User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
কবিতার সঙ্গে অনেককাল বসবাস করে বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের মালিক হওয়ার পর একজন কবির সামগ্রিক গন্তব্যের দিশা পাওয়া যায় কি না, বিষয়টি নিয়ে অনেকের হয়তো অনেক রকম ব্যাখা আছে। তবে কয়েকটি কবিতার বই প্রকাশের পর ওই কবির কাব্য অনুষঙ্গ ও ভুবন সম্পর্কে গড়পড়তা একটি ধারণা যে দাঁড় করানো সম্ভব, এটি মোটামুটি বলা যাবে। বাংলাদেশের কাব্যজগতে কবি মোহাম্মদ রফিকের কবিতা সম্পর্কে পাঠকের মধ্যে একটি পোক্ত ধারণা বর্তমান। মোটাদাগে ধারণাটি এমন—তাঁর কবিতায় বাংলার মাটি-মানুষের ঐশ্বর্য-ঐতিহ্য ও জীবনযাপনের চিহ্নগুলো হাজির। আছে আখ্যানের মায়ামেশানো মাটি, যার মধ্যে এ দেশের স্বপ্ন ও বাস্তবতার চেহারাটি বেশ তাগড়া—স্পষ্ট। কিন্তু প্রশ্নটি যদি এভাবে আসে—কবিতার সঙ্গে দীর্ঘদিন বসবাসের পর মোহাম্মদ রফিক এখন কোথায় যেতে চান, তবে খানিকটা প্যাঁচ লেগে যেতে পারে। যে বাংলাকে শব্দে শব্দে অদ্যাবধি তিনি লিখছেন, সে কি ঐশ্বর্যমণ্ডিত মরমি ভাবপ্রবণ বাঙ্গালা নাকি বর্তমানের হাওয়া-বাতাসপূর্ণ বাংলাদেশ?—এই যুগপৎ জিজ্ঞাসার জবাব আছে মোহাম্মদ রফিকের সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ অশ্রুময়ীর শব-এ। কেননা ঐতিহ্য আর মহাকালের পাটাতনে দাঁড়িয়ে সমকালীন মসলার ঝাঁঝে ভরপুর এই গ্রন্থ। অশ্রুময়ীর শব গ্রন্থে কবিতার সংখ্যা ৩৬। রফিকের কবিতার চিরচেনা অনুষঙ্গের সঙ্গে এখানে বড়সড় তল্লাট নিয়ে আসন পেতেছে মৃত্যুচিন্তা-কেন্দ্রিক শূন্যতার আবহ—‘ফিরে আসা ঠিক নয়,/ এই বাক্য শুধরে নিয়ে/ অবশেষে সেও ফিরে এল,/ ছায়ার জগৎ থেকে/ ঘোর অপচ্ছায়ার প্রান্তিক/ তীর্থভূমে, ইচ্ছায় অথবা/ অনিচ্ছায়, সাধ করে…’। গ্রন্থে ‘অনিঃশেষ’ নামে এই প্রথম কবিতাতেই শূন্যতার আরও বলিষ্ঠ নিশানা দেখি কবিতার শেষ পর্বে—‘আলো ছুঁয়ে আছে আলো/ ছায়াচ্ছন্ন জলে, মারমুখী/ স্রোতে একা হাঁটছে শূন্যতায়!’ শূন্যতার সেই নিঃসীম চরাচরে কবির পদচ্ছাপ ছাড়া তো আর কাউকে দেখা যায় না। কবির ব্যক্তিজীবনের নৈঃসঙ্গ, শেষ বেলার আক্ষেপ গ্রন্থের পরতে পরতে মাতম করছে। আর নিঃসঙ্গতার লেজে লেজ জোড়া দিয়ে এসেছে মৃত্যুচিন্তা। মৃত্যুভাবনাটি অর্গল ছিঁড়ে আরেকটু খোলতাই হয়েছে ‘মাটির কাফন’ নামাঙ্কিত কবিতায়। প্রান্তর