User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
ধর্ম ও বর্ণের ঊর্ধ্বে একদা বাংলাজুড়ে একটা প্রেমের জোয়ার বয়ে গিয়েছিল। সে প্রেম মানবতার, সে প্রেম দেশপ্রেম। হিংসা-দ্বেষ ভুলে গিয়ে এক অলৌকিক অপার শান্তিময় ভুবন গড়ে তুলেছিলেন তাঁরা। চৈতন্যদেব, লালন, হাসন রাজা, নাম না-জানা অনেক বাউলসাধকের সর্বশেষ সাধক শাহ আবদুল করিম। দেহতত্ত্ব, মরমিয়া, সহজিয়া গান দিয়ে তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন এক বিশাল অসাম্প্রদায়িক পৃথিবী। তাঁদের প্রতিবাদ ছিল ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে। বিষয়-বুদ্ধিহীন এসব মানুষ গৃহে আবদ্ধ থাকতেন না। তাঁদের ঠিকানা হয়েছিল গ্রামবাংলার পর্ণকুটিরে, পথে-প্রান্তরে। প্রাণিজগতের বাঁচার নিয়মে যতটুকু খাদ্য বা বস্ত্র প্রয়োজন, তা হলেই তাঁদের চলত। বাংলার ভাটি অঞ্চল, যেখানে বিস্তীর্ণ হাওর বর্ষায় একটা সাগরের রূপ পরিগ্রহ করে। আকাশে যখন অবিরল বৃষ্টির ধারা, প্রকাণ্ড ঢেউগুলো তখন আছড়ে পড়ে। কূলহীন-কিনারাহীন অন্তরীক্ষে তারই পাড়ে জন্ম শাহ আবদুল করিমের। প্রবল দারিদ্র্যের মধ্যে তাঁর শৈশব, লেখাপড়াও সামান্য। তারই মধ্যে তিনি আহ্বান শোনেন এক মহাজাগতিক সত্যের। সেই সত্য তাঁর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও মূর্ত হয়। বাহন তাঁর সংগীত। যন্ত্রও সামান্য। সম্বল তাঁর কণ্ঠ এবং এক বাউলসাধকের হূদয়, যে হূদয় ক্রমাগতভাবে মেধায় পরিণত হয়েছে। তাঁর জন্মস্থান শ্রীহট্ট, সিলেট। একদিকে খাসিয়া জয়ন্তিয়া পর্বতমালা, অন্যদিকে নদী-হাওর পরিবেষ্টিত ভাটি অঞ্চল। এই বিশাল পর্বত আর হাওরের ওপর উদার নীল আকাশই কি কবি বাউলসাধক জীবনের মানস-ভূগোল সৃষ্টি করেছিল কি না, তা কোনো গবেষণার বিষয় নয়। তাঁর জীবনের ওপর যে প্রবল প্রভাব পড়েছিল তা প্রশ্নাতীত। এই নাটকের নাট্যকার শাকুর মজিদ শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে একটা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন। প্রামাণ্যচিত্রটিতে তিনি নানা সচিত্র তথ্য তুলে ধরেছিলেন। নানা গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারও সেখানে ছিল। যেহেতু তিনি নাট্যকার, তাই তাঁর উপস্থাপনা ছিল বেশ নাটকীয়। সেই উপস্থাপনার ফলেই হয়তো প্রামাণ্যচিত্রটি বেশ মর্মস্পর্শী হয়েছিল। একদিন অকস্মাৎ খবর পেলাম, শাকুর মজিদ একটি নাটক লিখেছেন। নাটকের নাম মহাজনের নাও। নাম শুনে একটু খটকাও লেগেছিল, কিন্তু কালক্রমে স্পষ্ট হলো, এই জগতে আমরা আসি—একটি নৌকা বা নাও পেয়ে যাই আমাদের জাগতিক ভ্রমণের জন্য। তারপর নৌকার মালিকের হাতেই আবার সমর্পণ করে চলে যাই। এই মহাজন হতে পারেন ঈশ্বর বা মহাকাল অথবা এই ধরিত্রী, যেখানে আমাদের আগমন ঘটে এবং যেখানে সবচেয়ে বড় বাস্তব আমাদের বিদায়। এখানে ভাবনাটা শেক্সপিয়রের সঙ্গে মিলে যায়। To-morrow, and to-morrow, and to-morrow, Creeps in this petty pace from day to day, To the