User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
বর্তমান ও অতীতের মাঝে যে সাঁকো- তার নাম ইতিহাস। দুয়ের সম্মিলনেই তৈরি হয় পথরেখা। সেই পথরেখা ধরে মানুষকে ফিরে আসতে হয় নিজেদের ইতিহাসের কাছেই। বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে যথার্থভাবে অনুধাবন করতে ইতিহাসচর্চার বিকল্প নেই। অতীতের কর্মধারা এবং কর্মপদ্ধতি জেনে বর্তমান পদপে নেয়া সহজতর হয়। বর্তমানের পরিকল্পনা, কাজগুলোও তো প্রকৃতপে ভবিষ্যৎ অভিমুখী। অতীতের সমাজ-সংস্কৃতি ক্রমান্বয়ে রূপান্তরিত হয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসরমান। তাছাড়া নিজেদের শেকড় সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার ক্ষেত্রে ইতিহাসের ভূমিকাই মুখ্য। ইতিহাসচর্চার মাধ্যমেই বেরিয়ে আসে ‘আমার ভিতরের আমি’। মানুষ ইতিহাসের সন্তান, তাই এটাকে এড়ানোর কোনো সুযোগই নেই। এড়িয়ে গেলে বরং তিই। মানবসম্প্রদায়ের বিবর্তন, অর্থনৈতিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক চেতনা- সবকিছু প্রোথিত ইতিহাসে। ইতিহাসের পদচিহ্ন ধরে অগ্রসর হলে মানবগোষ্ঠী একদিন ঠিকই পৌঁছাবে সমৃদ্ধির সোনালি প্রান্তরে। ইতিহাসচর্চা মূলত দুইভাবে হয়ে থাকে- এক. জাতীয় পরিমণ্ডলে দুই. আঞ্চলিক পরিমণ্ডলে। তৃণমূল পর্যায় থেকে অর্থাৎ আঞ্চলিক পরিমণ্ডল হতে ইতিহাসের পঠন-পাঠন শুরু করলে জাতীয় ইতিহাস জানা ও বোঝা সহজতর। সামগ্রিক ইতিহাসকে একটা ভবনের সাথে তুলনা করলে আঞ্চলিক ইতিহাস অভিহিত হবে তার সিঁড়ি হিসেবে। আমাদের আলোচ্য, আঞ্চলিক ইতিহাস। যা কিনা দেশের সামগ্রিক ইতিহাসেও প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তারী। সিলেটের অর্থনীতি ও সমাজ বইটি রচিত হয়েছে সিলেটকে নিয়ে। সিলেট মানে বর্তমান সিলেট নয়, প্রাচীন সিলেট। অঞ্চলটি পরিচিত ছিলো শ্রীহট্ট নামে। তাহলে বইয়ের নামে সিলেট শব্দটি কেন, লেখক যেখানে পরিচিত করাচ্ছেন প্রাচীন সিলেটকেই- প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। ভূমিকাংশে লেখক এ প্রশ্নের উত্তরের পাশাপাশি যৌক্তিক ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। বইয়ে স্থান পেয়েছে দেশের সমৃদ্ধ একটি অঞ্চলের নির্দিষ্ট সময়ের ইতিহাস। যে ইতিহাসে ক্রমান্বয়ে উঠে এসেছে ঐতিহ্যের সোনালি আকর ও একটি জনগোষ্ঠীর ইতিবৃত্ত। সিলেট অঞ্চল নানাভাবে, নানা রূপে বাংলাদেশের জন্য উল্লেখযোগ্য। সুপ্রাচীনকাল থেকে সিলেটের যে ইতিহাস, তা কালে কালে বিবর্তিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কলমে এভাবে ধরা পড়েছে সিলেট- মমতাহীন কালস্রোতে/বাংলার প্রান্ত সীমা হতে/নির্বাসিতা তুমি/সুন্দরী শ্রীভূমি। কবির এ মূল্যায়নে ভালোবাসা যেমন আছে, তেমনি আছে ক্ষোভও। তৎকালীন