User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
উপন্যাসের শুরুই হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি ঘটনা দিয়ে। গোলার আঘাতে পা উড়ে গেছে। যুদ্ধের ভয়াবহতা কতটা নির্মম হতে পারে শুরুতেই লেখকের বর্ণনায় সেগুলো উঠে এসেছে। উত্তম পুরুষে লেখা প্লটে বলা হয়েছে এভাবে : ... ডিউটিতে ছিল তখন থার্ড ইঞ্জিনিয়ার, জীবনে আর দেখা হয়নি ওর চাঁদমুখ, পরে জেনেছি, সে ছিল জাহাজ থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়া শেষ নাবিক, জাহাজে অবশ্য এমনই নিয়ম, আমাকে ওভাবে ঝুলে থাকতে দেখে দৌড়ে আসে ক্যাপ্টেন, টেনে উঠাতে যেয়ে দেখে পায়ের একটা পেশি আমাকে আটকে রেখেছে সিঁড়ির সঙ্গে, এক মুহূর্ত ভাবে, তারপর দৌড়ে রান্নাঘরে যায়, মাংস কাটার ছুরি দিয়ে এক কোপে পেশিটা কেটে ফেলে, ঝুপ শব্দ শোনার জন্য চেতনা অবশিষ্ট ছিল তখনও, সিঁড়ির সঙ্গে ডেকের আংটায় ঝুলে মৃত্যুকে দেখি অনেক কাছ থেকে ... কামাল রাহমানের ‘তাজতন্দুরি’ উপন্যাসে শুরুর পর্ব পড়েই পাঠকের মন আটকে যাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়বহতার সঙ্গে। অনেকে ভাবতে পারেন হয়তো সে সময়েরই কোনো এক গল্প বলবেন লেখক। তবে গল্পের বাঁক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হবে যুদ্ধের দাবানল ছাপিয়ে তা পৌঁছে গেছে জীবনের যুদ্ধে। প্রবাসে অনভিজ্ঞ বাঙালিদের জীবন সংগ্রামের পর অভিজ্ঞ হয়ে ওঠা। নিরন্তর নিজেকে অপরিচিত জায়গায় খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রসঙ্গটিই খুব উজ্জ¦লভাবে উপন্যাসে দেখা দেয়। উপন্যাসে লেখক দুটি চরিত্র নিয়ে খেলা করেছেন। রাফি ও সারোয়ার। তেরো পর্বে বিস্তৃত উপন্যাসে বেজোড় পর্বে উত্তম পুরুষে রাফি বর্ণনা করেছেন যুদ্ধের পর ব্রিটেনে বাঙালির অভিবাসনের সম্পূর্ণ ইতিহাস। আবার জোড় পর্বে এসেছে সারোয়ারের গল্প। যেখানে বর্ণনা করা হয়েছে ব্রিটেনে প্রেম ও ভালোবাসার রঙিন স্বপ্নগুলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন সৈনিক হিসেবে ভারত থেকে জাহাজে ওঠে রাফি। পথিমধ্যে জার্মান বাহিনীর বোমার আঘাতে তার একটি পা উড়ে যায়। এর ছ বছর পর রাফি লন্ডনে গিয়ে পৌঁছে। তার আগের গল্পটাও বলে নেওয়া উচিত। বিয়ের ছ মাসের মাথায় স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাফি উঠে জাহাজে। এরপরই তো যুদ্ধ। তারপর পরিবারের সাথে কোনো যোগাযোগ সে করেনি। পাঁচ বছরে তাদের কাছে রাফি এক মৃত সত্তা। আর তাই নববধূকে আবার বিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে রাফি ব্রিটেনেই নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেছে। লেখকের উপন্যাসে এ প্রসঙ্গটি আসে এভাবে : আমার মনে হয়েছে এখানে মানিয়ে যাবো আমি, গেছিও, একটা পা নিয়ে পৃথিবীর যতটা পথ পেরিয়ে এসেছি, অনেকাংশেই সুখী, ও সম্পূর্ণ আমি, যদিও সে-অর্থে মানুষের জীবনের পূর্ণতা কখনোই আসে না, সাধারণ একজন মানুষের প্রাপ্তি আর কতটুকু,... উপন্যাসে ভারতীয়দের ব্রিটেনের আগমন নিয়েও বলা হয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন ভারতীয় ছাত্ররা দলে দলে ব্রিটেনে আসে পড়াশোনা করতে। অথচ ভারতবর্ষ তখন উত্তপ্ত। আবার ‘ইন্ডিয়া শাফি’ নামে প্রথম ভারতীয় রেস্টুরেন্ট খোলা হয় লন্ডনে। উত্তর প্রদেশের রহিম ও ওয়াসিম নামের দু ভাই পড়াশোনা শেষ করতে এসে এ ব্যবসায় নেমে পড়ে। এভাবেই প্রবাসে ভারতবর্ষের মানুষগুলোর আবাসনের চিত্র ফুটে ওঠে বিজোড় পর্বগুলোতে। রাফির ইতিহাস বর্ণনা ও জীবনের গল্প উপন্যাসে যোগ করে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। এটি গল্পের আড়ালে অনেকটা তথ্যনির্ভর ইতিহাসই আসলে বর্ণনা করে চলে। অন্যদিক জোড় পর্বগুলোতে বলা হয়েছে সারোয়ারের