User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
প্রায় ২০০ বছর আগে মালিকা নামে এক বিজ্ঞানী এক সমতল ভূমির পার্শ্ববর্তী তুরা পাহাড় ও পাহাড়ের নানা উষ্ণ প্রস্রবণ, লুকানো আগ্নেয়গিরির নকশাসংবলিত বই তুরার পাহাড়ের নকশা রচনা করেন। আর ২০০ বছর পর সেই সমতল ভূমিতে শুরু হয় এক যুদ্ধ। সমতলের কিছু বিজ্ঞানী তাঁদের দেশের অনেক দারিদ্র্যের মধ্যেও সময় যে সামনে অগ্রসরমাণ এই সত্যে আস্থা রেখেছিলেন। আর তাই তাঁরা ঘড়ি নির্মাণের প্রকৌশল আয়ত্ত করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। ঘণ্টা, মিনিট আর সেকেন্ডের কাঁটার সূক্ষ্ম কারুকাজ থাকত সমতল ভূমির ঘড়ি নির্মাতা বিজ্ঞানী ‘যান্ত্রিক’দের বানানো সেসব ঘড়িতে। অসিতোপল ছিলেন এমন এক দক্ষ ঘড়ি নির্মাতা আর সময়ের প্রবহমানতাবিষয়ক সমতল ভূমির তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী ছিলেন মৈনাক। সমতল ভূমি থেকে দূরের এক এলাকার ‘চিতা’ নাম্নী সামরিক বাহিনী সময়বিষয়ক জ্ঞানচর্চা ঘৃণা করত বলেই তারা ঘড়িকেও ঘৃণা করত। লেখক স্পষ্ট করে উল্লেখ না করলেও বোঝা যায় যে চিতারা মনে করত ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তাই আমাদের তৈরি করেছেন। কাজেই অতীতে কী হয়েছিল, বর্তমানে কী হচ্ছে আর ভবিষ্যতে কী হবে তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা এবং সেই ভাবনাকে কাঠামোগত রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে ঘড়ি নির্মাণ মূলত ঈশ্বরদ্রোহ। এই ঈশ্বরদ্রোহী সমতলের মানুষদের শাস্তি দিতে চিতারা এক প্রবল অভিযান চালায় সমতল ভূমিতে। চিতাদের সামরিক বাহিনীর অন্যতম ক্যাপ্টেন কর্নিক গ্রেপ্তার করেন সময়বিষয়ক তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী মৈনাক ও দক্ষ ঘড়ি নির্মাতা অসিতোপলকে। দীপেন (দেবদর্শী) ভট্টাচার্যের দিতার ঘড়ি বাংলা ভাষায় এ পর্যন্ত লিখিত সায়েন্স ফিকশন বা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিগুলো থেকে এককথায় স্বতন্ত্র। ঘোর লাগানো গদ্যভাষা আর কাহিনির নানা বাঁক ও অন্তর্গত সংজ্ঞা পাঠককে ভিন্নতর পাঠ অভিজ্ঞতা দিতে বাধ্য। কেননা, চিতা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সমতলের মানুষের যুদ্ধের বিবরণ পাঠ করতে করতেই আপনি বুঝে যাবেন যুদ্ধে আপন ভাইয়ের বিরুদ্ধে সমতলের মানুষদেরই যে অংশটি চিতাদের সাহায্য করে সেই দ্বিতীয় বাহিনী শুধু বিজ্ঞানের কল্পকথার কোনো ‘দ্বিতীয় বাহিনী’ নয়। চিতা বাহিনীর জেনারেল ত্রাস যেন আজ থেকে ৪১ বছর আগে আমাদের ভূখণ্ডে সংঘটিত হয়ে যাওয়া এক রক্তাক্ত যুদ্ধের বিজাতীয়, দখলদার বাহিনীর প্রধান জেনারেল। চিতাদের হাতে নিহত বিজ্ঞানী মৈনাক হয়ে ওঠেন