last syllable of recorded time; And all our yesterdays have lighted fools The way to dusty death. Out, out, brief candle! Life's but a walking shadow, a poor player, That struts and frets his hour upon the stage, And then is heard no more. It is a tale Told by an idiot, full of sound and fury, Signifying nothing একাধিকবার করিমের গানে এ বিষয়গুলো এসেছে, এসেছে লালন, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-রজনীকান্ত-অতুল প্রসাদের গানেও। যেমন— ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইলো কেমন দেখা যায় ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায়। চন্দ্রসূর্য বান্ধা রাখছে নায়েরই আগায় দুরবিনে দেখিয়া পথ মাঝিমাল্লায় বায় রং-বেরঙের কত নৌকা ভবের তলায় আয় রং-বেরঙের সারি গাইয়া ভাটি বাইয়া যায়।’ বাংলার এই বাউলসাধকদের জীবনযাত্রা সরল হওয়া সত্ত্বেও পদে পদে কণ্টকাকীর্ণ। ধর্মীয় অনুশাসন তাঁরা মানতেন নিজেদের মতোই। চাপিয়ে দেওয়া ধর্ম-কর্ম তাঁদের সইত না। একইভাবে রাষ্ট্রীয় অনুশাসন, সাম্প্রদায়িকতার উল্লাস—এগুলোও তাঁদের সহ্যের অতীত। মহাজনের নাও নাটকে শাকুর মজিদ শাহ আবদুল করিমের শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত, এমনকি তাঁর জানাজার কাল পর্যন্ত ধরেছেন। এখানে তাঁর বড় কৃতিত্ব এই যে তিনি বাংলা নাটকের গীতল ধারাকে অনুসরণ করেছেন। নাট্যের স্থান দখল করেছে করিমের গান এবং অভিনয়ের জায়গাগুলোতে রয়েছে পয়ার ছন্দের কাব্য। কাব্যের নির্মাণে কোনো গুরুগাম্ভীর্য নেই, একেবারেই সরল-সহজিয়া রূপের। বিরতিহীন দেড় ঘণ্টার মধ্যেই তিনি করিমকে উপস্থিত করেছেন। কোনো একটি মুহূর্তই সেখানে বিরক্তির উদ্রেক করে না। নির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তী তরুণ নির্দেশক। এই নাটকে তাঁকে কাজ করতে হয়েছে একেবারেই নবাগত তরুণদের নিয়ে। তরুণদের নিয়ে কাজ করাটা নির্দেশকদের জন্য কঠিন ও নিরাপদও বটে। এ ধরনের নিরীক্ষাধর্মী কাজের জন্য নির্দেশকের পরিকল্পনার গহনে কিছু বিষয় থাকে, যা মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তন করতে হয়। সেখানে একটু পুরোনো অভিনেতারা প্রশ্ন তোলেন, মেনে নিতে চান না। পুরোনোর আবার একটা শক্তিও আছে। সে নতুনকে মানে না। নতুনকে গ্রহণ করতে দেয় না। আবার সমস্যাও আছে। নাটকে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন আছে, এটা কেউ অস্বীকার করবে না। গীতল এ নাটকটিতে অসংখ্য মুভমেন্ট আছে, তার সঙ্গে আছে গান। মুভমেন্টের সঙ্গে গান এবং মাত্রা মিলিয়ে মুভমেন্টের কাজটি কঠিনও বটে। অনেক বেশি ফিজিক্যাল ফিটনেস এবং সেই সঙ্গে দম ব্যবহারের দক্ষতা প্রয়োজন। দু-চারটা জায়গায় এর সমস্যাও হয়েছে। কিন্তু আবার অনেক জায়গায়ই প্রত্যাশার অতিরিক্ত পাওয়াও গেছে। বিশেষ করে মেয়ে দুটি (রূপা নাসরিন ও লিঠু রানী মণ্ডল) যখন করিমের ও প্রতিদ্বন্দ্বীর