গল্প। দম বন্ধ করা জায়গায় চাকরি করে সারোয়ার। বিলেতের রেস্টুরেন্টগুলোতে চাকরি করা মানেই হলো বন্দিত্ব। যেখানে চাকরির জায়গা সেখানেই ঘুম; আমোদ-প্রমোদ, অলস-বিলাস সব এক জায়গাতেই। ব্যস্ততার পর একটু বিশ্রামের জায়গা নেই বললেই চলে। রোমান্টিক সারোয়ার প্রকৃতির প্রেমে হাবুডুবু খায় শুরুতেই। আবার শৈশবের স্মৃতির সাথে মিশিয়ে নেয় বিলেতের প্রকৃতিকে। বিলেতের রংহীন প্রকৃতির মাঝেও সারোয়ার রঙ খুজে বেড়ায়। উপন্যাসে এ প্রসঙ্গ এসেছে এভাবে : শীত ঋতুতে গোধূলি নেই এসব দেশে, আছে আলোর নিভে যাওয়া, শীতের আকাশে সূর্য ডুবে যাওয়ার সময় আশ্চর্য এক রং ছড়িয়ে দেয়, তুষারপাতের পর কখনো আকাশ থেকে কুয়াশা সরে যায় অকস্মাৎ, রোদ এতো ঝকঝকে তখন যে বাইরের সাদা প্রকৃতির দিকে খালি চোখে তাকানো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়... রেস্টুরেন্টে কাজের অভিজ্ঞতাগুলোও ফুটে ওঠে সারোয়ার চরিত্রের মধ্য দিয়ে। সেখানকার কঠোর জীবনযাপন উঠে আসে উপন্যাসে। জানা যায়, কাস্টমারদের দেওয়া টিপসও কর্মচারীদের পটেকে যায় না। বেতন বিলেতের নিম্নতম মজুরির অর্ধেকেরও কম। রেস্টুরেন্টে একজন কর্মচারী সপ্তাহে ষাট থেকে সত্তর ঘণ্টা কাজ করে। সেখানেও বেতনের হেরফের করে মালিকপক্ষ। এসব কিছু সারোয়ার মেনে নিতে পারে না। মাঝে মাঝে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েও ভাবে সারোয়ার। দুটো চরিত্রের একসাথে বেড়ে ওঠা উপন্যাসটিকে ভিন্নতা দিলেও শুরুতে পাঠক খানিকটা ধাঁধায় পড়ে যান। দুটি চরিত্রকেই কখনো কখনো একই সুতোই গাঁথা মনে হবে। কিন্তু এখানে আসলে বলা হচ্ছে দুটি অভিবাসী প্রজন্মের গল্প, যারা ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যায়। একটি প্রজন্ম বিলেতে আবাসন পাকাপক্ত করেছে। আরেকটি প্রজন্ম সেখানে কর্মক্ষেত্রের সুযোগের ব্যবহার করছে এবং জড়িয়ে যাচ্ছে নানা জটিল সম্পর্কে। আবার দূর পরবাসে থেকেও প্রত্যেকেই নিজের শেকড় অনুসন্ধান করে চলে। একই সঙ্গে জীবনযাপনের বাস্তবতা আর মাতৃভূমিকে ঘিরে নস্টালজিয়া তাদের কাতর করে রাখে। দুটি প্রজন্মই অনভিজ্ঞ। কিন্তু তারপরও জীবনের যুদ্ধে তারা কেউই হেরে যেতে চায় না। কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই তারা এগিয়ে চলে, এগিয়ে যেতে চায়। এ প্রসঙ্গটি উপন্যাসের একটি কথোপকথনে উল্লেখ করা হয়েছে : বাঙালিরা বিলেতের মতো এমন একটা দেশে একটা ইন্ডাস্ট্রি কীভাবে গড়ে তুললো, হুঁ, আমার কি মনে হয় জানো? পৃথিবীর কোনো কাজই খুব বেশি পরিকল্পনা করে হয় না, হয়ে যায়, পরিবেশ-পরিস্থিতি এগুলো ঘটিয়ে নেয়, ধরো, বাঙালিরা কি কোনো পরিকল্পনা করেছিল এসবের জন্য? যদি কোনো পরিকল্পনা করে থাকে তাহলে কি রকম সেটা? কারা করেছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই তৈরি হয়ে গেছে কামাল রাহমানের ‘তাজতন্দুরি’। সমান্তরাল বারোটি পর্বের পর তেরো পর্বে এসে দুজনের কাহিনী একসঙ্গে দাঁড়িয়ে যায়। আর সেখানেই লেখক কামাল রাহমান প্রশংসার দাবিদার হয়ে যান। বাংলা ভাষার কোনো ডকুফিকশনে দুটি গল্পকে একই সাথে তৈরি করা এটাই বোধহয় প্রথম। এ উপন্যাসে বাক্যের শেষে কোনো দাড়ি নেই। কমা দিয়ে পরবর্তী বাক্য যোগ করা হয়েছে। এমনকি উপন্যাসের শেষেও দাড়ি ব্যবহার করা হয়নি। যদিও এমন স্টাইল এর আগে শহীদুল জহির ব্যবহার করেছেন। কামাল রাহমানের এই বইটিকে বলা যেতে পারে, একই সঙ্গে ব্রিটেনে বাঙালির অভিবাসন ও প্রতিষ্ঠালাভের ইতিহাস, আবার বিলেতে বাঙালির অভিবাসন নিয়ে একটি উপাখ্যান। এভাবেই এটি একই সঙ্গে হয়ে ওঠে ডকুমেন্ট ও ফিকশন, সহজ কথায় ডকুফিকশন। কামাল রাহমানের ‘তাজতন্দুরি’ প্রকাশ করেছে মাওলা ব্রাদার্স, প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ, মূল্য ২০০ টাকা।