User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
"যমুনা নদীর মুশায়রা' বইটির লেখিকা সেলিনা হোসেন। 'পদ্মা তোমার যৌবন চাই যমুনা তোমার প্রেম’- যমুনা প্রেমের এক তীর্থস্থান হিসেবে বরাবরই প্রেমিকের আরাধ্য হয়েছে। এই যমুনা তীরেই সম্রাট শাহজাহান তাঁর প্রেমিক সত্তার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন তাজমহল নির্মাণ করেন। যমুনার তীরে বাঁশি বাজিয়ে, যমুনার জলে সাঁতার কেটে, যমুনার তরঙ্গে নৌকা ভাসিয়ে বড় হয়েছেন কৃষ্ণ। এই যমুনার পাড়েই একদিন কৃষ্ণ দেখা পান অপরূপা রাধার। তারপর থেকেই দুজনের প্রেম। তারই ধারাবাহিকতায় এই যমুনা তীরেই একজন কবির জন্ম হয়; যিনি কবিতায় প্রেমের বীজ বপণ করে সব প্রেমিক হৃদয়ে সাড়া জাগিয়েছেন। সেই কবিরই কাহিনি ‘যমুনা নদীর মুশায়রা’ উপন্যাসটি।আগ্রা সত্তর বছরের এক কবি রজব হুসেন জং স্বপ্নে এক অসাধারণ কবির আগমন সংবাদ পান যমুনা নদীর কাছ থেকে। ‘এ নদীই কবির নদী, প্রেমের নদী- ভালোবাসার গভীর জলের স্রোতের নদী। একদিন এই নদীর ধারে বড় হবে একজন কবি। তাঁর কবিতা বেঁচে থাকবে শতাব্দীকাল জুড়ে।' কবির কথা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। কবি বলেন-‘আমাকে যমুনা নদী একটি বাচ্চার জন্মের কথা শুনিয়েছে। বলেছে ও আজ রাতেই আসছে।’ যমুনা নদীর কথাই সত্যি হয়। জন্ম নেন আগামী দিনের এক শ্রেষ্ঠ উর্দু কবি। ‘ছেলেটির নাম রাখা হয় মির্জা নওশা নজমুদদৌলা দবীরুল মুল্ক আসাদুল্লা খাঁ বাহাদুর নিজামে জং। আদর করে সবাই মির্জা নওশা বলে ডাকে।’ ছেলেটি আর কেউ নন; তিনিই মির্জা গালিব। মির্জা গালিবের পূর্ব পুরুষের আগমন ঘটে তুর্কিস্তান থেকে। তুর্কিরা যোদ্ধা জাতি। তাঁদের রক্তে যোদ্ধার বৈশিষ্ট্য সুদৃঢ়। তুর্কিস্তানের নিয়ম অনুযায়ী পুত্র সন্তান লাভ করে পিতার তরবারি আর কন্যা সন্তান লাভ করে পিতার যাবতীয় সম্পদ। কাজেই পুত্র জন্মের পরেই পিতা আব্দুল্লাহ ছেলেকে একজন যোদ্ধা হিসেবে কল্পনা করেন এবং সেভাবেই তাঁকে শিক্ষা দেবার চেষ্টা চলে। কিন্তু পুত্র সে সবে মন দিতে পারে না। তাঁর প্রেম যমুনা নদীর সাথে। যমুনা যেন তাঁর মনের ভাষা বুঝে; কবিতায় তা যেন প্রকাশ করতে চায়। কিন্তু বিধি বাম! পিতার মৃত্যু এবং তারপর তাঁর অভিভাবক চাচার মৃত্যু তাঁকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়। তারপর দুই কিশোর-কিশোরী গালিব ও ওমরাও বেগমের বিয়ে হয়। গালিবকে চলে যেতে হয় দিল্লিতে। গালিবের মনে হয়-‘আগ্রার যমুনা নদী, তাজমহল, আগ্রা ফোর্ট এবং ঘুড়ি ওড়ানোর অসীম আকাশ তাঁর পক্ষে ফেলে আসা কঠিন ছিল। কিন্তু সেই কঠিনকে মানতে হয়েছে তাঁকে।