User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
১. জুলিয়াস ফুচিকের 'নোট্স্ ফ্রম দি গ্যালোজ- এর বাংলা অনুবাদ 'সূর্যোদয়ের গান'। অনুবাদ করেছেন আনন্দময়ী মজুমদার। বইটির মুখবন্ধ লিখেছেন হাসান আজিজুল হক। মুখবন্ধে ফুচিক সম্পর্কে, ফুচিকের মতো আরো যারা মুক্তিকামী যোদ্ধা তাঁদের বিপ্লব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন হাসান আজিজুল হক। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র মুখ থুবড়ে পড়লেও সমাজতন্ত্রের আদর্শবাদ যে বিভ্রম নয় তা নিয়ে মূল্যবান একটি মূল্যায়ণ আমরা তাঁর কাছ থেকে পাই। সেই সাথে সূর্যোদয়ের গানের অনুবাদকের কথা হাসান আজিজুল হক এভাবে বলেছেন- অনুবাদক আনন্দময়ী মজুমদার পাবলো নেরুদার 'মেময়র্স- এর অনুবাদ করেছেন ... প্রতিভাময়ী এই তরুণী অনুবাদের জন্যই অনুবাদ করেন না, সেটা তাঁর অনুবাদকর্মের নির্বাচন থেকেই টের পাওয়া যায়। এই অনুবাদে মূল ইংরেজি থেকে না সরে গিয়ে একটি অসাধারণ কাজ যে করা হয়েছে তা বইপাঠের আগেই আমাদের জানা হয়। অনুবাদক আনন্দময়ী মজুমদারের কোনো ভূমিকা কথন বইটিতে আমরা পাই নি। তাই লেখক ঠিক কোন কারণে এই বইটির অনুবাদে হাত দিলেন তা পাঠকের জানা হয় না। ২. জুলিয়াস ফুচিক কে? তাঁর পরিচয় আর বেড়ে ওঠা সম্পর্কে জানতে চলুন আমরা বই এর ভূমিকা অংশে যাই- ভূমিকায় স্যামুয়েল সিলেন জানান, জুলিয়াস ফুচিক চেকোস্লোভাকিয়ান একজন সাংবাদিক, সাহিত্য সমালোচক এবং কমিউনিস্ট নেতা ছিলেন। ১৯০৩ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারিতে তিনি জন্ম নেন। ৪০ বছর বয়সে ১৯৪৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর নাৎসি কোর্টে ফাঁসির মাধ্যমে বার্লিনে তাঁর মৃত্যু হয়। জুলিয়াস ফুচিকের বাবা ইস্পাত কারখানার শ্রমিক ছিলেন। চোদ্দ-পনের বছর বয়স থেকেই শ্রমিক সংগঠন আর স্বদেশের সাংস্কৃতিক জগতে জুলিয়াস ফুচিকের কাজ শুরু হয়। ফুচিক সাহিত্য, মিউজিক এবং আর্ট নিয়ে প্রাহার বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। সেসময় তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখার মাধ্যমে প্রথম সারির নেতা হিসেবে পরিচিতি পান। ১৯২৯ সালে তিনি নির্মাণ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক হন। কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশিত মূল রক্তসঞ্চালনের যন্ত্র রুদে প্রাদোর সম্পাদক হন এরপর। জুলিয়াস ফুচিকের গল্প জানতে হলে চেকোস্লোভাকিয়ার ইতিহাস পাঠ করতে হবে, মুখবন্ধে হাসান আজিজুল হক আমাদের সে গল্প শোনান- ১৯৩৪ সালে হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হন। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তিনি চেকোস্লোভাকিয়ায় জাতিগত অসন্তোষ সৃষ্টিতে প্ররোচণা দিতে থাকেন। তখন চেকোস্লোভাকিয়ায় চেকদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০ লক্ষ, স্লোভাক প্রায় ২০ লক্ষ, জার্মান প্রায় ৩৫ লক্ষ, হাঙ্গেরিয়ান প্রায় ৭ লক্ষ আর রুথেন প্রায় ৪ লক্ষ। হিটলার জাতিগত বিরোধ তৈরী করে ১৯৩৯-এর মার্চে তার নাৎসি বাহিনী (হিটলারের নাৎসিবাদ অনুযায়ী জার্মানরাই প্রকৃত আর্য এবং শ্রেষ্ঠ জাতি, এই নাৎসিবাদ বা নাজিবাদের ফসল ছিল নাৎসি বাহিনী ১৯৪৫ সালে যা বিলুপ্ত হয়) দিয়ে পুরো চেকোস্লোভাকিয়া দখল করে