User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
পত্রিকায় যখন খ্যাতিমানদের সাক্ষাৎকার ছাপা হয়, তখন অনেক প্রশ্নের ভিড়ে একটি প্রশ্ন থাকে। আপনার শখ কী? মানুষের তো বিচিত্র শখ। কারও গান শোনা, কারও খেলা দেখা, কারও ছবি তোলা বা আঁকা, আবার কারও কারও শখ ঘুরে বেড়ানো। কিন্তু আজকাল ভ্রমণ শুধু শখের বিষয় নয়, বিষয়টি অনেকের কাছেই নেশার মতো। মৃত্যুঞ্জয় রায় তেমনই একজন ভ্রমণে নেশাগ্রস্ত লেখক, যিনি দীর্ঘদিন ধরে হেঁটে বেড়িয়েছেন বাংলার পথে প্রান্তরে। দক্ষিণে একেবারে আমাদের শেষ বিন্দু সেন্ট মার্টিন থেকে উত্তরে বাংলাবান্ধা পর্যন্ত। ভ্রমণে একেকজনের পছন্দ একেক রকম। কেউ শুধু দেখেই উদ্বেলিত, আপ্লুত। আবার কেউ দেখাদেখিটা ভাগাভাগি করে নিতে চান। মৃত্যুঞ্জয় রায় দ্বিতীয়দের দলে। কারণ, তিনি দেখি বাংলার মুখ গ্রন্থে সেই কাজটিই করেছেন। এ গ্রন্থে তিনি তাঁর দেখার জগৎকে উন্মোচিত করেছেন পাঠকের জন্য। যে দেশটা এত সুন্দর, সে দেশের মানুষ ভ্রমণপিপাসু হবে না তো হবে কারা। আমাদের চারপাশের কোনো দৃশ্যই একঘেয়ে নয়, সর্বত্র ছড়িয়ে আছে অপার বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্যের স্বাদ নিতেই মৃত্যুঞ্জয় রায় একদিন ঘর ছাড়েন। চলে যান বাংলার সর্ব-উত্তর জনপদ পঞ্চগড়ের বাঙালপাড়া গ্রামে। এ গ্রামটির এক অংশ আমাদের মানে বাংলাদেশের, আরেক অংশ ভারতের। অথচ কি আশ্চর্য, সাতচল্লিশের আগে কেউ কি ভেবেছিল এমন হবে? কারও বাপেরবাড়ি ওপাড়ায়, আবার ওপাড়ার কারও নানার বাড়ি এপাড়ায়। ভীষণ কষ্টের জীবন। ছেলে মাকে দেখতে যেতে পারেন না, মাও ছেলেকে সহজে দেখতে পান না। তাঁরা পাশাপাশি থাকেন, তবু কাছাকাছি নয়। লেখক সেখানকার মানুষের এসব হাহাকারের কথা তুলে এনেছেন ‘দুই দেশের এক গ্রাম’ শিরোনামের লেখায়। আরও জানিয়েছেন ওই সীমান্তে বাংলাদেশের শেষ বাড়িটির কথা। তারপর তিনি আমাদের নিয়ে যান বহুল আলোচিত ছিটমহলে, যেখানকার মানুষ ভারতের সীমারেখার কারণে মূলত বন্দী। মানচিত্রের বিচারে তারা বাংলাদেশের বাসিন্দা। কিন্তু সেখান থেকে তাদের বের হতে হলে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে হয়। কি এক শেকড়হীন জীবন। ওদের দেশ থেকেও নেই! দেশের ভেতর দেশান্তরী! কিন্তু এটাই যে বড্ড বাস্তব। লেখক জানিয়েছেন, ভারতের ভেতর বাংলাদেশের এমন ১১৯টি ছিটমহল আছে। তাদের জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে দুঃখ, হতাশা, ক্ষোভ। এসব প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে লেখক কথা বলেছেন বারবার। তাদের অনুভূতিগুলো পাঠকের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে চেয়েছেন। প্রসঙ্গত, তিনি অনেক দরকারি তথ্যও উপস্থাপন করেছেন। দীর্ঘ ৪৫ বছর পর ১৯৯২ সালের ২৬ জুন বহুল আলোচিত তিন বিঘা করিডর উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এমন অনেক তথ্যই লেখক বলে দিয়েছেন ফাঁকে ফাঁকে। লেখাগুলো নিছক ভ্রমণবৃত্তান্ত নয়, বাড়তি হিসেবে আরও অনেক কিছুই পাওয়া যায় এখানে। আমরা জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ রায়ের অমর কীর্তি বলধা গার্ডেন সম্পর্কে