শুরু হয় দিল্লি জীবন। অভিজাত শ্রেণি ও কবিদের চোখে গালিব এক জবরদস্ত কবি হিসেবে পরিচিতি পান খুব সহজেই। প্রত্যেকটি আসরেই তিনি তাঁর শের দিয়ে মাতিয়ে রাখেন। একদিকে কবিতার জগৎ ও অন্যদিকে পারিবারিক জীবনে মির্জা গালিব মোটেই শান্তি পাননি। জীবনানন্দ দাশ যেমন তাঁর সময়ের কবিদের কাছে ছিলেন দুর্বোধ্য ঠিক গালিব ছিলেন সে সময়ের কবিদের কাছে দুর্বোধ্য। গালিবের শেরগুলো অনেক পাঠকই বুঝে উঠতে পারেননি। কিন্তু যাঁরা সমঝদার পাঠক ও শ্রোতা তাঁরা ঠিকই গালিবের কবিত্ব শক্তির পরিচয় পেয়েছিলেন।কবির কাছে পৃথিবী দুটি। ‘একটি আত্মার, অন্যটি মাটি ও জলের পৃথিবী। সাধারণত নিয়ম একটাই। অর্থাৎ যারা মাটি জলের পৃথিবীতে অপরাধী , তাঁরা আত্মার পৃথিবীতে শান্তি পাবে। যারা আত্মার বিশ্বে অপরাধী , তাঁরা মাটি জলের পৃথিবীতে শান্তি পাবে।'গালিব এই মাটির পৃথিবীর কবি। এ জীবন তাঁর কাছে সবচেয়ে মূল্যবান। তাই কবিতার রসদ সংগ্রহ করতে গিয়ে বেহিসেবী জীবন-যাপন তাঁকে করতে হয়েছে; ধারের কারণে জেলে পর্যন্ত তাঁকে যেতে হয়েছে, কিন্তু হার না মানা হার ছিল তাঁর অন্বিষ্ট। কবি চিরকালই বাইরের পৃথিবীর মানুষ; আত্মার শক্তিতে বলীয়ান। দুঃখ যেন কবিদের জীবনের সুর-সাকী। বয়ে চলতে হয় এক দুঃসহ জীবন আমরণ। মির্জা গালিবের জীবনের মর্মন্তুত কাহিনি যেন ‘যমুনা নদীর মুশায়রা’ । সেলিনা হোসেন কবি এবং কবির সময়কে এতটাই সুন্দর করে উপস্থাপন করেছেন যে, এখানে মোগল আমলের ধ্বংসস্তূপে যেন ব্রিটিশ পুঁজিবাদের ধ্বজা নতুন করে উড়তে থাকে এবং অভিজাত শ্রেণি বিশেষ করে মির্জা গালিবেরা হয়ে পড়েন কপর্দক শূন্য মানুষে। ফলে যা হবার তাই হয়েছে কবি বস্তুজগতে হয়েছেন ফতুর কিন্তু আত্মিক জগতে হয়েছেন পূর্ণ। ফলে গালিবের মৃত্যু যেন একজন কবির মৃত্যু নয় এক অস্থির সময়ের মৃত্যু। সেই সময় ও তখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার জন্য একবার পড়ে দেখতে পারেন বইটি।
Was this review helpful to you?
