User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
ভ্রমণ করে, পৃথিবীতে এমন লোকের অভাব নেই। কিন' প্রকৃত ভ্রমণ কাহিনির অনেক অভাব। প্রকৃত ভ্রমণকাহিনীতে লেখকের বস'-অভিজ্ঞতার সূত্রে পাঠকের কাছে উন্মাচিত হতে পারে বিশ্ব জগতের নতুন নতুন বিষয় অভিজ্ঞতার দ্বার। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ভ্রমণকারী মন/ ভ্রমণ করার তীর্থ তাহার আপন ঘরের কোন।’ আমার তো মনে হয় ঘরের কোণের এই ভ্রমণসাধনাকে পরিপূর্ণ করে তুলতে পারে ভ্রমণকাহিনি। রবীন্দ্রচেতনায় ওই ভ্রমণের অর্থ হয়তো ভিন্ন, কিন' আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ভ্রমণপিপাসা পরিতৃপ্ত করার অবলম্বন হতে পারে কৌতুহলী, সচেতন ও সংবেদনশীল লেখকের ভ্রমণকথা। ভ্রমণকাহিনি এমন এক ধরণের গদ্য-আখ্যান, যা থেকে উপন্যাস পাঠের আনন্দও পেয়ে যেতে পারেন পাঠক। কিন' উপন্যাসে জীবনের বস'সত্য এবং অভিজ্ঞতার অবিকল রূপ অভিব্যক্ত হয় না। ভ্রমণ-কথার মূল নীতি হওয়া উচিত ঘটনা ও বর্ণনার বস'নিষ্ঠা ও সততা। ভ্রমণ কারো কাছে পেশা হতে পারে, আবার কারো কাছে পেশা ও নেশা উভয়ই হতে পারে। কিন' ভ্রমণ-কথা রচনা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না, আবার অনেক ভ্রমণ কাহিনি অভিজ্ঞতার যথাযথ বৈশিষ্ট্য, কৌতুহলের ধাঁচের ওপর নির্ভর করে তার ভ্রমণবৃত্তানে-র চরিত্র। যাত্রী রবীন্দ্রনাথ বিচিত্র দেশ ও সংস্কৃতির যে বর্ণনা আমাদের কাছে তুলে ধরেন, সেখানে কবির দর্শন, কথাশিল্পীর ব্যঞ্জনা এবং উপলব্ধির গভীর সত্য প্রকাশিত হয়েছে। সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখায় দেখি অভিজ্ঞতার জগৎকে কৌতুক ও মমতার আশ্রয়ে তুলে ধরা। সময়ের বিবর্তনে, পাঠকরম্নচির অভাবনীয় পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে কোনো দেশ ও জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রগতির ভ্রমণকথার জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। শাকুর মজিদের দুটি ভ্রমণকথা সুলতানের শহর ও লেস ওয়ালেসার দেশে পাঠ করতে গিয়েই উপরের কথাগুলি মনে পড়ে গেলো। ‘পেশায় স'পতি নেশায় অনেক কিছু’- তাঁর জীবনপাঠ সূত্রে একথা জানা যায়। নাটক লেখেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, সংগীত ও সংস্কৃতির ওপর পরীক্ষামূলক কাজ করেন। কিন' তার আগ্রহের বড় জায়গা হলো ভ্রমণ। এই বিশ্বজগৎটাকেই তিনি মনে করেন বিশাল একটি গ্রন'। কিন' সেই গ্রনে'র রূপ বিচিত্র, প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন। শাকুর মজিদ পৃথিবীর ত্রিশটিরও অধিক দেশ ভ্রমণ করেছেন এবং সেই ভ্রমণ-অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা ও ছবির মাধ্যমে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। ভ্রমণের