নেয়। যে কমিউনিস্ট পার্টির লক্ষ্য ছিল সর্বহারার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা দেশ দখল হবার পর তাদের নামতে হলো বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই-এ। নাৎসি বর্বরতার ভয়ঙ্কর থাবায় কমিউনিস্ট পার্টি লন্ডভন্ড হয়ে গেল। বেআইনি কমিউনিস্ট কেন্দ্রের প্রধান সংগঠক জুলিয়স ফুচিককে গোপনে কাজ চালিয়ে যেতে হলো। তাঁর সাহিত্যজ্ঞান ছিলো অসাধারণ কিন্তু তিনি শিল্পের চর্চার মাধ্যমে সাহিত্যে নতুন মাত্রা সৃষ্টি না করে জীবনের নতুন মাত্রার সন্ধান করতে গিয়ে ১৯৪২ সালে গেস্টাপোদের (জার্মান গুপ্ত পুলিশ বাহিনী- ১৯৪৫ সালে হিটলারের পতন হলে এই বাহিনী বিলুপ্ত হয়) হাতে ধৃত হন। সেসময় অর্থাৎ ১৯৪২ এর ২৪ এপ্রিল থেকে ১৯৪৩ এর সেপ্টেম্বরের ৮ তারিখ পর্যন্ত জুলিয়াস ফুচিককে নানা বন্দীশালায় ঘোরানো হয়। প্রাহার প্যানক্রাটস জেলে জুলিয়াস ফুচিক কিছু নোট লিখে যান। সেখানকার একজন চেক গার্ড- এ কোলিনস্কি গোপনে তাঁকে কাগজ কলম এনে দিতেন এবং নোটগুলো নিরাপদে অন্য জায়গায় জমা করতেন। সেসব নোটস-ই পরবর্তীতে পৃথিবীর ৯০টি ভাষায় অনুবাদকৃত বই, নোট্স্ ফ্রম দি গ্যালোজ এর জন্ম দেয়। ৩. বই-এ ফুচিক একটি মুখবন্ধ লিখেছেন। তাঁর স্ত্রী অসাস্টিনা ফুচিক লিখেছেন একটি নোট। অসাস্টিনা বলেন- '’১৯৪৫ সালে হিটলারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে জার্মানির পরাজয় ঘটে। বন্দীশালায় যাদের নির্যাতন করেও শেষ করে ফেলা যায়নি, তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। আমিও তাদের মধ্যে একজন। স্বাধীন দেশে ফিরে এসে আমি আমার স্বামীর খোঁজ করি। দেশের সর্বত্র তখন স্ত্রী তার স্বামীকে, মা তার সন্তানকে, পরিবারের বিধ্বস্ত টুকরোগুলোকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি জানতে পারি দন্ডাদেশের চোদ্দদিন পর বার্লিনে ১৯৪৩ সালে ৮ সেপ্টেম্বরে তাঁর ফাঁসি হয়'। ফুচিক যেদিন ধরা পড়েন সেদিন তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। সেই বর্বর অত্যাচারের কথা ফুচিক লিখেছেন এভাবে- 'লাঠির বাড়ি। দুবার, তিনবার...কতবার গুনব? এসব পরিসংখ্যানের কোনো মানে নেই। আমি জানতে চাই, কত মার খেয়ে মানুষ বেঁচে থাকে'। নির্যাতন করে করে ফুচিকের কাছ থেকে পার্টির গোপন কথা বের করার চেষ্টা করা হয় কিন্তু তবুও নীতিতে অটল থাকেন জুলিয়াস ফুচিক। তিনি লেখেন, 'আমি জানি আমার মুখ থেকে এরা কিছু বের করতে পারবে না... মৃত্যুও খুব শিগগির আসবে চোখের সামনে... যা দেখছি সমস্তটাই যেন একটা অদ্ভুত হতচ্ছাড়া দুঃস্বপ্ন। আবার ঘুসি। এবার ওরা চোখে মুখে জল দিয়ে আমার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করে, তারপর আবার ঘুসি, কান ফাটানো গালাগাল, বল বল বল তবুও তো বেঁচে থাকি, বাবা, মা কেন এত শক্তি দিয়েছিলে'? ৪. 'সেল ২৬৭- সাত পা হাঁটলে দেওয়াল, সাত পা পেছোলে দেওয়াল। হিসেবটা আমার খুব ভালো করে জানা। ফুচিক যে সেলে ছিলেন সেখানের বর্ণনা এভাবে করেন তিনি। লিখেন- 'দুইশো সাতষট্টি আমাদের সেল। তবে এখন আমরা দুজন। জানলার নিচে আমি মাথা নিচু করে শুয়ে আছি- এক সপ্তাহ, দুসপ্তাহ, একমাস, দেড়মাস ধরে। আবার বেঁচে উঠছি। এখন আবার মাথা নাড়াতে হাত ওঠাতে পারি। তবে যতটা তাড়াতাড়ি একথাগুলো লিখতে পারছি, ততটা তাড়াতাড়ি নয। খেতে পারতেন না। মারের