or
যমুনা নদী বললেই মনে পড়ে রাধা-কৃষ্ণের কথা। কিন্তু রাধা-কৃষ্ণ ছাড়াও যমুনার সাথে জড়িয়ে আছে আরেকটা নাম। সে হলো আগ্রা শহর। যে যমুনার তীরে তাজমহল গড়েছিলেন শাহ্ জাহান। সেই আগ্রায় আঠারো শতকের অস্তবেলায় জন্ম নেয় এক শিশু, পরবর্তীতে কাব্যের জগতে সে হয়ে ওঠে মুকুটহীন সম্রাট। নাম তার গালিব। যমুনার তীরে যে ছেলেটির জন্য, অল্প বয়সে পিতার মৃত্যুর পর একদিন অভিভাবক চাচাও মারা যান। তেরো বছর বয়সে তাকে বিয়ে দিয়ে দিল্লী পাঠানো হয়। তার শ্বশুর হন তার অভিভাবক। দিল্লীতেই বেড়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু ছেলেবেলা থেকে উদাসীন এই ছেলেটি বয়ঃপ্রাপ্ত হলে বুঝতে পারে সংসারের বাঁধন তার জন্য নয়। সে কেবল ভেসে যেতে চায় বাতাসের সাথে, কথা কইতে চায় নদীর সাথে আর লিখতে চায় কবিতা। গালিব সত্যিই সংসারে মণ দিতে পারেননি। কাজ তাকে করতে হয়নি। পিতা মারা যান নওয়াবের হয়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে। ফলে নওয়াব তার পরিবারকে পেনশন দিতেন। গালিবের সময় কাটতো বন্ধুদের সাথে হল্লা করে, মদ খেয়ে আর বাইজী বাড়ি গিয়ে। তাঁর স্ত্রী একের পর এক সন্তান প্রসব করেন, কখনও মৃত, কখনও জন্মের কিছুদিন পর তারা মারা যায়। সংসার গালিবের হয়নি, অথচ না তিনি তাঁর বিবিকে ছেড়ে গেছেন, না তাঁর বিবি ছেড়ে গেছে উদাসীন এক কবিকে। বাংলাদেশের সাহিত্যে জীবনী ভিত্তিক উপন্যাস খুব কম, তাও আবার ভিন ভাষার এক কবির জীবন ভিত্তিক উপন্যাস পাওয়া দুর্লভ বিষয়। সেই কাজটি করেছেন ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন। গালিবকে নিয়ে লিখেছেন বিশাল এক উপন্যাস। উপন্যাসের শুরু গালিবের জন্ম থেকে আর গালিবের মৃত্যুতে শেষ। উপন্যাসে উঠে এসেছে গালিবের বাল্য, যৌবন, বার্ধক্য। স্ত্রী, বন্ধুদের সাথে তাঁর সম্পর্ক। তাঁর কবিতা, তাঁর ভাবনা। সেলিনা হোসেন উপন্যাসিক হিসেবে সার্থক। বাংলা সাহিত্যে তিনি একটি উজ্জ্বল নাম। কিন্তু উপন্যাসটি যখন বিশাল একটা পটভূমিতে, এক কিংবদন্তীকে নিয়ে রচিত, সেখানে লেখিকা কতটা সফল? উপন্যাস আবর্তিত হয়েছে গালিবকে কেন্দ্র করে। তাঁর কথা, তাঁর কাজ, বন্ধুবান্ধব, এই থেকে আমরা সেই সময়কে কিছুটা ধরতে পারি। আলাদা করে লেখিকা সে সময়ের কথা বলেন নি। এমনকি আমরা যা শুনি, গালিবের মুখেই শুনি। উপন্যাসে এসেছে মোগল সাম্রাজ্যের শেষ অবস্থার কথা, ইংরেজদের কথা। কিন্তু যতটুকু না হলেই নয়, ঠিক ততটুকু। অনেকটা এমন যে লেখিকা গালিবকে একা ছেড়ে অন্য দিকের বর্ণনা দিতে চাননি। সিপাহী বিদ্রোহ, সম্রাট বাহাদুর শাহ্-র বিচার, মোগল সূর্যাস্ত এবং ব্রিটিশ শাসন নিয়ে বলা যেতো অনেক কিছু। কিন্তু উপন্যাস গালিবের কাছ থেকে সরে অন্য কোন স্রোতে বয়ে যায়নি। সিপাহী বিদ্রোহ কিংবা ইংরেজদের নিয়ে গালিব নিজেও কিছু লেখেন নি, বরং 'দস্তাম্বু'-তে করেছেন ব্রিটিশদের প্রশংসা। কেননা সে সময়ে তাঁর 'পেনশন' সংক্রান্ত জটিলতা চলছিল। লেখিকা হয়ত সে কারনে গালিবের মতো করেই সময়টা দেখিয়েছেন। এটা ঠিক যে উপন্যাসটাকে এই পরিসরে আরও অনেক সম্রিদ্ধ করা সম্ভব ছিল কিন্তু তবুও যেভাবে লেখা হয়েছে তা-ও কম না। একজন কবিকে দেখতে পাওয়া গেছে। ভাষার ব্যবহার কিছুটা দুর্বল মনে হলো, মনে হলো সেলিনা হোসেনের মুল লেখা না বরং কোন অনুবাদ পড়ছি। কোথাও কোথাও দুই একটা ইংরেজি শব্দের ব্যবহার অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। তবু, গালিবের কবিতা, গালিবের দুস্থতার বর্ণনা, সেই সঙ্গে সিপাহী বিদ্রোহের সময়ের টালমাটাল দিল্লীর বর্ণনা, সব মিলিয়ে সেলিনা হোসেনের কাজকে সাধুবাদ না জানিয়ে পারা যায় না।
Was this review helpful to you?