নেশার সঙ্গে ছবি তোলার নেশা তাঁর ভ্রমণকথার বাস-ব পটকে অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত ও সত্যনিষ্ঠ করেছে। আর সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স'পতির কারম্নদৃষ্টি। আলোচিত বইয়ের পটভূমি ও সংস্কৃতি ভিন্ন হলেও এই কারম্নদৃষ্টি লেখকের পর্যবেক্ষণ ও রূপ নির্মাণের নিজত্ব ও মৌলিকতাকে চিহ্নিত করে। চোখ দিয়ে দেখা আর মন দিয়ে পড়া- জীবন ও জগৎ-উপলব্ধির ক্ষেত্রে এ-সত্য সবচেয়ে গুরম্নত্বপূর্ণ। ‘পড়া’ শব্দটি ব্যাপক অর্থে পাঠ হিসেবে গ্রহণ করতে চাই। একজন কবি যে ভাবে প্রকৃতি, মানুষ ও মানুষের সৃষ্টি দেখেন, একজন বিজ্ঞানী কিংবা স'পতি সেভাবে দেখেন না। পঠন-অভিজ্ঞতা ও পঠন-প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়েই বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভাষ্য তৈরি করেন তাঁরা। প্রয়োজনীয় ইতিহাস-ভৌগোলিক জ্ঞান না থাকলে কোনো দেশ ও তার সংস্কৃতির অনেক কিছুই যে অস্পষ্ট থেকে যায়- মধ্যযুগ থেকে শুরম্ন করে বিংশ শতাব্দীর অনেক ভ্রমণ-কথায়ও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। শাকুর মজিদ তাঁর ভ্রমণ-ভাষ্যে ভ্রমণ-বিশ্বের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পূর্ণতাকেই সন্ধান করেন। সেই সঙ্গে বিজ্ঞান ও রাজনীতির বিবর্তনধারায় তার অবস'ান শনাক্ত করেন। ভূমিকায় লেখক বলেন, “এশিয়া ও ইউরোপ মিলে গড়ে ওঠা যে শহরকে ওসমানি শাসকেরা প্রায় ছয়শ বছর ধরে লালন করেছিল, সেখান থেকে গোটা পৃথিবীর প্রায় এক-চতুর্থাংশ দেশ এবং প্রায় সমগ্র মুসলিম বিশ্ব শাসিত হয়েছিল, সেই ইসতাম্বুল নিয়েই এই গ্রন' সুলতানের শহর। এভাবেই সমগ্র ইতিহাসের ধারনার সূত্র ধরে লেখক তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা ও ভ্রমণ কথার জগতে প্রবেশ করেন। ইতিহাসের দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় ইসতাম্বুল শহরের বিবর্তনের ধারাক্রম এবং বর্তমান পরিসি'তিতে তার যে রূপ ও সংস্কৃতিগত বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য তা অনুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেন। সুলতান আহমেদ চত্বর থেকে তার ভ্রমণ কথার যাত্রা শুরম্ন হয় তারপর অটোম্যান সাম্রাজ্য, বাইজেন্টাইনের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, টপক্যাপির হারেম, সুলতানের বাজার, প্রভৃতি অভিজ্ঞতার জগতে প্রবেশ করেন। বর্তমান ইউরোপের সমাজ-বাসতবতার ইসতাম্বুলের নারীরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কোন সতরে পৌছে গেছেন তারও বর্ণনা পাওয়া যাবে শাকুর মজিদের ভ্রমণ কথায়। