User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
কবি, প্রবন্ধিক ও রবীন্দ্র-গবেষক আহমদ রফিক ছাত্র ছিলেন চিকিৎসাবিদ্যার; কিন্তু আকৈশোর তাঁর আগ্রহ শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে। সংস্কৃতির অন্য শাখার মতো চিত্রশিল্প নিয়েও তাঁর কৌতূহল যে কত গভীর তা অনুভব করা যায় একযুগ আগে যখন বেরোয় তাঁর রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্প বইটি (১৯৯৬)। আর এ বছর, যখন তাঁর বয়স ৭৯ বছর, বেরিয়েছে চিত্রে ভাস্কর্যে রূপসী মানবী শীর্ষক বই; যাতে চমৎকারভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিল্পবিশ্বে নারী-আরাধনার রূপ ও স্বরূপ। পূর্ব-পশ্চিম সর্বত্রই ভাস্কর ও চিত্রশিল্পীদের কাছে বিষয় হিসেবে নারীরূপ বিশেষত নগ্ননারীর দেহবল্লরী কেন এত আরাধ্য তার ইতিহাস যেমন লিপিবদ্ধ হয়েছে এ গ্রহে তেমনি উন্মোচিত হয়েছে তার অন্তর্নিহিত কারণ। শিল্পীরা সৌন্দর্যের পূজারি। সুন্দরের আরাধনাই তাঁদের সব কর্মযজ্ঞের লক্ষ্য। সৌন্দর্য সৃষ্টির মধ্যেই তাঁরা খুঁজে পান শিল্পীজীবনের সার্থকতা। সৌন্দর্য অন্বেষণের অন্তর্তাগিদেই শিল্পীরা কখনো প্রকৃতিমুখী, কখনো মানবমুখী। মানবীয় সৌন্দর্যের পরিতৃপ্তি সাধনের জন্য তাঁরা মূলত মানবীরূপই ধ্যান করেন। এই ধ্যান যে সর্বদা তাঁদের মুক্তচিন্তার অনুসারী হতে পেরেছে তা কিন্তু নয়। ধর্মীয় চেতনা কখনো কখনো সে ক্ষেত্রে বাধার দেয়াল তুলেছে, বিশেষত নারীর নগ্নরূপ অঙ্কনের ক্ষেত্রে। শিল্পীরা তাই শুরুতে পৌরাণিক ও ধর্মীয় চরিত্রকেই নির্বাচন করেছেন সৌন্দর্য সৃষ্টির উপায় হিসেবে। তা ছাড়া সমাজ, রাষ্ট্রসহ সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতটিই একসময় ছিল পুরোপুরিভাবে ধর্মীয় চেতনায় আচ্ছন্ন। শিল্পীদের পক্ষেও এর বাইরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। এভাবে পৃথিবীর আদি মানবী হিসেবে ইভ, গ্রিক পুরাণের দেবী আফ্রোদিতি, ভেনাস, যিশুমাতারূপে ম্যাডোনা, ভারতে যক্ষিণী, রাধাসহ নানা দেবী-চরিত্র চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের বিষয় হয়েছে। একই ধরনের চরিত্র বিভিন্ন শিল্পী-ভাস্করের হাতে বছরের পর বছর বা শতকের পর শতক ধরে অঙ্কিত হয়েছে। তবে শিল্পীর ভিন্ন ভিন্ন রুচি-বৈশিষ্ট্যের কারণেই তা ধারণ করেছে স্বতন্ত্র রূপ ও ভাষা। পৌরাণিক ও ধর্মীয় চরিত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রেও পরিহার করা হয়নি নগ্নতাকে। যৌনাবেদন সৃষ্টির সচেতন প্রচেষ্টা না থাকলেও শিল্পীর অবচেতন মনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে কোনো কোনো শিল্পকর্মে এড়ানো যায়নি তার পরিস্কুটন। কেননা, নারীর নগ্নরূপের সৌন্দর্য হিসেবে সর্বত্রই নির্বাচিত হয়েছে উন্নত বক্ষ, নির্মেদ উদর, ক্ষীণ কটি, গুরু নিতম্ব, সুমসৃণ ত্বক ও মুখমণ্ডলের সুসৌম্য রূপ। পরবর্তীকালে ধর্মীয় ও পৌরাণিক তথা কাল্পনিক চরিত্র যখন পরিহৃত হয়ে সমাজ জীবনের রক্ত-মাংসের বাস্তব