চোটে মাড়ি থেকে দাঁত ছিটকে বেরিয়ে পড়েছিল। দুষিত রক্ত আর পুঁজের গন্ধ চারদিক বিষাক্ত করে রাখতো। সঙ্গী বাবা বা জোসেফ পেশেক শার্টে জোড়া তালি মেরে দিতেন, একসময় সেই শার্টে আর জোড়া দেবার জায়গা বাকী থাকে নি। তাঁর স্ত্রী-কে ২৬৭ এর কাছেই অন্য সেলে রাখা হয়েছে। কিন্তু স্ত্রী জানেন না স্বামী কেমন আছেন। স্ত্রীকে খুব ভালোবাসেন ফুচিক। স্ত্রীর জন্য গান করেন। লেখেন, 'রোজ সন্ধ্যাবেলা আমি গাস্টিনাকে গান শোনাব বলে দেওয়ালের দিকে মুখ করে গান গাই; ওর সবচেয়ে প্রিয় গান। জানি না এত দরদ দিয়ে গান করবার পরও সে গান তার কানে পৌঁছয় না কেন'। লেখেন, '’সূর্যের আলো এই অন্ধকার সেলে সহজে ঢোকে না। আর তাই গান আমাদের বাঁচার সহজ অবলম্বন হয়ে ওঠে। ২৬৭ নম্বর সেল উত্তরমুখী বলে শুধুমাত্র গ্রীষ্মকালে পুবদিকের দেওয়াল আলোকিত হয়ে ওঠে। সেসব দিন বাবা তার খাটিয়ার ওপর ওঠে মাথা বাড়িয়ে সূর্য ওঠার দিকে, আকাশের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। এরকম আশ্চর্য করুণ দৃশ্য কেউ কখনো দেখে নি'। তারপর তাঁকে ৪০০ নম্বর সেলে স্থানান্তর করা হয়। সেখানেই মে দিবসে তিনি লিখেন, 'একবার মে দিনে আমি মস্কোর রেড স্কোয়ারে ছিলাম। সেদিন জনতার ঢল দেখেছি রাজপথে। এখানে সেরকম কিছু নেই, এখানে মুষ্টিমেয় কিছু রাজবন্দী। কিন্তু একে তাচ্ছিল্য করা যায় না। কারণ এই এক নবজন্মের গল্প। আগুনে পুড়ে এখানে মানুষ তার ঝলসানো স্বরূপ খুঁজে পায়; ইস্পাত হয়ে ওঠে'! তাঁরা গান গেয়ে ওঠেন- 'বন্দী কমরেডরা- তোমরা ওই নির্জীব দেওয়ালের পেছনে থাকলেও, তোমরা আমাদেরই সঙ্গে আছো, আমাদের সঙ্গে মার্চ করে যেতে না পরলেও, তোমরা আমাদেরই সঙ্গে আছো'। লেখেন, 'আসলে সত্যিকারের দুজন কমিউনিস্ট একত্র হলে মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটা সংগঠন তৈরি হয়। সেজন্যই ১৯৪২ থেকে ৪০০ নম্বরকে আমরা আড়ালে কমিউনিস্ট-সেন্ট্রাল হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি। ... ৪০০ নম্বর যুদ্ধক্ষেত্রের এক খুবই উন্নতমানের ট্রেঞ্চের মতো। চতুর্দিকে শত্র“-পরিবেষ্টিত, দাবানল-পরিবেষ্টিত অবস্থায়ও কখনো তা পরাজয়কে, আত্মসমর্পনকে মেনে নেয় নি'। ৫. জুলিয়াস ফুচিক গেস্টাপোদের কাছে বন্দী, জেলে থাকা অবস্থায় কিছু মানুষের দেখা পান। তাদের কথা বলেন তিনি। তাদের সাথে তাঁর সুখ-অসুখের স্মৃতিচারণা করেন। কমিউনিস্ট পার্টির কথা বলেন। তাঁর উইলের কথাও বলেন। নাৎসিরা তাঁর বিরুদ্ধে ছয়টি গুরুতর অপরাধের অভিযোগ আনে। নাৎসিদের বিরুদ্ধে দ্রোহ, সশস্ত্র লড়াইয়ের উদ্যোগ আরো অনেক কিছু। তিনি লিখেন, এখানে যুদ্ধ আর প্রত্যাশার মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। ফ্যাসিজমের মৃত্যু অথবা আমার মৃত্যু- কোনটা আগে ঘটবে? জুলিয়াস ফুচিকের দৈহিক মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু তাঁর আদর্শবাদ? তার মৃত্যু হয় নি। জুলিয়াস ফুচিক সাংবাদিক-সাহিত্যিক ছিলেন বলে তাঁর লেখার ভাষা শৈল্পিক। অনুবাদক আনন্দময়ী মজুমদার সেসবের এত চমৎকার ভাষান্তর করেছেন পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছিল কবিতা পড়ছি। অনুবাদককে অজস্র ধন্যবাদ, মহান নেতার মহান শিল্পকর্মটি বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য অনুবাদ করে আমাদের দ্বারে পৌঁছে দেবার জন্য।