User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
মুক্তিযুদ্ধ কখনো পুরোনো হয় না, হারিয়ে যায় না, তা দীপ্র হয়ে থাকে দেশবাসীর মননে চিন্তায় এবং রক্তের অক্ষরে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণায় গৌরবের কিছু নেই, যদি না আমরা এর চেতনাকে, স্বপ্নকে হূদয়ে ধারণ করতে পারি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গত ৩৯ বছরে দেশে প্রচুর বই প্রকাশিত হয়েছে, বেশির ভাগই স্মৃতিচারণামূলক। সেই তুলনায় বিশ্লেষণধর্মী বা গবেষণামূলক বইয়ের সংখ্যা খুবই কম। আর স্মৃতিচারণায় ঘটনার নিরপেক্ষ উপস্থাপনার চেয়ে লেখকের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিই প্রাধান্য পায়। ব্যক্তিবন্দনার নিনাদে সমষ্টি আড়ালে পড়ে যায়। সে দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক আলোচনা ব্যক্তির চেয়ে ‘গণ’ অগ্রাধিকার পাবেন, এটাই প্রত্যাশিত। তবে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকার কথা বলার সমস্যা হলো, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে খাটো করে দেখা। মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে নিঃসন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে। এর অর্থ এই নয় যে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অবদান গৌণ। বরং প্রতিষ্ঠানের বাইরে বিপুলসংখ্যক মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হয়েছেন; যাঁদের চালচুলা নেই, সংগঠন নেই। এঁদের কথা ইতিহাসে লেখা হয় না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: ঢাকা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান গ্রন্থের অন্যতম সম্পাদক রঙ্গলাল সেন বামপন্থী রাজনীতি করেছেন। তাঁর লেখা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে ভদ্রলোকের চেয়ে সাধারণ মানুষের অবদানের কথাই বেশি প্রত্যাশিত ছিল, যা আলোচ্য বইয়ে প্রায় খুব একটা দেখা যায় না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা নিয়ে এর আগেও বেশ কিছু বই বেরিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে রাইফেলস বাহিনী, পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে আলাদা কাজ হয়েছে। আলোচনায় এসেছে অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাও। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: ঢাকা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান বইটি নিশ্চয়ই মননশীল পাঠকের মনোযোগ দাবি করে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ-লেখকদের পাশাপাশি কয়েকজন নবীন গবেষকের লেখাও স্থান পেয়েছে। আরও কৌতূহলোদ্দীপক হলো, প্রবীণদের লেখায় যথেষ্ট মননশীলতা ও অধ্যবসায়ের ছাপ রয়েছে, যেটি অনেক প্রবীণের লেখায় অনুপস্থিত। বইটিতে মোট ২৫টি প্রবন্ধ আছে। এর মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে মাত্র একটি, বাকি সবটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক। কয়েকটি লেখা মুক্তিযুদ্ধের বেশ আগের পটভূমিতে। বইয়ের লেখাগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক, দ্বিতীয় ভাগে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি হিসেবে বিভিন্ন গণসংগ্রামের কথা আছে। তিন সম্পাদক ছাড়াও লেখক তালিকায় আছেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, অজয় রায়, রফিকুল ইসলাম, সনত্ কুমার সাহা, মহিউদ্দিন আহমদ, কামাল হোসেন, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, কামাল হোসেন, কাবেরী গায়েন, কে এম মহসীন, আতাউস সামাদ, কালী রঞ্জন শীল, গোপাল কৃষ্ণ নাথ, মো. আনোয়ার হোসেন, স্বদেশ রায় প্রমুখ। কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তের ‘সংস্কৃতিকেন্দ্র: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’, অমূল্য ভূষণ সেনের ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলার বিপ্লবসাধনা’, রঙ্গলাল সেনের ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতির প্রথম পঁচিশ বছর: মধুদার বাবা আদিত্যের আমল’-এর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্ক অত্যন্ত