নারীর নগ্নরূপ অঙ্কিত হয়েছে তখন এর পটভূমি বা যুক্তি হিসেবে প্রায়ই নির্বাচন করা হয়েছে স্মানরত অথবা স্মানের পূর্ব বা পরবর্তী অবস্থাটিকে। এ বইয়ে ইউরোপের পাশাপাশি ভারতের চিত্র-ভাস্কর্যে রূপসী মানবীর বৃত্তান্তও তুলে ধরা হয়েছে। তবে ইউরোপের ইতিহাসটি যত বিস্তৃত ও ব্যাপক পরিসরে উপস্থাপিত হয়েছে ভারতের অংশটি তত নয়। নগ্ন নারীরূপের ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ খাজুরাহো-অংশ আলোচিত হয়নি। আবার ইউরোপের ক্ষেত্রেও উনিশ শতকের আগের ইতিহাস যত বিস্তৃত, পরবর্তী ইতিহাসটি তত নয়। আর ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে উনিশ ও বিশ শতকের ইতিহাসটি মোটামুটিভাবে পরিহৃত হয়েছে। হেমেন্দ্রনাথ মজুমদারের সিক্তবসনা নারীরূপ এ ক্ষেত্রে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য, অথচ আলোচনায় তা বাদ পড়েছে। চিত্রসূচির ক্ষেত্রে ভারতীয় অংশ আরও বেশি বৈষম্যের শিকার। ‘শিল্পকলার তাত্ত্বিক বিচার’ শীর্ষক অধ্যায়ে প্রাচ্য ও প্রতীচ্য উভয় অংশের সৌন্দর্যতাত্ত্বিকদের ধারণাগুলো বিশ্লেষিত হয়েছে। তবে নারী-সৌন্দর্য সম্পর্কে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ধারণায় অমিলের দিকটি আলোচিত হওয়া প্রাসঙ্গিক ছিল। এশিয়া-আফ্রিকার কৃষ্ণবর্ণদের নিয়ে শ্বেতাঙ্গ ইউরোপের বিদ্বেষের ব্যাপারটি শিল্পকলার ক্ষেত্রে কী ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে এ প্রসঙ্গে তা বিশ্লেষিত হতে পারত। ভারতবর্ষে আর্য, পশ্চিম এশীয় ও ব্রিটিশ-এই তিন পর্বের বহিরাগত শ্বেতাঙ্গ শাসকদের আগমন আমাদের মধ্যে নারীসৌন্দর্য-বিষয়ক ধারণা গঠনেও যে ঔপনিবেশিক ভূমিকা রেখেছে, তুলে ধরা হয়নি তার অন্তঃসারশূন্যতা। প্রসঙ্গত ্নরণীয় যে চিত্রে-ভাস্কর্যে নগ্ন নারীরূপের পাশাপাশি নগ্ন পুরুষের রূপও অঙ্কিত হয়েছে, যদিও তা সংখ্যায় খুবই অল্প। চিত্রী-ভাস্করেরা পুরুষ বলেই কি এ বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, না কি মানবীরূপের মধ্যেই নিহিত সৌন্দর্যের সব বীজ? এ প্রশ্নের একটা মীমাংসা প্রয়োজন। সাহিত্যেও আমরা কেবল নারী-সৌন্দর্যই উপস্থাপিত হতে দেখি। এটা পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ফল কি না-সেটা বিশ্লেষণসাপেক্ষ। কেননা, প্রাণিজগতের দিকে তাকালে নারীর চেয়ে পুরুষের সৌন্দর্যই বেশি চোখে পড়ে। বাঘ, সিংহ, হরিণ, মোরগ, ময়ূরসহ বিভিন্ন প্রাণীর কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। বইটি নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা ভাষায় এ ধরনের একটি বই শিল্পানুরাগী পাঠকদের রসতৃপ্তির সহায়ক হবে। এই বয়সেও যে লেখক শিল্পবোদ্ধা পাঠককুলের সৌন্দর্যবোধ ও সাংস্কৃতিক চেতনাকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে এমন গবেষণাধর্মী কাজে সক্রিয় আছেন, সেটাই ভাবতে অবাক লাগে। সে জন্য লেখকের প্রতি সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা জানাই।