জানি। কিন্তু কে এই জমিদার, কোথায় তাঁর বাড়ি, সেসব কথা অনেকেই জানি না। সেই অজানা অধ্যায়টিই এখানে উন্মোচিত হয়েছে একটু ভিন্ন স্বাদে। লেখক একদিন হাজির হলেন সেই বলধা গ্রামে। তিনি যেতে যেতে, দেখতে দেখতে চমকপ্রদ কথাগুলো বলে দিলেন আমাদের। একসঙ্গে দেখার আনন্দ, বলার আনন্দ, একসঙ্গে নানা তথ্য। সবকিছু মিলিয়ে কোথাও কোথাও একেবারে ইনফরমেটিভ ট্রাভেল। এবার একেবারে শালবন। তাও লালমনিরহাটের নওদাবাস শালবন। এখানেও প্রকৃতির নিখাদ বর্ণনা। বনের গহিনে গিয়ে উপভোগ করেছেন তার নৈঃশব্দ্য ও সৌন্দর্য। শালবনের পর আছে গজারি বনের হাতছানি। কীভাবে গেলেন সে বর্ণনা, কী কী দেখলেন, আদি এই বন কেন ক্রমে সংকুচিত হয়ে আসছে, সেসব অসংগতির কথাও বাদ গেল না। নাটোরের উত্তরা গণভবনে আছে একটি ইতালীয় ফর্মের বাগান। সেই বাগানটির কথাই তিনি তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘এবার নাটোর গিয়ে দেখা হলো বনলতা সেনের সঙ্গে।…উত্তরা গণভবনের রাজ-উদ্যানের ভেতর দেখলাম সেই অপূর্ব অঙ্গসৌষ্ঠব আর মায়াবী চাহনির বনলতা সেনকে।’ এমন একটি সাবলীল ও চমকপ্রদ বর্ণনা থেকে আমরা খুব সহজেই রাজকীয় উদ্যানটিতে প্রবেশ করতে পারি এবং উদ্যানটি না দেখেই এক ধরনের দেখার স্বাদ অনুভব করতে পারি। তবে দেবকাঞ্চনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন ফুলটি ফাগুন মাসে ফোটে, আদতে দেবকাঞ্চন হেমন্তের ফুল। প্রকৃতির বর্ণনা থেকে লেখক আমাদের কখনো কখনো ইতিহাসের কাছে নিয়ে গেছেন। তিনি তুলে এনেছেন দিনাজপুরের ৮০০ বছরের পুরোনো ও বিলুপ্ত আওকরা মসজিদ, কক্সবাজারের রামকোট বনাশ্রম, রংপুরে বেগম রোকেয়ার জন্মভিটা, মাইকেল মধুসূদনের সাগরদাড়ি গ্রাম, সাহিত্যিক মনোজ বসুর ডোংগাঘাটা, ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের পৈতৃক ভিটা টাউন শ্রীপুর গ্রাম এবং রাজশাহীর পুঠিয়ায় অবস্থিত বিখ্যাত পঞ্চরত্ন শিবমন্দিরের কথা। একইভাবে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র ঐতিহাসিক নাগরী মিশনের কথাও বিবৃত হয়েছে। আমরা আবার নতুন করে আমাদের বিখ্যাত গ্রামগুলো সম্পর্কে জেনে নিলাম। মৃত্যুঞ্জয় রায় এবার চললেন নোনা দরিয়ার পাড়ে। টেকনাফ থেকে শুরু করে একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে সুন্দরবন পর্যন্ত। প্রথমে জলপাথরের ইনানী। এ নামটি পর্যটকদের মুখস্থ। তবে লেখক স্থানটির বর্ণনা আরেকটু আবেগঘন ভাষায় দিলে মন ভরত। কারণ বর্ণনার চেয়ে তথ্যকেই তিনি এখানে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। একই কথা মহেশখালীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নানা প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর এ দ্বীপটির প্রাকৃতিক বর্ণনা আশানুরূপ হয়নি। মনে হয়েছে তিনি পাঠককে শুধু বিষয়-সংশ্লিষ্ট কিছু তথ্য জানাতে চেয়েছেন। আদিনাথ মন্দিরের চূড়ায় দাঁড়ালে চারপাশের যে অপরূপ দৃশ্য ভেসে ওঠে, সে সৌন্দর্য থেকেও তিনি আমাদের বঞ্চিত করেছেন। এমন কয়েকটি ক্ষেত্রে ভ্রমণের চেয়ে ভ্রমণ নির্দেশিকাই প্রধান হয়ে উঠেছে। সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ০৭, ২০১০