বাংলায় সিলেট ছিলো আসামের শাসনাধীনে। সঙ্গত কারণেই বৈষম্য ছিলো, আর এ বৈষম্যে সিলেট দীর্ঘদিন থেকেছে উন্নয়নবঞ্চিত, অধিকারহীন। শাসনতান্ত্রিক জটিলতার কারণে আসামের সাথে সিলেটের একীভূত হতে সময় লেগেছে। ধীরে ধীরে সিলেট অগ্রসর হয়েছে সম্মুখপানে। এ বইয়ের লেখক ড. ইফফাৎ জাহান। লেখালেখির ভুবনে যদিও তিনি কোনো পরিচিত মুখ নন কিন্তু উদ্যমী এ মানুষ অসামান্য এক কাজ সম্পন্ন করেছেন যা প্রতিষ্ঠিত, প্রজ্ঞাবান ও যশস্বী লেখকও করতে পারেননি তথা করার সাহস করেননি। সিলেটকে নিয়ে কাজ কম হয়নি। কাজ বলতে গবেষণা, মূল্যায়ন, ইতিহাস-ঐতিহ্য ইত্যাদি ফিরে দেখা। তবে সে কাজের বেশিরভাগই ছড়ানো-ছিটানো এবং আনাড়ি হাতের করা। অনুল্লেখ্য। এতো দীর্ঘ সময় বেছে নিয়ে সেটার চুলচেরা বিশ্লেষণ, এর আগে তেমন একটা হয়নি বললেই চলে। সুতরাং এ বইয়ের মূল্যায়ন তথা আলোকপাত, মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিলও। মোটামুটি বড়সড় কলেবরের এ বই প্রকৃতপে তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভ। কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. অনুরাধা চন্দ ও ড. রতনলাল চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে ২০০২ সালে এ গবেষণাকর্মের মাধ্যমে লেখক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। স্মর্তব্য, তিনি সিলেটি নন, নন-সিলেটি। পাবনায় জন্ম গ্রহণ করেও সিলেটের প্রতি অনুভব করেছেন এক নিবিড় টান। হাজার হোক দেশের মাটি তো! ‘সুন্দরী শ্রীভূমি’ সিলেটের প্রতি ভালোবাসা এবং দেশের অন্যতম সমৃদ্ধশালী এ জনপদ যে বহুলাংশে বিষয়বৈচিত্র্যে ভরপুরÑ দুয়ে মিলে তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় হিসেবে এটাকে বেছে নিতে। ড. ইফফাৎ জাহান সময়কাল হিসেবে বেছে নিয়েছেন ১৭৬৫ থেকে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এই ১২০ বছরের ইতিহাস প্রাঞ্জল ভাষায় মূর্ত হয়ে ওঠেছে। তাঁর গদ্য কান্তিমুক্ত। ঝরঝরে গদ্যের নিবিড় বুননে পাঠক নিবিষ্ট হয় খুব সহজেই। লেখক মোট ৬টি ভাগে ভাগ করেছেন ১২০ বছরের সিলেটকে। অধ্যায়গুলো যথাক্রমে- বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চা ও সিলেট প্রসঙ্গ, সিলেটের ভূমি রাজস্ব প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা, ঔপনিবেশিক আমলে সিলেটের অর্থনীতি, সিলেটে ঔপনিবেশিক শাসন ও স্থানীয় প্রতিক্রিয়া, সিলেটের শিক্ষা ও সংস্কৃতি, সিলেটের সমাজ। পরিশিষ্ট অংশে যোগ করেছেন ৯টি অধ্যায়- রাজস্ব বোর্ডের কালেক্টরের চিঠি, থাকবস্থার জরিপ : ১৮৫৯, ‘পুটিজুরী প্রকাশ’ পুস্তিকায় প্রকাশিত কৃষকদের অবস্থা : ১৮৬১ (এ দুটো অধ্যায়ে যা স্থান পেয়েছে, তা আসলে বিভিন্ন সংগীত), সিলেট শহরে জনমিতির