or
আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বের জীবনরস অবলম্বনে উপন্যাস রচনায় সেলিনা হোসেনের রয়েছে এক দীর্ঘ ও গভীর অভিনিবেশ। তাঁর এ ধারার উপন্যাসে ইতিমধ্যে চিত্রিত হয়েছে চর্যাপদ-এর জীবনপরিবেশ, মনসামঙ্গল-এর অন্তর্ভুক্ত চাঁদ সওদাগরের লোকপ্রিয় কাহিনি, চণ্ডীমঙ্গল-এর অন্তর্গত কালকেতু ও ফুল্লরার বৈচিত্র্যময় জীবনগাথা, আমাদের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির সবচেয়ে আরাধ্য ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথের বর্ণাঢ্য জীবন, বিপ্লবী নারী প্রীতিলতা ও ইলা মিত্রের কঠিন সংগ্রামশীলতা, বাংলাদেশের ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ কালপর্বের সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস প্রভৃতি। তাঁর এরূপ উপন্যাসভাবনার ক্ষেত্রে সর্বশেষ সংযোজন হলো, উর্দু গজলের কিংবদন্তি-পুরুষ মির্জা গালিবের কবিত্বময় জীবনযন্ত্রণা অবলম্বনে যমুনা নদীর মুশায়রা। এ ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিকের কল্পনাপ্রতিভা এই প্রথম বাংলা ভূখণ্ড অতিক্রম করে দিল্লি-আগ্রাকে স্পর্শ করেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে ঔপন্যাসিকের কল্পনাসূত্রকে বাস্তবমণ্ডিত করে তোলার আন্তর্গরজে ভৌগোলিক ও কালিক দূরত্বকে জয় করার জন্য তাঁকে ব্যাপৃত হতে হয়েছে এক কঠিন সংগ্রামে। মির্জা গালিবের জীবৎকালে (১৭৯৭-১৮৬৯) দিল্লি-আগ্রার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ, সেখানকার উর্দু ও ফারসিভাষী অভিজাত মুসলমানদের জীবনধারা, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও রাজদরবারকেন্দ্রিক কাব্যচর্চার আবহ প্রভৃতিকে বাস্তবোচিত করে তোলার অভিপ্রায়ে লেখককে আশ্রয় নিতে হয়েছে এক উত্তম কল্পনারসের। এ জন্য মির্জা গালিবের জীবন ও জীবনব্যাখ্যার বিচিত্রমুখী তথ্য সংগ্রহ, দিল্লি-আগ্রার ভৌগোলিক জীবনপরিবেশকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণসহ নিজেকে এমন একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনায় পর্যাপ্তভাবে দক্ষ করে তোলার লক্ষ্যে লেখককে পরিচয় দিতে হয়েছে গবেষণামূলক নিষ্ঠার। ইতিহাসের তথ্য নিয়ে উপন্যাস রচনা করতে হলে ইতিহাসরস ও জীবনরসের মধ্যে যে সামঞ্জস্য বিধান করতে হয়, এ ব্যাপারে লেখক সচেতন ছিলেন। প্রসঙ্গত, ঐতিহাসিক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি উক্তি স্মরণীয়। রাজসিংহ উপন্যাস বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন: ‘ইতিহাস এবং উপন্যাসকে একসঙ্গে চালাইতে গিয়া উভয়কেই এক রাশের দ্বারা বাঁধিয়া সংযত করিতে হইয়াছে। ইতিহাসের ঘটনাবহুলতা এবং উপন্যাসের হূদয়বিশ্লেষণ উভয়কেই কিছু খর্ব করিতে হইয়াছে—’। সেলিনা হোসেনের ক্ষেত্রেও আমরা লক্ষ করি, তিনি মির্জা গালিবের জীবৎকালে