ভূমিকায় অভিনয় করছিল, তা আমাদের প্রত্যাশা অতিক্রম করে যায়। অভিনয়ের অভিজ্ঞতা থাকলে যা হয়, তাও আমরা দেখেছি। করিমরূপী আহমেদ গিয়াস যখন শেষ দৃশ্যের আগে সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছেন, তখন এক হূদয়স্পর্শী মুহূর্তের সৃষ্টি হয়। একেবারেই বাস্তবানুগ অভিনয়ে দর্শকদের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। আবার আনসার যখন ডিসি হয়ে এসে করিমকে ভর্ৎসনা করে, তখন ও একটা অথরিটি দিয়ে রাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্ব করে। মৌলভির চরিত্রেও আসাদুল ইসলাম বেশ উজ্জ্বল। হাওরাঞ্চলের সুরে একটা মেলোডি আছে, তালেরও কাজ আছে। তালের প্রতি যত্নবান হয়ে তা যদি উচ্চকিত হয়, তাহলে এ নাটকের করিমকে ধরা যাবে না। করিমের গায়কিটা সম্পূর্ণই আত্মমগ্ন থেকে হূদয়ের একটা গভীর তন্ত্রী থেকে ধরা। সেই জায়গাটি আরও আবিষ্কার করার প্রয়োজন আছে। নাট্যকার ও নির্দেশকের সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারের যে পরিমিতিবোধ, তা উল্লেখ করার মতো। ভাটি অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করে, কিন্তু দুর্বোধ্য নয়। নাটকে নাট্যভাষার সাবলীল প্রয়োগ প্রশংসাযোগ্য। নির্দেশনার ক্ষেত্র ছাড়াও সুদীপ আলো, মঞ্চ, পোশাক ও প্রপসের কাজটিও করেছেন। সবই মোটামুটি, তবে প্রপসের নির্মাণ বিশেষ করে বৈঠা ও ট্রাংকের ব্যবহার বেশ ভালো। একটা কথা তরুণ নির্দেশকদের ভাবতে বলি। কোরিওগ্রাফিতে কাপড় ব্যবহার বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে এসেছে। বৈঠা যেমন নাটকটির ভেতর প্রবেশ করে যায়, কাপড়গুলো তেমন যায় কি? তবে করিমের প্রণয় দৃশ্যটিতে বিস্তীর্ণ কাপড়ের মধ্যে ছোট্ট জায়গাটিতে দুটি মুখ খুবই ভালো লেগেছে। প্রথম প্রদর্শনীটি দেখেছিলাম। একেবারেই নতুন মঞ্চে ওঠা তরুণ অভিনেতারা ছিলেন। কালে কালে আরও সমৃদ্ধ হবেন তাঁরা, প্রযোজনাও দিন দিন আরও শিল্পসমৃদ্ধ হবে। আবারও বলতে হয়, বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় তারুণ্যের স্পর্শটাই সবচেয়ে বেশি গৌরবের ও গুরুত্বপূর্ণ। নাট্যকর্মীরা তরুণ, দর্শকের বেশির ভাগ তরুণ। তাই বহুদূর যাওয়ার ইঙ্গিত দেয় এই নাট্যচর্চা। নাট্যকারের একটি বিষয় শেষে আবার বলা প্রয়োজন। নাটকের শেষ দৃশ্যে করিমের মৃত্যুসংবাদ শুনে বহু মানুষ নৌকায় পদব্রজে এসে দাঁড়ায়। হাওর তখন উথাল-পাথাল। নাট্যকারের ভাষায়: লাশের মিছিল নিয়া দুপুরের পর/ ধল মসজিদ ঘাটে ভিড়ায় বহর/ শত শত নাও লোক হাজারে হাজার/ ইমাম সাহেব দেখে করে চিৎকার/ ইমাম: ভাইসাব, বলি আপনাদের/ অপেক্ষা করতে হবে কিছু সময়ের বর্ষায় মাঠঘাট ভরে একাকার/ সবাইকে ধরবে না নামাজে কাতার/ একবার উঠানেতে পড়া নয় সোজা/ দুইবার হবে তার নামাজে জানাজা। একদা বাল্যকালে এই মসজিদ থেকেই তাড়িয়ে দেওয়া বালক আজ জীবনের শেষে নতুন ইমামের ভাষ্য আমরা শুনলাম। মনোমুগ্ধকর এই যে হাওরে বর্ষাকালে করিমের মৃত্যু, প্লাবিত হাওরের মানুষ সেদিন কোনো এক মুহূর্তের জন্য একচিলতে রংধনু দেখেছিল কি না জানি না, তবে নাটকের শেষ দৃশ্যে হাওরজুড়ে আমরা প্রলম্বিত একটি রংধনু দেখেছিলাম আর সেই রং শাহ আবদুল করিমের বর্ণাঢ্য জীবনেরই সাত রং নিয়ে বহু রং। নতুন শাহ আবদুল করিমের জননীদ্বয় শাকুর মজিদ ও সুদীপ চক্রবর্তীকে অভিনন্দন।
