User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
সত্য যে গল্পগাথার চাইতেও রোমাঞ্চকর—এ বই পড়তে গিয়ে বারবার সেই পুরোনো প্রবাদের কথাই মনে হয়েছে। সত্যিই তো, যাঁর জবানিতে এই বইয়ের ঘটনা পরম্পরা, তার বিস্তার এবং সমাপ্তি, সেই নীলুফার হুদার জীবন গল্পগাথার চাইতে কম রোমাঞ্চকর নয়। ঘটনার কেন্দ্রে তাঁর স্বামী কর্নেল নাজমুল হুদা, যিনি আলোড়ন সৃষ্টিকারী কথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ছিলেন, ছিলেন অসমসাহসী মুক্তিযোদ্ধা (বীরবিক্রম), স্বাধীনতা-উত্তরকালে যিনি চাকরিজীবনে সেনাসদরে এজি ব্রাঞ্চ পুনর্গঠনে রাতদিন পরিশ্রম করেন, একেবারে শূন্য থেকে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি, ছিলেন এর প্রথম কমান্ডান্ট, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল সাফায়েত জামিলের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যিনি সামরিক বাহনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে অনড় সংকল্পবদ্ধ হয়েছিলেন, সেই তিনি ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের তথাকথিত সিপাহি বিদ্রোহে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হন। সেই মহান দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধার ট্র্যাজিক জীবন-কাহিনি স্মৃতিচারণসূত্রে তুলে ধরেছেন তাঁর সহধর্মিণী নীলুফার হুদা। নীলুফার হুদা নিজেদের প্রেমভালোবাসা, স্বামীর বীরত্ব, রাষ্ট্রিক ষড়যন্ত্র, পারিবারিক দুঃখকষ্ট ও যন্ত্রণা ইত্যাদির বর্ণনা অনুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেছেন ‘নিজের চোখের পানির কালি দিয়ে’। বিয়ের এক থেকে দেড় বছরের মাথায় ১৯৬৮ সালে ৩ জানুয়ারি তাঁর স্বামী খোন্দকার নাজমুল হুদা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হন। বন্দি অবস্থায় গোপনে তিনি সহধর্মিণী নীলুফার হুদাকে যেসব চিঠি লেখেন, তার থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নাজমুল হুদার প্রগাঢ় দেশপ্রেমের বিষয়টি। তিনি স্ত্রী নীলুফারকে লিখছেন, ‘আমার বিবেকের কাছে আমি পরিষ্কার যে, যে কারণ বা আদর্শের জন্য আমাকে এই কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে, সেই আদর্শের পেছনে আমার কোনো স্বার্থপর ইচ্ছা বা পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্র কাজ করেনি। বরং এটা এমন এক আদর্শ, যাকে মহৎ বলে মনে করি এবং এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।’ ১৯৬৯ সালের উত্তাল গণঅভ্যুত্থানের মুখে আগরতলা মামলা থেকে নাজমুল হুদাসহ অভিযুক্তদের সবাই বেকসুর খালাস পান। কিন্তু নাজমুল হুদা অন্যদের মতো সামরিক বাহিনীর চাকরি হারান। তাঁর এই সময়কার সংগ্রামের কথা স্মৃতিচারণসূত্রে নীলুফার হুদার যত সবিস্তারে তুলে ধরেন, তার পাঠ সত্যিই আবেগমথিত করে তোলে। জীবনের এই পর্যায়ের সংগ্রাম শেষ হতে না-হতেই শুরু হয়ে যায় পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। নীলুফার হুদা এই সময় তার স্বামীর বেসরকারি কর্মস্থল কুষ্টিয়ায় থাকতেন। নাজমুল হুদা কালবিলম্ব না করে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন সেই যুদ্ধে। আবার নতুন করে আরেক সংগ্রাম শুরু হয় নীলুফার হুদার জীবনে। স্বামী যুদ্ধক্ষেত্রে, এবং যেখানে তিনি থাকতেন, সেই জায়গাটা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে বলে নিরাপদ কোনো আশ্রয়ের সন্ধানে যাত্রা করেন। তিনি জানাচ্ছেন, কোলে তাঁর অবোধ কন্যাসন্তান। ছেলেটির বয়স বছর চারেক। চরের বালু ভেঙে পথ চলা সহজ ছিল না। ফলে ছেলেটিকে তার ওপর দিয়ে হাঁটিয়ে নেওয়ার জন্য নীলুফার হুদা একটা পথ বের করেন। ‘বালুর মধ্য থেকে মাটি বা পাথরের টুকরো হাতে তুলে নিয়ে আমি দূরে ছুড়ে মেরে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলাম, দেখি তো বাবু, কে আগে ধরতে পারে, আমি পারি, না তুমি পার?’ নীলুফার আরও জানাচ্ছেন, ‘এতে ভালোই কজ হলো।…আমার ছুড়ে দেওয়া ঢিল ধরার জন্য বাচ্চা ছেলেটা দৌড়ে দৌড়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল।’ এভাবেই তিনি চরের কঠিন পথ ছেলেকে অতিক্রম করান। এ-রকম অনেক বিবরণ আছে এ-বইয়ে, যা সত্যিই মর্মস্পর্শী। পরিশেষের দুটি অধ্যায় ‘কুমিল্লা থেকে রংপুর এবং কালো পঁচাত্তর’ ও ‘আমার নতুন জীবনযুদ্ধ’। এই দুটি অধ্যায় থেকেই আমরা জানতে পারি, কীভাবে কোন্ অবস্থায় খোন্দকার নাজমুল হুদা, খালেদ মোশাররফ ও মেজর হায়দারকে হত্যা করা হলো। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নীলুফার হুদা বারবার জিগ্যেস করেও জানতে পারেননি কেন তাঁর স্বামী, মেজর হায়দার ও খালেদ মোশাররফকে হত্যা করা হলো? তাঁরা তো কারো রক্ত ঝরাননি। তাঁর প্রশ্নের জবাব মেলেনি। তারপর জিয়াউর রহমান নিহত হলেন। তার হত্যাকাণ্ডের কথিত বিচারের নামে হত্যা করা হলো অনেক সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যকে। নীলুফার হুদা এসব-কিছুরই সাক্ষী। এ সূত্রেই এই বইয়ের উপসংহার টানা হয়েছে এইভাবে, ‘একটা সাইকেল চলতে থাকে আর কি! মানে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে দাঁড়াননি বলে জিয়াউর রহমান নিহত হয়েছেন। খালেদ মোশাররফ, হুদা ও হায়দারকে যারা তাদের প্রতিপক্ষের হাতে তুলে দিয়ে সাহায্য করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তাঁরা বাঁচতে পারেননি।’ এসব কিছু থেকে নীলুফার হুদা যখন সিদ্ধান্ত টানেন এই বলে যে, ‘পৃথিবীতেই মানুষের বিচার হয়ে যায়’, তখন এই গ্রন্থের পাঠ শেষে অনেকক্ষণ থমকে থাকতে হয়।