মাড়িয়ে, বিষকাটারির বনঝোপ বেয়ে এখানেও ফেরার প্রসঙ্গ আছে। এরপর অন্তিম বাক্যে প্রশ্নাকুল হয়ে উঠেছেন কবি—‘বলে যাও, ভাষা কোনো বাধা নয়, চিন-পরিচয়ে/ সূত্রাধার তার চেয়ে অধিক বাঙ্ময়, ওই ভস্মের অগ্নিতে/ নিভে আসা চোখের ইশারা, ক্ষণিকের স্পর্শ, ঈষৎ মন্থর;/ তবু, যদি না-ই খোলে, ওপারে যাওয়ার কানাগলি,/ পদশব্দ, হিম শ্বাস, তবে কার মাটির কাফন’। শেষ পঙিক্ততে এসে কবির এই সংশয়বোধ মৃত্যু আর মাটির কাফনকে যেন জীবনের দরবারেই ফিরিয়ে এনেছে। মৃত্যুগন্ধি বাতাবরণ রফিকের নোনাঝাউ ও দোমাটির মুখ কাব্যগ্রন্থেও জারি আছে। কিন্তু অশ্রুময়ীর শব-এ পৌঁছে এই মৃত্যু স্বদেশের মলিন মুখের ওপর ‘দুস্থতার ভাঙনের ছায়া’ ফেলে, ‘বিকট রহস্যময় ধাঁধা’ হয়ে ‘কোনো পিছ দুয়ারি ঘরে’ কবির সঙ্গে বসে একা দোল খায়, কখনো বা ‘ভূ-বিশ্বের সীমা-পরিসীমা মানচিত্র ছেড়ে’ জীবনকে আবাহনও করে—এমনই বৈচিত্র্যে জেল্লাদার তার শরীর। আবার মরণের এই বর্ণিল আবহের সঙ্গে বাঙ্গাল কবির মরমি ভাব যখন জোড় বাঁধে, এক আড়ালচারী কুহক তৈরি হয় বটে তখন। কথার সপক্ষে ‘দেখা-সাক্ষাৎ’ কবিতাকে তবে সাক্ষী মানা যাক—‘বন্দর থেকে একে একে/ জাহাজগুলি ছেড়ে যাওয়ার পর/ আমি জিজ্ঞাসা করলাম/ আমার স্যুটকেসটি কোথায়!/ সে বলল, ঠিকমতো তুলে দেয়া হয়েছে।/ স্যুটকেসটির সঙ্গে আমার/ আর সাক্ষাৎ হওয়ার সুযোগ রইল না/ তা হলে!’ গোটা কয়েক পঙিক্তর কবিতাতে মরমি ভাবতত্ত্বের অগোচরে আত্মা ও দেহের কথাই কি বলা হলো? ‘স্যুটকেস’ কি আত্মার প্রতীক, ‘বন্দর’ মানবজীবনের সমার্থক? অনেক তরফেই ভাবনার সুযোগ আছে। রহস্যের আবির ছড়িয়ে কবি এরপর আর টুঁ শব্দ করেননি। তবে বলার কথাটি হলো, এ কবিতার শব্দগুলো কোনো নির্দিষ্ট অর্থে আবদ্ধ নয়, মুহূর্তেই সে একরকম প্রতিসরণ তৈরি করে। পাঠককে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে অর্থ উদ্ধারে। এ ছাড়া ‘আক্ষেপ’, ‘বিবেক’, ‘তবে’, ‘স্বপ্ন’, ‘শুধু এই’, ‘মরমি বাখান’, ‘জাতিস্মর’—এমন বেশ কিছু কবিতা রয়েছে এ গ্রন্থে, প্রতিসরণের মাধ্যমে যা কবি ও পাঠকের মধ্যে বুঝপোড়ের দ্বৈরথ তৈরি করে কবিতাকে বরং আরও রসগ্রাহী করে তুলেছে। অশ্রুময়ীর শব গ্রন্থে মোহাম্মদ রফিকের ‘অন্যরূপে বিন্যস্ত’ হওয়ার কৃতিত্ব বোধ করি এখানেই। পাঠক হিসেবে চেনা-পরিচিত আদলের বাইরে কবিকে এখানে নতুন অবয়বে চিনে নেওয়ার মওকা মিলেছে অন্তত!