Was this review helpful to you?
or
বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম আমাদের শিল্পসংস্কৃতি ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। করিমের গানে মুগ্ধ হয়নি, ভাবসাগরে ডুব মারেনি এমন মানুষ নেই বললেই চলে। করিম যেমন প্রতিভার ঝিলিক দেখিয়েছেন তেমনি সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণির মিডিয়াও কার্পণ্য করেনি তাঁর প্রতিভার যোগ্য স্বীকৃতি দিতে। এ সাধককবিকে নিয়ে প্রচুর কাজ হয়েছে, নানাজন নানাভাবে তাঁর কাজের মূল্যায়ন করেছেন। করিমের সৃষ্টিকে মানুষের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসার কাজটি করেছে গণমাধ্যম। এ বাউলকবির মূল্যায়নে প্রতিভাবান লেখক-নাট্যকার শাকুর মজিদও পিছিয়ে থাকেননি। করিমকে নিয়ে তার উল্লেখযোগ্য কাজ দুইটি- ভাটির পুরুষ ও মহাজনের নাও। করিমের ওপর দীর্ঘ ৭ বছর গবেষণা করে শাকুর মজিদ বানিয়েছেন প্রামাণ্যচিত্র- ভাটির পুরুষ। প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মিত হয়েছিলো করিমের জীবদ্দশায়। তাঁর দেহাবসানের পর লিখেছেন গীতিনাট্য মহাজনের নাও। জীবিত করিম এবং লোকান্তরিত করিম- দুইভাবে শাকুর মজিদ ‘বন্দি’ করেছেন তাঁকে। মহাজনের নাও প্রকৃতপে একটি মঞ্চনাটক। নাটকটি সুবচন নাট্যসংসদ’র ৩৩তম প্রযোজনা। নির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তী। গীতল নাট্য মঞ্চায়ন খুব বেশি হয়নি বাংলাদেশে। তার কারণ কাজটা যেমন দুরূহ তেমনি ঝক্কিরও। এই দুরূহতম কাজটিই সহজে সম্পন্ন করেছেন নাট্যকার। শাহ আবদুল করিমের বালকবেলা থেকে শুরু করে মৃত্যু পরবর্তী জানাজা পর্যন্ত আলোকপাত করা হয়েছে নাটকটিতে। বলার অপো রাখে না, এটা করিমের জীবনীভিত্তিক নাটক। নাটকে উঠে এসেছে করিম-জীবনের অনেকটাই। বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য অংশ। নাটকটি বই আকারে রূপ দিয়ে প্রশংসনীয় কাজ করেছে শেকড়সন্ধানী প্রকাশনা সংস্থা উৎস প্রকাশন। সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলে জন্মগ্রহণকারী করিম হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। মাত্র ৮ বছর বয়সে তিনি জীবনের তাগিদে রাখালের চাকরি নেন। ভোরে গরু-মোষ নিয়ে চলে যেতেন মাঠে। দিনভর গরু চরিয়ে সন্ধ্যায় মনিবের বাড়ি ফিরতেন। রাতের খাবার সেরে গিয়ে বসতেন নসিব উল্লাহ’র ঘরে। লেখকের বর্ণনায় করিমের আত্মকথন- বাবার চাচা নসিব উল্লাহ আল্লাহর ফকির রাইতের পর রাইত কাটাই দিতা করিয়া জিকির। এক ঘরেতে ফকির সাধু হিন্দু-মুসলমান লাউ বাজাইয়া গাইতা তারা ভক্তিমূলক গান। করিমকে পেয়ে বসে গানের নেশা। দাদা