User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
জন্মের ৪০ বছর পরও জন্মলাভের পেছনে কার অবদান বেশি আর কার একটু কম—এখনো এ নিয়ে বিতর্ক চলমান। দুর্ভাগ্য এই বাংলাদেশের। স্বাধীনতা-পরবর্তী বছরগুলোয় গণমানুষের এই যুদ্ধের এবং তার জয়লাভের কৃতিত্ব একবার এদল তো আরেকবার ওদল আর সামরিক লোকজনের গলা অলংকৃত করলেও হিসাবের খাতিরে এখনো উচ্চারণ করতে হয় ‘তিরিশ লাখ শহীদ আর আড়াই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা’র কথা। এই তিরিশ লাখ আর আড়াই লাখ কারা? তাঁরা কি সবাই রাজনীতি করতেন? তাঁরা কি সবাই সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিলেন? সবাই কি তাঁরা গেরিলা ট্রেনিং নিয়েছিলেন? ওই তিরিশ লাখের মধ্যে নারী-শিশু ছিলেন না? তবে তাঁরা শহীদের মর্যাদা পেলেন না কেন? আর ওই হতভাগী আড়াই লাখ কেবল ইজ্জতই দিয়েছেন? তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অবদানকারী বা যুদ্ধাহত নন? তবে তাঁরা কেন যুদ্ধ-পরবর্তীকালে গৌরবান্বিত হওয়ার বদলে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে পালিয়েছেন? আর এই তিরিশ লাখ-আড়াই লাখের বাইরে আরও যে কোটি কোটি বাঙালি, তারা? যে কৃষক ধানের আড়ালে অস্ত্র লুকিয়ে এনে ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়েছেন, যে মাঝি জীবন বাজি রেখে রাতের আঁধারে মুক্তিযোদ্ধাদের পৌঁছে দিয়েছেন নিরাপদে, যে হতদরিদ্র নারী হাসিমুখে একমাত্র ডিম পাড়া মুরগিটা জবাই করে তুলে দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের পাতে কিংবা যে কিশোর ঝুঁকির মুখে একটুও বিচলিত না হয়ে এনে দিয়েছে শত্রুর খবর—তারা মুক্তিযোদ্ধা নন? যে মা নিজ হাতে টগবগে তাজা তরুণ ছেলের হাতে স্টেনগান তুলে দিয়েছেন—সেই মা? তাঁদের মহিমার জয়গান কই? তাঁদের কে মনে রাখে? যেখানে গুটিকয় দালাল ও সুবিধালোভী ছাড়া আর সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, সেখানে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা বা মুক্তিযোদ্ধার সনদপ্রাপ্তদের কীভাবে আলাদা করা যাবে? অবধারিতভাবেই সেই সনদ আর তালিকায় দেশের প্রান্তিক জনগণ বাদ পড়ে গেছে। আর নারী তো প্রান্তিকদের মধ্যে আরও প্রান্তিক। আশার কথা, এত বছর পর আজ ইতিহাস নিজেই কথা কইতে শুরু করেছে। দেশের প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা নারীরাও মুখ খুলছেন। একজন গুলি খাওয়া পঙ্গু পুরুষ মুক্তিযোদ্ধা আর একজন জরায়ুতে জখম হওয়া নারীর আত্মত্যাগে যে তফাত খুব বেশি নেই, দুজনই যুদ্ধের নৃশংসতার শিকার, তাও ইদানীং অনেকেই অনুভব করতে পারছে। এতকাল যে অধ্যায় লুকিয়ে রাখা হতো, এতকাল নারীর যে অবদান ও আত্মত্যাগের কথা গৌরব নয়, বরং লজ্জা ও ধিক্কার ছড়াত আমরা তার মহিমার জয়গান আজকাল শুনতে পাচ্ছি। গণহত্যা ও ধর্ষণ দুই-ই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুদ্ধকালীন অপরাধের বিষয় হিসেবে বিচারের যোগ্য বলে বিবেচিত হওয়ায় এই ইতিহাস জানা ও বোঝার নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। মালেকা বেগমের মুক্তিযুদ্ধে নারী বইটি এই ধারাবাহিক প্রয়াসের একটি অংশ। নতুন প্রজন্মের পাঠক হয়তো চমৎকৃত ও বিস্মিত হয়ে পড়বে বরিশালের মুলাদী থানার কুতুব বাহিনীর করুণা কেমন করে গ্রেনেড ছুড়তে গিয়ে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন অথচ আজও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সম্মান পাননি। কীভাবে অপারেশনের আগে সাঁথিয়ার ভানু নেছা ওসির কাছ থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের এনে দিয়েছেন গোলাবারুদ, কেমন করে ঢাকার রওশন আরা বুকে মাইন বেঁধে হানাদার বাহিনীর ট্যাংকের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, স্বরূপকাঠিতে নদীতে নোঙর ফেলা পাকিস্তানি গানবোটের গায়ে রাতের আঁধারে সাঁতরে গিয়ে গ্রেনেড চার্জ করে এসেছেন বীথিকা বিশ্বাস আর শিশির কণা নামের দুই অসম সাহসী তরুণী, গল্পের মতো শোনাবে যে ছেলেদের পোশাক পরে চুল ছোট করে কেটে পুরুষ পরিচয়ে ক্যাম্পে নিশ্চিন্তে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে রাত কাটিয়েছেন পাবনার শিরিন বানু মিতিল। রাখাইন কিশোরী প্রিনছা খেঁ কিংবা সিন্দুরখান চা-বাগানের সালগী খাড়িয়ার মতো আদিবাসী নারীদের অসামান্য ভূমিকার কথাও আমাদের কাছে নতুন ও বিস্ময়করই ঠেকবে। ‘বাংলার ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’ যুদ্ধে নামার এই অমোঘ আহ্বানের মধ্যে ঘোষিত হয়েছে যে এই যুদ্ধ সত্যিকার অর্থেই গণমানুষের যুদ্ধ, নারী ও পুরুষ, তরুণ ও বুড়ো অর্থাৎ ঘরে ঘরে সবারই অংশগ্রহণে ফলবান হবে সেই যুদ্ধ। যুদ্ধ হলো, সংঘটিত হলো ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণলীলা, সব কিছুর বিনিময়ে একদিন বিজয়ও এল; কিন্তু সেই স্বাধীনতা ও বিজয়ের ফল চলে গেল একাংশের হাতে। তা নিয়ে লোফালুফিও কম হলো না। কেবল হারিয়ে গেল সাধারণ ও প্রান্তিক জনসাধারণের অবদানের কথা, নিরন্ন দুঃখী-দরিদ্র কোটি বাঙালির আত্মদান ও গৌরবের মহিমা। একাত্তরের ইতিহাস থেকে নারীর হারিয়ে যাওয়া পুরুষের চোখে দেখা ও লেখা সেই বৈষম্যেরই পরিণাম। সময় এসেছে এই উদাসীনতা, অবহেলা ও বৈষম্যের ভুল অসমাপ্ত ইতিহাস থেকে বেরিয়ে আসার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের সামরিক পতিতালয়ে ধর্ষিত কোরিয়ান ও ফিলিপিনো নারীরা দীর্ঘ ৫০ বছর পর জাপান সরকারের ক্ষমাভিক্ষার দাবি জানিয়েছেন। কাজেই নতুন করে এক বৈষম্যহীন বহুমাত্রিক ও সামগ্রিক ইতিহাস রচনার সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। মুক্তিযুদ্ধে নারী গ্রন্থটি হয়তো সেই নতুন ইতিহাসেরই মুখবন্ধ। সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ২৫, ২০১১