পারিসাংখ্যিক তথ্য : ১৮৬৪, সিলেটের রাজস্ব জমা : ১৯৭০, শ্রীহট্টে দাসী ক্রয় ও কৌলিন্য প্রথা : ১৮৭৩ (বলাবাহুল্য, সময়ের পরিক্রমায়, বিবর্তনের পথে সিলেটের নাম অনেকবার পাল্টেছে। বেশ কয়েকটি নাম রয়েছে সিলেটের। প্রাচীন নামের একটি শ্রীহট্ট), শ্রীহট্টবাসীদের আবেদন : ১৮৭৪, সিলেটের কৃষক সম্প্রদায়ের আবেদন : ১৮৮৩, সিলেটের বিদ্ব্যৎসমাজ। পরিশিষ্টের শেষ অংশ অর্থাৎ সিলেটের বিদ্ব্যৎসমাজ শীর্ষক রচনায় আমরা পরিচিত হই তৎকালীন কিছু কৃতী ব্যক্তিত্বের সাথে। কৃতী ব্যক্তিদের আখ্যানে লেখক কারো জন্ম-মৃত্যুর সন দুটোই উল্লেখ করেছেন, কারো শুধু জন্ম সন আবার কারো জন্ম-মৃত্যু কোনোটাই না। এর কারণ তথ্যাভাব; সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য খুঁজে না পাওয়া। অপূর্ণতা-হেতুর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন লেখক। বিদ্ব্যৎসমাজের প্রতিনিধি হিসেবে স্থান পাওয়া ব্যক্তিরা হলেন- তিলকচন্দ্র গুপ্ত শিরোমণি, গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ, রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থ, রামকুমার নন্দী মজুমদার, মৌলবী মোহাম্মদ দাইম, দুলালচন্দ্র দেব, রাজা গিরিশচন্দ্র রায়, জয়গোবিন্দ সোম, হরকিঙ্কর দাস, সাধক কবি শরচ্চন্দ্র চৌধুরী, হাসন রাজা, প্যারীচরণ দাস, সুন্দরীমোহন দাস, নাসির উদ্দিন হায়দার, বিপিনচন্দ্র পাল, রমাবাঈ সরস্বতী, তারাকিশোর চৌধুরী, খাঁন বাহাদুর হাজী মোহাম্মদ বখত মজুমদার, কামিনীকুমার চন্দ, মৌলভী আবদুল করিম, সুখময় চৌধুরী সি আই ই, হেমন্ত কুমারী চৌধুরানী, আলী আমজাদ খাঁ, কাজী মোহাম্মদ আহম্মদ, কৃষ্ণকিশোর চৌধুরী, অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি, অরুণ কুমার চন্দ, আনন্দময় ব্রহ্মচারী, কৃষ্ণপ্রিয়া চৌধুরী, খাঁন বাহাদুর সৈয়দ আবদুল মজিদ। উল্লিখিত নামগুলো কোনো কোনোভাবে সিলেটের জন্য অনস্বীকার্য। এঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের খ্যাতি এমনই যে, দেশের মানুষ এক নামে চিনবেন। বিশেষ করে গীতিকার (মরমি ও লোকসঙ্গীতের) ও লেখক যারা। লেখক ইফফাৎ জাহানের বড় একটি সততা হলো, প্রতিটি তথ্যপ্রাপ্তির উৎস সম্বন্ধে নিশ্চিত করা। কেউ কেউ গোয়ার্তুমি করে তথ্যঋণ স্বীকারের তোয়াক্কা করেন না। এ লেখক ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে। এ সততার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ না জানালেই নয়। সব মিলিয়ে বইটি সুন্দর। চমৎকার বাঁধাই, ঝকঝকে ছাপা, নির্ভুল অরবিন্যাস বইটিকে করেছে সুষমামণ্ডিত। সিলেটের অর্থনীতি ও সমাজ ড. ইফফাৎ জাহান প্রকাশক : উৎস প্রকাশন প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১০ প্রচ্ছদ : নিলয় হাসান পৃষ্ঠা ৩৮৪, দাম ৪২০