দূরবর্তী। তা সত্ত্বেও এগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য আছে। সেই সঙ্গে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন নিয়ে একটি লেখা থাকলে সংকলনটি আরও সমৃদ্ধ হতো। সম্পাদক হিসেবে যাঁদের নাম ছাপা হয়েছে তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষক। অবশ্য বইয়ের কিছু দুর্বলতার কথা সম্পাদকত্রয় ভূমিকায়ই স্বীকার করে নিয়েছেন। সংকলিত ২৩টি প্রবন্ধ দুটি গ্রন্থ, তিনটি স্মরকগ্রন্থ, একটি সাময়িকী ও একটি দৈনিক পত্রিকা থেকে নেওয়া হয়েছে। আর নতুন প্রবন্ধ হিসেবে যেটি ছাপা হয়েছে, সেটিই বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতিভাত হয়েছে। জগন্নাথ হল ও ইকবাল হলের কথা জানলেও আমরা জানি না অন্যান্য হলে সেদিন কী ঘটেছিল। তুহিন রায়ের লেখাটিতে তার বিশদ বিবরণ আছে, আছে ক্যাম্পাসে নিহত শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মচারীদের তালিকাও। এসব তথ্য নতুন প্রজন্মের পাঠকদের জন্য খুবই জরুরি। সে কারণে নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বইটির গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পাকিস্তানিদের গণহত্যার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। কাবেরী গায়েনের ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জাতিকে বারবার পথ দেখাতে হয়েছে’, রফিকুল ইসলামের ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’, অজয় রায়ের ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা শ্বিবিদ্যালয়’, আবুল মাল আবদুল মুহিতের ‘বাংলাদেশ জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রবন্ধও পাঠকচিত্তকে নাড়া দেবে। এ ধরনের বইয়ের সম্পাদকদের যে মনোযোগ ও পরিকল্পনা থাকা দরকার, বইটিতে এর কিছুটা হলেও অনুপস্থিতি লক্ষ করা যায়। শেষে দুটি স্মৃতিকথা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। কালী রঞ্জন শীলের ‘পঁচিশে মার্চে জগন্নাথ হলের সেই ভয়াল রাতের স্মৃতি’ ও গোপাল কৃষ্ণ নাথের ‘২৫শে মার্চের কালরাতে জগন্নাথ হল’। যা বহুল পঠিত। এ ধরনের বইয়ে লেখকদের পরিচয় থাকা জরুরি। কিন্তু সম্পাদকত্রয় সেই কষ্টটুকু করেননি। সংকলনগ্রন্থে যাঁদের লেখা সন্নিবেশিত হয়েছে, তাঁরা প্রায় সবাই কীর্তিমান। কেউ মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছেন, কেউ নানাভাবে সহায়তা করেছেন। কেউ কেউ জেল-জুলুমও সহ্য করেছেন। আবার সম্পৃক্ত থাকার কারণে নিজের বা সহযাত্রীদের ভূমিকার কথা বেশি এসেছে। মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জীবন দিয়েছেন—এ কথা যেমন সত্য, তেমনি অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী একাত্তরে ক্লাস করেছেন তাও অসত্য নয়। মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুব বেশি নয়। এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক দুর্বলতাও বটে। সম্পাদকদের দাবি অনুযায়ী, বইটিতে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান সম্পর্কে পাঠক মোটামুটি ধারণা পেলেও, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে মাত্র একটি রচনায় তাদের অতৃপ্তি থেকেই যাবে। সেদিন পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যেভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, যেভাবে এপারের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিলেন তার তুলনা মেলা ভার। বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁদের অতিথি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগও দিয়েছিলেন। বাংলার বাইরে বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক খুব কম বইয়ে এসবের উল্লেখ থাকে। অনেকে ভাবেন প্রতিবেশী সুহূদদের অবদানের কথা স্বীকার করলে নিজেদের মাহাত্ম্য কৃতিত্ব খাটো হয়ে যাবে। সে দিক থেকে প্রবন্ধটির আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সম্পাদককে ধন্যবাদ জানাই আগের প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত লেখা নিয়ে এ রকম একটি সংকলন প্রকাশের জন্য। ভবিষ্যতের ইতিহাস রচয়িতাদের জন্য এটি আকরগ্রস্থ হিসেবে বিবেচিত হবে।