User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
আত্মকথা মানে যে নিজের কথা নয়, সময়ের কথা, সমকালীন মানুষের কথা, জীবনবোধের কথা—সুলতানা কামালের আত্মকথা: নীলিমার নিচে পাঠ করে সেটাই মনে হলো। তিনি বিখ্যাত মায়ের সন্তান, আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী। যদিও এই তিনের মধ্যে তাঁর পরিচয় সীমিত নয়। নিজের মেধা, মনন ও অধ্যবসায়ে তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন আদর্শ ও সমাজহিতৈষী মানুষ হিসেবে। তাঁর মানবাধিকারের লড়াই অংশ হয়ে ওঠে জীবনেরই। এ রকম একজন মানুষের আত্মকথায় দেশ, সমাজ ও জনমানুষের জীবনসাধনার কথা থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। সে দিক থেকে সুলতানা কামাল আমাদের আশাহত করেছেন বলা যাবে না। এক অসাধারণ পারিবারিক আবহে সুলতানা কামাল বড় হয়েছেন। তাঁর মা সুফিয়া কামাল ছিলেন কবি এবং এ দেশে নারী আন্দোলনের পথিকৃত্। শুধু নারী আন্দোলনই বা বলি কেন, প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন এই ‘কন্যা সাহসিকা’। স্বাভাবিকভাবে মায়ের আদর্শ ও জীবনসাধনা তাঁকে প্রাণিত ও উজ্জীবিত করেছে, জীবনবোধ তৈরিতে সহায়ক হয়েছে। সুলতানা কামাল জানেন, জীবন বিনির্মাণের কাজটি করতে হয় নিজেকেই। তাঁর আত্মকথায় আমরা সেই বিনির্মাণের চিত্রটি পাই। আরও পাই চলার পথে কাদের তিনি সহযাত্রী হিসেবে পেয়েছেন, কীভাবে সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক বাধাগুলো অতিক্রম করেছেন, কীভাবে অধীতজ্ঞানকে তিনি সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেছেন, করছেন। এ কারণেই বিদেশি কোম্পানির আকর্ষণীয় বেতনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে মফস্বলে গিয়ে অধিকারহারা নারীদের জন্য কাজ করতে দ্বিধা করেননি তিনি। সুলতানা কামাল তাঁর আত্মকথা সাজিয়েছেন ১২টি পর্বে যথাক্রমে—আমাদের বাসাবাড়ি, বাবার সাতকাহন, পারিবারিক আবহ, মা বেগম সুফিয়া কামাল, বঙ্গবন্ধু পরিবার, অন্য মানুষ, মুক্তিযুদ্ধ বিরাট ফলন্ত ভূখণ্ড, যুদ্ধশেষের নতুন জীবন, নিজের পরিবার, স্মরণীয় যারা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ও আমার আমি। এতে তাঁর পারিবারিক আবহ, শৈশব ও কৈশোরের কথা যেমন আছে, তেমনি আছে সেই সময়ে বেশ কজন বিখ্যাত মানুষের সাহচর্যের কথাও। সুলতানা কামালের বেড়ে ওঠার সময়েই দেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে মহাপ্রলয় ঘটে, তিনি এর একজন সাক্ষীমাত্র নন, অংশীদারও। আটষট্টি-ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন, সংস্কৃতির লড়াই এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সক্রিয় ভূমিকার কথাও আমরা জানি। এসব বিষয়ে আরও বিস্তৃত বিবরণ থাকলে নতুন প্রজন্মের পাঠকেরা জাতির মুক্তির লড়াই সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা পেতেন। তার পরও টুকরো টুকরো কথায় ও স্মৃতিতে যা বলেছেন, তাও কম কিসে? সুলতানা কামালের কিছু কিছু স্মৃতি ও জীবনচেতনা আমাদের নাড়া দেয়, ভাবতে শেখায়, প্রণোদনা জোগায়। একইভাবে বইয়ে উল্লিখিত কিছু ঘটনা আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যকার বিরোধ-সংঘাত সম্পর্কে খালেদ মোশাররফ বলেছিলেন, ‘আগে দেশ স্বাধীন হোক, তাহলে দেখতে পাবে আমাদের নিজেদের মধ্যে কতজন কতজনকে মারে।’ স্বাধীনতার পর তাঁর এই মন্তব্য অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাবে তা কেউ ভাবেননি। এ যাবৎ আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে যত অঘটন ঘটেছে, তার বীজ কি মুক্তিযুদ্ধের ভেতরেই উপ্ত ছিল? এই প্রশ্নের জবাব সুলতানা কামাল দেননি। এটি হয়তো আত্মজীবনীর বিষয়ও নয়, তবে জাতির জীবনকাহিনি লিখতে হলে এসব প্রশ্নেরও জবাব পাওয়া দরকার বলে মনে করি। একটি অধ্যায়ে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারে যোগদান ও পদত্যাগের পটভূমি ব্যাখ্যা করেছেন। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের লক্ষ্য। সুলতানা কামাল বুঝতে পারলেন, যে উদ্দেশ্যে তিনি ও তাঁর সহযাত্রীরা দায়িত্ব নিয়েছেন, তা সফল হবে না। রাষ্ট্রপতি উপদেষ্টা পরিষদকে গুরুত্বই দিচ্ছেন না। প্রতিবাদে তাঁরা চারজন বেরিয়ে এলেন। তাঁদের এই সাহসী ভূমিকা দেশবাসী দীর্ঘদিন মনে রাখবে। সংক্ষেপে হলেও সুলতানা কামাল সে সময়ের একটি চিত্র তুলে ধরেছেন, যা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদাধিকারীর চরিত্র উন্মোচন করেছে। সব শেষে সুলতানা কামাল নিজের মুখোমুখি হয়েছেন, যা প্রতিটি মানুষেরই হওয়া উচিত। সেখানে আমরা অন্য এক সুলতানা কামালকে পাই। তিনি লিখেছেন, ‘আমার একটা পথিকমন আছে, সেটা কোথায় যে ঘুরে বেড়ায় আমি নিজেও অনেক সময় বুঝতে পারি না।’ সবার মধ্যে থাকলেও এই পথিকমনই হয়তো তাঁকে সবার থেকে আলাদা করে রাখে। প্রতিটি চিন্তাশীল মানুষকেই করে। জীবনদর্শন সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি হলো, ‘ধারার মধ্যে ঢুকে আমাকে মার্ক্সিস্ট, সোশালিস্ট, ফ্যামিনিস্ট হতে হবে, সে ধরনের ধারণা আমার মনোপুত হয়নি।’ পারিবারিক আবহের সরস বর্ণনা পাই তাঁর লেখায়, ‘ভাই-বোনদের নিজস্ব লাইব্রেরি ছিল। সবাই যার যার মতো পাড়ার বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে বই বদল করে পড়তাম। বাবা আমাদের লাইব্রেরির নাম দিয়েছিলেন মনিমঞ্জুষা।’ এই আত্মকথায় আরেকজন মহান মানুষের সাক্ষাত্ পাই, তিনি হলেন সুলতানা কামালের বাবা কামালউদ্দিন আহমদ। তাঁর মানবতাবোধ, হূদয়বৃত্তি ছিল তুলনারহিত। মুহম্মদ জাফর ইকবাল ভূমিকায় যথার্থই লিখেছেন, ‘এই বইটি যেন তাঁর জীবনের একটা জানালা, এটা দিয়ে উঁকি দিয়ে আমরা সুলতানা কামালের ভেতরের মানুষটিকে একঝলকের জন্য দেখতে পাই।’ সুলতানা কামাল আশাবাদী ও প্রতিবাদী মানুষ। সেই প্রেরণাও হয়তো মায়ের কাছে পেয়েছেন। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের শত বঞ্চনা, অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি আর সুবিধাবাদীদের আস্ফাালন; এর পরও অসংখ্য সাধারণ মানুষ আর নতুন প্রজন্মের উজ্জ্বল কিছু মুখের অনুপ্রেরণা না থাকলে এটা কঠিন হতো।’ সুলতানা কামাল মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। ষাট ও সত্তরের দশকে সাংস্কৃতিক জগতে তাঁর অবাধ পদচারণা ছিল। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কচিকাঁচার আসর সংগঠিত করেছেন। কোনো রাজনৈতিক বা ছাত্র সংগঠনে নাম না লেখালেও তিনি এমন এক সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন, যেখানে সামাজিক বৈষম্য থাকবে না, ভেদ থাকবে না নারী ও পুরুষে। প্রতিটি মানুষ সেখানে মর্যাদার সঙ্গে বাস করবে। সেই সমাজ আমরা কবে পাব? অনেকের আত্মজীবনীতে দৃষ্টিকটুভাবে আত্মপ্রচারণা থাকে। নিজের কৃতিত্ব-মহিমা প্রচারের পাশাপাশি অন্যকে হেয় করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সুলতানা কামাল এ থেকে অবশ্যই মুক্ত। যে কারণে তাঁর আত্মকথায় ব্যক্তির চেয়ে সমষ্টি প্রাধান্য পেয়েছে। এক জীবনের কথা হয়ে উঠেছে বহুজনের জীবনকথা। তবে এত বিপুল বর্ণাঢ্য জীবনকাহিনি ১০০ পৃষ্ঠার স্বল্পায়তনে বলতে গিয়ে তিনি নিজের ও সহযাত্রীদের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। আশা করি, পরবর্তী সংস্করণে তিনি বিস্তৃতভাবে পাঠককে জানাবেন, যে কথা এখানে বলতে পারেননি। বইটি নতুন প্রজন্মের পাঠকদের অনুপ্রেরণা দেবে, সতীর্থ ও সমকালীনদের দাঁড় করাবে আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি। সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ১৬, ২০১০