একাত্তরে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিহত সব শিক্ষক ও ছাত্রের প্রতিভূ। আমরা চিনতে পারি দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে পার্টিশানদের ভেতরে চিতাদের দলের লুকিয়ে থাকা প্রচ্ছন্ন প্রতিনিধি ‘আরাত্রিক’কেও যে কিনা সহযোদ্ধা ক্রান্তিক ও আরও কিছু দেশপ্রেমিক পার্টিজান যোদ্ধাকে বিশ্বাসঘাতকতা করে ধরিয়ে দেয়। সায়েন্স ফিকশনের মোড়কে বাংলাদেশের ইতিহাসের কিছু অংশ ব্যবহার করলেও দীপেন এখানে হুবহু মুক্তিযুদ্ধের স্লোগানও রচনা করতে বসেননি। শেষ পর্যন্ত এ আখ্যান তাই হয়ে ওঠে বিজ্ঞানী মৈনাক ও মৈনাকের স্ত্রী আদ্রিকা যে কিনা তাঁদের দুজনেরই ক্যানসারগ্রস্ত বৈমানিক বন্ধুকে সেবা করতে মৈনাকের জীবন থেকে স্বেচ্ছায় হারিয়ে যায়, যান্ত্রিক অসিতোপল ও তাঁর হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকা মৃত্তিকা (যে মৃত্তিকা সমতলের মানুষের হাজার বছর আগের সমুদ্রযাত্রা ও নৌ-অভিযানের প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের নেশায় ব্যস্ত থাকে) এবং অসিতোপলের পালিতা কন্যা দিতা, ১০ বছর আগে সমতল ভূমির প্রবল যুদ্ধের সময় ঘড়িনির্মাতা অসিতোপল ও তাঁর ষোড়শী কন্যা দিতাকে বাঁচাতে উন্মুখ দেশপ্রেমিক যোদ্ধা বাহিনী পার্টিশানদের অন্যতম যোদ্ধা ‘ত’ ও সহযোদ্ধা আরাত্রিকের বিশ্বাসঘাতকতায় গুরুতরভাবে আহত ‘ত’ যখন ১০ বছর পরে রেট্রোগ্রেড অ্যামনেসিয়া বা মারাত্মক স্মৃতিভ্রষ্টতায় আক্রান্ত হয়ে ‘ত-২’ নামে এক ভিন্ন চরিত্রের মানুষ হিসেবে অবতীর্ণ হয়...সেই একক কিছু মানুষের যৌথ অথচ নির্জন আখ্যান! কাহিনির শুরুতে আমরা দেখতে পাই কাহিনির অন্যতম নায়ক ত-২ উত্তম পুরুষে জানাচ্ছেন যে গত দুই বছরের ভেতর একটি তরুণীর সঙ্গে তার প্রথমে রেলপথে এবং পরে তুরা পাহাড়ে দেখা হয়েছে। দ্বিতীয়বার পরিচয়ের সময় তিনি জানতে পারেন যে মেয়েটির নাম শেফালিকা। উপন্যাসের তৃতীয় পরিচ্ছেদে জানা যায়, নায়ক ত-২ ১০ বছর আগের এক যুদ্ধে গুরুতরভাবে আহত হয়ে স্মৃতিভ্রষ্টতায় আক্রান্ত। কিন্তু চিকিৎসক যেন এই রোগীকে চিনতে পেরে খুব বিস্মিত হয়ে এক ঘড়ি নির্মাতার বাড়ি পাঠান। ঘড়িনির্মাতা অসিতোপল ও তার ২৬ বছরের যুবতী কন্যা দিতাকে (যে কিনা অবিকল শেফালিকার মতো দেখতে) চিনতে পারে না ত-২, যদিও এই পিতা-পুত্রীকে ১০ বছর আগের এক যুদ্ধে বাঁচাতে গিয়েই সে আহত হয়েছিল। হয়েছিল স্মৃতিভ্রষ্ট। পিতা-পুত্রী অবশ্য চিনতে পারে এই যুবককে। ধীরে ধীরে বাঁধাকপির পাতার মতো বা রুশ মাত্রিয়োশকা পুতুলের মতো কিংবা ‘আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা,’ ‘কথাসরিতসাগর’ কি খানিকটা ‘ডেকামেরনে’র ঢঙেই লেখক একটি গল্পের আবরণের নিচ থেকে বের করে আনতে থাকেন আরও ১০টি গল্প! কী হয়েছিল ১০ বছর আগের সেই যুদ্ধে? চিতা বাহিনীর নির্মম অত্যাচারে বিজ্ঞানী মৈনাকের মৃত্যুর পর একটি গ্রামে লুকিয়ে থাকা পালিতা কন্যা দিতার সম্ভ্রম রক্ষার্থে ঘড়িনির্মাতা অসিতোপল রাজি হন চিতা বাহিনীকে একটি ডায়নোসর যন্ত্র নির্মাণ করে দিতে। যে ডায়নোসর যন্ত্র অসিতোপলের স্বদেশি মানুষের জন্য যুদ্ধরত পার্টিশান তরুণদের প্রবল অত্যাচার করতে সক্ষম হবে। বুদ্ধিমান অসিতোপল অবশ্য ডায়নোসর যন্ত্রে অনেকগুলো ঘড়ি সংযোজন করে এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অত্যন্ত জটিল একটি সমীকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে চেষ্টা করছিলেন যেন শত্রুর জন্য বানানো যন্ত্র দিয়েই শত্রু সংহার সম্ভব হয়। কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বা অ্যাস্ট্রোনমির মহাবিশ্বসংক্রান্ত সুপ্রচলিত তত্ত্বে বলা হয়েছে যে একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমরা যে মহাবিশ্বে বাস করি তার পাশাপাশি আরও বেশ কিছু এবং আরও বেশ কিছু সময় কাঠামো থাকতে পারে বা থাকা সম্ভব। আর তাই একই সময়ে আমরা বেশ কিছু জীবনযাপন করতে পারি বা করা সম্ভব। মূলত এই তত্ত্বকেই নিপুণভাবে ব্যবহার করে লেখক দীপেন দেখান যে ১০ বছর আগের সেই সুড়ঙ্গপথে বিস্ফোরণের দিনে যুদ্ধটা তিনটি ফলাফল লাভ করেছিল। যুদ্ধের একটি ফলাফলে সমতলের দেশপ্রেমী পার্টিজানরা জয়ী হয়েছিল (‘ত’-২ এর জগৎ)। আরেকটি ফলাফলে সমতলের পার্টিজানরা পুরোপুরি হেরে যায় (‘ত’-৩ এর জগৎ) এবং যুদ্ধের আরেকটি ফলাফলে ১০ বছর আগে সুড়ঙ্গপথের সেই বিস্ফোরণের দিনে সমতলের মানুষ আপাতদৃষ্টে জিতলেও পরবর্তী সময়ে আরাত্রিক ও দ্বিতীয় বাহিনী চিতাদের দর্শন অর্থাৎ সময় ও ঘড়ির বিরুদ্ধে পুনরায় আগ্রাসন শুরু করে এবং অসিতোপলরা হেরে যান (এটা ‘ত’-এর জগৎ)। ‘ত’-এর মতো আমরা সবাই কি রেট্রোগ্রেড অ্যামনেসিয়ায় আক্রান্ত? ‘ত’ কি দিতাকে চিনতে পেরেছে? দিতাই কি শেফালিকা? ইতিহাসের চাকা কি চক্রাকার? তাই যে সময়ের জন্য এত যুদ্ধ, সেই সময়ই আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে বলে হাহাকার করেন মনোরোগ চিকিৎসক আদৃকা? ঘড়িনির্মাতা অসিতোপলের সঙ্গে তার প্রেমিকা মৃত্তিকার আর দেখা হয় না যে মৃত্তিকার খুব বিশ্বাস ছিল ‘সুনীল সাগরে প্রবালঘেরা দ্বীপের কথা আমি এখনো ভুলিনি। কোনো দিন কি আর সেখানে আমাদের দেখা হবে?’ যে মৃত্তিকা সমতলের মানুষের হাজার বছর আগের সমুদ্র অভিযানের কথা ভেবে গর্ব করে ভাবত যে শুধু দুই বেলা দুটি খুদকুঁড়োর সংগ্রামই সমতলের মানুষের একমাত্র ইতিহাস নয়। প্রেম, মনোবিকলন, ইতিহাস বা সময় চেতনার আখ্যানের পাশাপাশি ‘দিতার ঘড়ি’ তাই বাঙালির ফিরে দেখার গল্পও বটে। গল্প তার আত্মোপলব্ধি ও আত্ম-আবিষ্কারের।