নসিব উল্লাহ’র ঘরে প্রতি রাতে তাঁর আসা চাই-ই চাই। দাদাও তাঁকে স্নেহ করতেন, আদর করে বসাতেন পাশে। কিশোর করিমের মনে নানা প্রশ্ন, বিস্তর জিজ্ঞাসা। দাদার কাছ থেকে দেহতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে তালিম নেন। করিমের গ্রামের ইমাম কমরউদ্দিনের কাছ থেকে করিম শেখেন শরিয়ত, মারফতের বিষয়াদি। যে সব জিজ্ঞাসা ভর করে তাঁর মনে, সে সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকেন। প্রশ্ন এবং উত্তর আত্মস্থ করেন...। এভাবেই বেড়ে ওঠা উজানধল গ্রামের উজ্জ্বল কিশোর শাহ আবদুল করিমের। এক সময় নিজেই প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়েন গানের দিকে। গানই হয়ে ওঠে তাঁর ধ্যানজ্ঞাননেশা। সদা গানে মশগুল তিনি। দিনে গান, রাতে গান; পৃথিবী গানময়। কিন্তু এই গান তাঁকে মানসিক শান্তি দিলেও সামাজিকভাবে স্বস্তি দেয় না। ঈদের দিন নামাজ পড়তে গেলেন করিম। নামাজের জামাতে মোল্লা-মুরব্বিরা আপত্তি তুললেন করিমের ব্যাপারে। করিম ধর্মবিরোধী কাজ করে বেড়ায়। গানবাজনায় ব্যস্ত থাকে। তার কাজ বেশরা, বেদাতি। এ ধরনের শরিয়তবিরোধী কাজ আর করবে না বলে তওবা করলেই করিম জামাতে নামাজ পড়তে পারবে। সমবেত লোকের অনেকেই এবং ইমাম সাহেব স্বয়ং হেদায়েত দিতে থাকেন। কিন্তু করিমের এক কথা- আমি এখানে এসেছি নামাজ পড়িতে ইচ্ছা নয় মিছা কোনো কথা বলিতে ছাড়তে পারবো না আমি নিজে যখন জানি উপদেশ দিলে বলেন কেমনে তা মানি পরে করবো যাহা এখন বললাম, করবো না সভাতে এই মিথ্যা কথা আমি বলতে পারবো না। ফতোয়াবাজ মোল্লা এবং ‘ধার্মিক’ মুরব্বিদের হুমকিতে ভীত হয়ে করিম তাঁর বেড়ে ওঠার, ভালোবাসার উজানধল গ্রাম ছেড়ে রওনা দেন ভিন গাঁয়ের পথে। সঙ্গী একতারা, কণ্ঠে গান। গানচর্চা চলতে থাকে তাঁর। লেখা ও গাওয়া, গাওয়া ও লেখা। মাটির গন্ধমাখা সে গান ক্রমশ উঠে আসতে থাকে মানুষের মুখে মুখে। নাম-যশ উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। কিন্তু দুঃসহ দারিদ্র্যতা কালো ছায়ার মতো লেপ্টে থাকে। এই পুরস্কার সেই পুরস্কার, স্বীকৃতি, সম্মাননায় ভরে যেতে থাকে ঘর। নিরন্ন সাধকের কাছে এসবের মূল্য আছে ঠিকই, কিন্তু কতটুকু? তবু করিম কণ্ঠে তুলে নেন গান। সচল থাকে গীত রচনা। তাঁর গানে একে একে উঠে আসে দেশের দুর্দশাচিত্র, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, বকধার্মিকদের আস্ফালন, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি। এ গানযুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, একাত্মতা বোধ করে দেশের মানুষ। অনুরাগীরা তো আছেই। করিমের এই পথচলায় ধর্মের ধ্বজাধারী কাঠমোল্লারা পিছু লেপ্টে থাকে। পাশাপাশি সমাজের অজ্ঞ, সংকীর্ণমনা মানুষরা তো আছেই। করিমের দুই শিষ্য সুনন্দ গোসাই ও আকবর আলী। সুনন্দ হিন্দু, আকবর মুসলিম ধর্মাবলম্বী। সুনন্দ করিমের শিষ্যত্ব গ্রহণ করার পর থেকে করিমের বাড়িতেই থাকে, খায়, ঘুমায়। এক পর্যায়ে মারা