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি এবং মুসলিম সংস্কৃতির মিশেলে তুরস্কের মেয়েরা যে মিশ্র সংস্কৃতিকে ধারন করে তার প্রকাশ আমরা লক্ষ করি এক তুর্কি নারীর উচ্চারনে-‘আমরা মুসলিম,আমরা ইউরোপিয়ান’। হাজার বছরের ভাঙা গড়ার ইতিহাসের পাঠ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে কামাল আতার্তুকের্র বিপস্নবাত্নক রাজনৈতিক সংস্কার মুসলিম বিশ্বে তুরস্ককে এক নতুন চেতনার রাষ্ট্রে উন্নীত করে । শাকুর মজিদ বর্তমানকে নতুনভাবে পর্যবেক্ষনের প্রয়োজনেই এই ভ্রমণ বর্ণনাকে এক ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যান। আমরা জানি, শাকুর মজিদ এক স'পতি তার অভিজ্ঞতার পাঠ যে শুধু স'াপত্য কলার অনুপুঙ্খ অনুসন্ধানে পর্যবসিত হতে পারে সুলতানের শহর মুলত তারই প্রামাণ্য দলিল। অভিজ্ঞতা পৃথিবীর বহু মানুষেরই থাকে।কিন' অভিজ্ঞতাই শিল্প নয়।অভিজ্ঞতাকে শিল্প হয়ে উঠতে অভিজ্ঞতা ও চেতনার রসায়ন প্রয়োজন। পৃথিবীর লক্ষ-কোটি মানুষ প্রতিদিন অজানা জগত ভ্রমণ করে।কিন' তার কোনো শিল্প সাক্ষ্য আমরা দেখি না।যিনি বাইরের চোখ ও মানসদৃষ্টিকে অভিন্ন বোধের কেন্দ্রে স'াপন করে পারেন,তিনিই রচনা করতে পারেন ভ্রমণ শিল্প। শাকুর মজিদ তাঁর ভ্রমণ কথায় বাইরের চোখ ও মানসদৃষ্টির সঙ্গে মিলিয়ে নেন নিজের পাঠ-অভিজ্ঞতার বিসতৃত পরিসর। যে কারনে তাঁর ভ্রমণ কথা যেন কোন ‘কাহিনী’ থাকেনা শিল্প হয়ে উঠে। ইসতাম্বুল শহরের প্রকৃতি ও সৌন্দযের্র মধ্যে ঐতহ্যপরম্পরা ও আধুনিকতার মিশেলে গড়ে উঠা এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই আমরা। আমার কাছে যে বিষয়টি সবচেয়ে আকর্ষনীয় মনে হয়েছে,তা হলো প্রত্যেকটি স'াপনার ইতিহাস-সূত্রও শাকুর মজিদ একজন গবেষকের দৃষ্টিকোন থেকে তুলে ধরেন তার গ্রনে'। লেখকের স'াপত্য দর্শনের প্রকৃতি তাঁর এ বিষয়ক ধারনার সীমাকেই প্রকাশ করছে। তাঁর বর্ণনাভঙ্গির একটি দৃষ্টানত দেওয়া যাক - হাজীয়া সোফিয়ার ভেতরটি এখনও জাঁকজমকের সমাজ। প্রায় এক হাজার বছর ধরে (১৫৫২ সাল পর্যনত) এই স'াপনাটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গম্বুজ বিশিষ্ট বেসিলিকার মর্যাদা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই স'াপনাটি এমনিতেই এক স'াপত্যিক বিষ্ময়। ভেতরের গম্বুজটি ৫৫ মিটার উঁচু,৭০ মিটার প্রশসত। নিচের দিক থেকে তাকালে মনে হবে ছাতার মত কতগুলো রিব তার অবয়বকে ধরে রেখেছে। দেয়ালের গায়ে কারম্নকাজ। ক্রুশবিদ্ধ যিশু, মেরি, আরো কত বেবিলনীয় চরিত্র।