সংঘটিত ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ নামে বহুলপ্রচলিত ভারতের প্রথম স্বাধীনতাসংগ্রামের ঘটনাটিকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ইতিহাস-সত্যের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেও কবিহূদয়ের পরিপ্রেক্ষিতকে মান্য করেছেন। বিদ্রোহী সেপাইদের দ্বারা সৃষ্ট রক্তপাত এবং পরবর্তীকালে বিজয়ী ইংরেজদের সৃষ্ট রক্তপাত—এই উভয়ই যে কবিহূদয়ে সমান যন্ত্রণার কারণ হয়, তা উল্লেখে লেখক পরিচয় দিয়েছেন ঔপন্যাসিক সততার। সংগত কারণেই সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসকে ছাপিয়ে কবি মির্জা গালিবই উপন্যাসে বড় হয়ে উঠেছেন। সমগ্র উপন্যাসেই বর্ণিত হয়েছে একজন মহৎ কবির জীবনালেখ্য। ফলে কবিত্বশক্তির জাগরণেই উপন্যাসটি প্রাণবন্ত। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপন্যাসের সমগ্র আবহটিই কবিত্বময়। কবি গালিবের জন্ম-ইতিহাসের মধ্যে লেখক প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন কবিত্বের এক চমৎকার ব্যঞ্জনা। যমুনা নদীর কাছ থেকেই কবি গালিবের জন্মের অগ্রিম বার্তাটি লাভ করেন আগ্রার এক প্রসিদ্ধ কবি। এই ঘটনার মধ্যে উপন্যাসোচিত বাস্তবতা ক্ষুণ্ন হলেও ইতিহাসখ্যাত এক কবির জীবনাখ্যানের সূচনাসূত্র হিসেবে এটি যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং পাঠক এর কাব্যিকতায় গভীরভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। লেখক জোর দিয়েছেন কবির জীবনবৈশিষ্ট্যের ওপর, যেখানে বিষয়বুদ্ধিহীন সুরাসেবী এক কবির জীবনযন্ত্রণাই মুখ্য। দ্রাক্ষারসের আসক্তির মধ্যে তিনি খুঁজে পান তাঁর কবিত্বের উৎসশক্তি। সংসারের মধ্যে থেকেও তিনি সংসারকে শৃঙ্খল মনে করে অন্তরে লালন করেন এক বিবাগী সত্তাকে। ফারসি কবি ওমর খৈয়ামের যোগ্য উত্তরসাধক এই কবির কাছে সুরা আর কবিতাই শেষ কথা। তার মধ্যে সুরাশক্তির পাশাপাশি রয়েছে বাইজি-আসক্তিও। বাইজি-সন্নিধানে বিপুলভাবে তৃপ্তি বোধ করে তার সৃজনশীল সত্তা। ঋণ করে ঘি খাওয়ার চার্বাকনীতিতেও তিনি বিশ্বাসী। আমৃত্যু তাঁর জীবন ঋণভারে জর্জরিত হলেও আসক্তিবিহীন পৃথিবী তাঁর কাম্য নয় মোটেই। তিনি তাঁর বংশবৃত্তির পারম্পর্য ভেঙে তলোয়ারকে পরিণত করেছেন কলমে, যে কলমে আছে প্রেম, যে প্রেম দিয়ে চেয়েছেন জগজ্জয় করতে। হূদয়ের আগুন দিয়ে তিনি কবিতার আলো জ্বালেন। লেখকের চমৎকার ভাষাভঙ্গিটিও মির্জা গালিবের কাব্যময় জীবনপরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক হয়েছে। বৃহদায়তনের এই গ্রন্থের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লেখক গালিবের জীবনস্রোতের মধ্যেই গেঁথে দিয়েছেন তাঁর কাব্যপ্রবাহকে। লেখকের জন্য এটি সহজসাধ্য ছিল না। গালিবের সমস্ত জীবন যে কাব্যসাধনায় উৎসর্গীকৃত সেই সত্যটিই পরস্ফুিট হয়েছে এরূপ বিন্যাসে।