যায় সুনন্দ। সুনন্দের আত্মীয়রা ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করতে নারাজ। তাদের মতে, যে ছেলে মুসলমানের ঘরে থেকে, খেয়ে জাত খুইয়েছে তার আবার কীসের শেষকৃত্য? শেষ পর্যন্ত করিম অনন্যোপায় হয়ে সুনন্দকে তুলসীতলায় কবর দেন। সুনন্দ’র মৃত্যুর কিছুদিন পরেই মারা যায় আকবর। আকবরের জানাজা পড়াতে যথারীতি ইমাম সাহেব নারাজ। গ্রামবাসীকে সাী করে ইমাম সাহেবের মন্তব্য- ধলবাসী আপনারা সকলে শোনেন এ বাড়িতে খালি হয় গানবাজনা আল্লাহর নাম কেউ মুখে আনে না নামাজ রোজায় আমি দেখি নাই তারে এখন জানাজা পড়াই কী করে? এই অবস্থা অবশ্য শেষ পর্যন্ত থাকেনি। করিম ভুবনমোহিনী গান দিয়ে জয় করেছেন প্রতিকূল পরিবেশ। এক সময় যারা তার সাথে রূঢ আচরণ করেছে, তারাও পরবর্তীকালে নমনীয় হতে বাধ্য হয়েছে। তাই তো দেখা যায়, করিমের মৃত্যুর পর নামাজে জানাজা পড়ানোর প্রাক্কালে ইমাম সাহেব বলেন- ভাইসব, বলি আপনাদের অপো করতে হবে কিছু সময়ের বর্ষায় মাঠঘাট ভরে একাকার সবাইকে ধরবে না নামাজে কাতার একবারে উঠানেতে পড়া নয় সোজা দুইবারে হবে তার নামাজে জানাজা। এভাবে করিম নিজেকে উচ্চতর এক সম্মানের পদে আসীন করেছেন। যে গ্রামের মসজিদ থেকে একদা তিনি ‘বেদাতি’ কাজের জনক হিসেবে বিতাড়িত হয়েছিলেন সে গ্রামেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাঁর সম্মান। যদিও তা জীবনের শেষ দিকে। আজীবন দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করা করিম ময়ূরপক্সী নাওয়ে পাড়ি দিয়েছেন দূর অজানায়; তাঁর আরাধ্য দয়াল মুর্শিদের উদ্দেশে। ‘ভাটির পুরুষ’কে নিয়ে লেখা এ নাটক রচনায় শাকুর মজিদ অসামান্য মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। পয়ার ছন্দে রচিত এই গীতল নাট্য বাংলা সাহিত্যে অভিনব এক সংযোজন। শুধু নতুনত্ব তথা ভিন্ন আঙ্গিকের জন্যই নয়, সহজ ছন্দে ঈর্ষণীয় ভঙ্গিতে অনেক কঠিন কথা, জটিল বিষয়কে সহজ ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন তিনি। তবে বইটিতে কিছু অসঙ্গতি রয়ে গেছে। ক্রেডিট লাইনে প্রচ্ছদশিল্পীর নাম ছাপা হয়েছে মাসুম রহমান কিন্তু শেষ প্রচ্ছদে শিল্পী হিসেবে দেখা যায় শাকুর মজিদকে। বইয়ের প্রথম ফ্যাপে রয়েছে করিম সম্পর্কে পরিচিতমূলক কিছু কথা; এই একই লেখা সারসংপে শিরোনামে ছাপা হয়েছে ১১ পৃষ্ঠায়। বইটির বাজে আরেকটি দিক, বানান ভুল- যা উৎস প্রকাশনের মতো প্রতিনিধিত্বশীল প্রকাশনার ক্ষেত্রে বেমানান। এসব অসঙ্গতি, ভুলভ্রান্তি বইটির মান ক্ষুণ্ন করেছে। তবে নাট্যজন মামুনুর রশীদের করিমনামার আধুনিক গীতল বর্ণাঢ্য প্রযোজনা শীর্ষক ভূমিকাটি প্রশংসার দাবিদার। লেখাটিতে এ বিদগ্ধ নাট্যব্যক্তিত্ব যুগপৎভাবে বাউল করিম ও লেখক-নির্মাতা শাকুরের প্রতিভার নির্মোহ মূল্যায়ন করেছেন। মহাজনের নাও : শাকুর মজিদ প্রকাশক : উৎস প্রকাশন প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১১ প্রচ্ছদ : মাসুম রহমান পৃষ্ঠা ৪৮, দাম ১০০।