( সুলতানের শহর) শাকুর মজিদের লেস ওয়ালেসার দেশে অভিজ্ঞতা ও মুগ্ধতাভরা পর্যবেক্ষনের অপর নাম। তবে লেখকের এই মুগ্ধতার পেছনে কারণ রয়েছে অনেক। রাজনীতি থেকে শুরম্ন করে বিশ শতকী ইতিহাসের অনেক কিছু স'ান করে নিয়েছে। আমার কাছে পোল্যান্ড অপার বিষ্ময়ের একটি দেশ। এই দেশের গণ-অভিরম্নচি কিভাবে পুরো পূর্ব-ইউরোপের রাজনীতির চেহারা পাল্টে দিলো,তা নিঃসন্দেহে গভীর অনুসন্ধানের বিষয়। লেস ওয়ালেসা একজন বড় মাপের বিপস্নবী নিঃসন্দেহে। যার দ্রোহী স্বভাব পূর্ব ও মধ্য-ইউরোপের প্রতিষ্ঠিত সমাজ রাষ্ট্রিক ধারার পরিবর্তনে গুরম্নত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে। ওয়ালেসার নেতৃত্বে ১৯৮৯ সালে সমাজতন্ত্রের বলয়মুক্ত হওয়ার পর দুই দশকে দেশটির পুঁজিবাদী অগ্রযাত্রাকেই নির্মোহভাবে দেখতে চেয়েছেন শাকুর মজিদ। যার ফলে বইটি নিছক ভ্রমণ কথা না হয়ে পর্যবেক্ষন ও অনুসন্ধানের দলিল হয়ে উঠেছে। গ্রন'টির প্রতিটি পর্যবেক্ষনেরই একটি শিরোনাম আছে- যেমন, প্রথম পর্যবেক্ষনের নাম; ‘গিদাইনস্ক ঃ লেস ওয়ালেসার নগরী’। এখানেই শুরম্ন নয়, পরে থাকে একটি কাব্যিক উপ-শিরোনাম ঃ‘সেই বন্দর’। এই প্রক্রিয়ায় বিন্যসত হতে থাকে ‘বাল্টিক তীরের বিকেল’, ‘সপোত ঃ পোল্যান্ডের স্পা নগরী’, ‘গিদাইনস্কের রাজবাড়ি’, ‘লেস ওয়ালেসার সাথে এক ঘন্টা’, প্রভৃতি উপ- শিরোনাম। দৃশ্যনির্মাণ ও নাটকীয়তার এক অনন্য দৃষ্টানত হয়ে উঠে শাকুর মজিদের প্রতিটি পর্যবেক্ষন। একটি বর্ণনা - ওয়ালেসা সাহেব সবে এসেছেন তাঁর অফিসে,সেক্রেটারির রম্নমে দাঁড়িয়েই কথা বলছিলেন। আমাদের নিয়ে এক সাথেই ঢুকলেন কামরায়। খুব সাধারন মানের একটি কাঠের টেবিল, সামনে ৫-৬শ টাকার সসতা চেয়ারের এক পাশে ফুলদানিতে তাজা ফুল,আর দূরের দেয়ালে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর একটা ছবি। এই হলো প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের বর্তমান অফিস। আরেকটি পর্যবেক্ষনের নাম ‘তরম্নন ঃ কোপার্নিকের শহর’, উপ-শিরণামগুলো এরকম ঃ ‘রোড টু তরম্নন’, ‘মিকোলাই কোপার্নিক’, ‘কোপার্নিকের জন্মশহর’, প্রভৃতি। শাকুর মজিদের উপস'াপন পদ্ধতি ও বিষয় নির্বাচন বইটিকে ওইদেশ ভ্রমণকারীদের জন্য পূর্ব পাঠ্য করে তোলে। স'পতি শাকুর মজিদ এ গ্রনে' ইতিহাস,ঐতিহ্য ও আবিষ্কারের প্রতিই বেশি মনোনিবেশ করেন যেন। ভ্রমণ কথায় মানব-ইতিহাসের অনেক উপাদান থাকে। কিন' প্রত্যেক লেখকই স্বতন্ত্র হয়ে যান তাঁর জীবন প্রত্যক্ষনের দর্শনের কারণে। বাংলা ভাষার ভ্রমণ কাহিনীগুলোতেও আমরা লক্ষ করবো প্রত্যেক লেখকের নেপথ্যে সক্রিয় এক অনতরিত ‘ভ্রমণকারী মন’ শুধু বসতুুজগত নয়, লেখকসত্তার প্রতিফলনই ভ্রমণ কথাকে করে তলে এক সম্পূর্ন আখ্যান। শাকুর মজিদের ভ্রমণ-আখ্যান আমরা পড়েছি। যেগুলো আমাদের অভিজ্ঞতাকে ঋদ্ধ করার সমানতরালে আগ্রহী করে তোলে ঐ সব ভ্রমণ বিশ্বের প্রতি। তাঁর ভ্রমণ পিপাসা পাঠকচিত্তকেও আগ্রহী করে তোলে সেই সব জগতের প্রতি। যে জগত বর্তমানের চলমানতায় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সমগ্র সত্তাকে আঁকড়ে থাকে।