবাল বড় কবি, রবিঠাকুর ও নজরুলের চেয়েও বড়। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় শুনলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নাম। সপ্তম শ্রেণীতে উঠে জানলেন, অন্যান্য বিষয় বাংলা পাঠ গ্রহণের অনুমতি থাকলেও ধ্রুপদী, আরবি ভাষা এবং বাধ্যতামূলক উর্দু ভাষা শিখতে হবে। আর শিক্ষকেরা ইতিমধ্যে জিন্নাহর টুপিও পরা শুরু করে দিলেন। খাঁটি মুসলমান হওয়ার হিড়িক চারদিকে। উর্দু বলতে, লিখতে ও শিখতে হবেই। বাংলা নাকি নাপাক ভাষা। পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রবণতা যাই হোক, রিজিয়ার অবস্থাটা তখন কী? পাকিস্তানের ইসলামি তমদ্দুনের পবিত্র পানিতে ‘ব্যাপটাইজড’ না হয়ে মনটাকে ধুয়ে নিলেন শাহলাল ফকিরের আস্তানার মারফতি মরমি গানের সলিলে। শেষ হলো ‘নদী নিরবধি’। শেষ করে মনে হলো ‘নদী নিরবধি’ আত্মজীবনী না ‘উপন্যাস’! জোনাকি কেন্দ্রীয় চরিত্র। তার সঙ্গে সঙ্গে অভিবাসান্তরিত হচ্ছে ঘটনাপ্রবাহ। আর ধরাবাঁধা জীবন নয়, বয়সের ধারা মেনে উপস্থিত হয়নি জীবন, জীবন এসেছে প্রসঙ্গের প্রয়োজনে। বরং এই গ্রন্থ পরিকল্পনায় ছিল তাঁর মহাযুদ্ধ আর অভিবাসান্তরের দর্শী জীবন।