User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
রাজাগজাদের হট্টগোল, ক্ষমতা দখল,জয়-পরাজয়, লোকহিতৈষী মনোভাব কিংবা চন্ডাল স্বভাব - এসবই ইতিহাসের বইয়ের পাতায় খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এ ধরনের একঘেয়ে বিষয়আশয় ছাড়া কী ইতিহাসের গল্প শোনা যায় না? হ্যা, যায়। আপাতদৃষ্টে ঘটে অতীতে পরিণত হওয়া এমন অনেক ঘটনাই আছে যার প্রচলিত হিসেবে ঐতিহাসিক মূল্য হয়তো কিঞ্চিতকর। কিন্তু যাঁরা ভারী ভারী ইতিহাসের বোঝা মাথা থেকে ঝেড়ে গল্পচ্ছলে ইতিহাসের খুঁটিনাটি জানতে চান তাঁদের জন্য বইটি লিখেছেন পেশায় কূটনীতিক কিন্তু নেশায় ঘোরতর ইতিহাসপাঠক মাহবুব আলম। ১৪৪ চকচকে পৃষ্ঠা সমৃদ্ধ 'প্রথমা' - র বইটি তাদের অন্যান্য বইয়ের মতোই খরুচে। চীনে ধর্মীয় ও লোককাহিনী মতে জিরাফ খুব পবিত্র প্রাণী। মধ্যযুগের চীনে তখন মিং সম্রাট ইয়াং লোর রাজত্ব। হঠাৎ তার রাজধানীতে এসে হাজির সুন্দর সেই পবিত্র স্বর্গীয় প্রাণী চেলিন ওর্ফ জিরাফ। রাজ্যে হইচই চলছে। প্রজারাও চেলিনের আগমনে দারুণ খুশি। হাতি আসুক, না জিরাফ তাতে আমাদের কী? আমাদেরই মাথাব্যাথা কারণ বঙ্গের সুলতান শিয়াবুদ্দিন বায়জিদ শাহ চীন সম্রাটের বন্ধুত্বের স্বরূপ এটি পাঠিয়েছিলেন। মিং রাজাদের সরকারি ইতিহাসে এই জিরাফরূপী চেলিন বেশ জায়গাজুড়ে আছে বলে সেই গল্প শোনান মাহবুব আলম। এই যে, চীনের দিকে মনোযোগ দেয়ার নীতি যাকে বলি " লুক ইস্ট পলিসি"। তার সূচনা করেছিলেন বাংলার স্বাধীন সুলতান গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ। কেন তাঁর এই দূরদর্শীতা? কীভাবেই বা বঙ্গ সুলতান জানতেন চীনের চেলিনের জন্য হাহাকারের কথা। নাকী স্রেফ কাকতালীয়? "গুপ্তধন" শব্দটা শুনেই শীর্ষেন্দুর কিশোর উপন্যাসগুলোর কথা পয়লাতেই মনে পড়লো। রবীন্দ্রনাথ, বিভূতি, নজরুল,হেমেন রায়, শরদিন্দু, সত্যজিৎ রায়ের গুপ্তধন বিষয়ক গল্প আর উপন্যাসগুলো পড়েন নি এমন পাঁড় পাঠক পাওয়া ভার। না পড়লেও গুপ্তধন নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই, বরং বাড়তি বাড়তি। মাহবুব আলম পাঠককে সত্যিকারের গুপ্তধনের কথা শুনিয়েছেন ইতিহাস ঘেঁটে। বাঙালি লোভী একথা তো সর্বজনবিদিত। কিন্তু মাহবুব আলম গৌড়ের সেই কৃষক আর তার রাখাল ছেলের কথা বলেছেন। তখন শাহ সুজা বাংলার সুবাদার। সেই রাখাল গৌড়ের রাজপ্রাসাদ থেকে ঘড়াভর্তি মণি-মাণিক্য পেয়েও ফিরিয়ে দিয়েছিল সুবাদার সুজাকে। কত টাকাই বা হবে সেই গুপ্তধনের দাম? পর্তুগিজ পাদরি সেবাস্টিয়ান মানরিক জানিয়েছিলেন, সেই গুপ্তধনের দাম সেই আমলের ৩৪ কোটি টাকা মাত্র। ত্রিপুরার অমর দিঘি কিংবা চট্টগ্রামের নগরাজের গুপ্তধন কাহিনী তো বেশ জনপ্রিয়।দারুণ রোমাঞ্চকর ছিল এই প্রবন্ধটি। কোম্পানি শাসনের শুরুতে কিংবা সুলতানি আর নবাবি আমলে বাংলা ছিল রপ্তানিনির্ভর। আদার বেপারির জন্য জাহাজের খবর কেন প্রাসঙ্গিক ছিল একদা তারই ইতিহাস লিখেছেন মাহবুব আলম। মালদ্বীপে চাল বেচতাম আমরা, বিনিময়ে জাহাজ ভর্তি কড়ি পাঠাতো মালদ্বীপ। কড়ি তো মুদ্রা হিসেবে এই ১৯৩০ সালের দিকেও বঙ্গের কিছু এলাকায় চালু ছিল বলে দাবীর সপক্ষে নানা প্রমাণ দিয়েছেন লেখক। কেনই বা কড়ির চল ওঠাতে বাধ্য হয় কোম্পানি সে কারণও রীতিমত চমকপ্রদ। কড়িকাহিনী কিন্তু বরই সরেস। বাংলার গরম সহ্য করা কোনোকালেই সহজ ছিল না। মোগল আর ইংরেজ কেউই এই গরম থেকে রক্ষা পায়নি। "গরমনামা" প্রবন্ধে গরমকে ঠেকাতে নানা কৌশল বর্ণিত হয়েছে। যা বেশ আগ্রহউদ্দীপক। মির্জা নাথানের " বাহারিস্তান ই গায়বী " বইটি ঐতিহাসিক ও ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য অবশ্য পাঠ্য। নাথান সাহেব বাংলায় সুবাদারের অধীনে সেনাপতি ছিলেন। তিনি স্বয়ং বাঁরোভূইয়াদের দমনের যুদ্ধ করেছিলেন। এই নাথান সাহেবের বইকে ভিত্তি করে বাঁরোভূইয়াদের হাতিনামার কথা বলেছেন, জানিয়েছেন সিলেটের বীর খাজা ওসমানের বীরগাঁথা। ওসমানের হাতির প্রশংসা আছে জাহাঙ্গীরনামায়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিচিত্র সব বিষয়আশয় নিয়ে আগ্রহ ছিল। তিনি শুনলেন, রাখাইন রাজের এক আশ্চর্য সুন্দর সাদা হাতি আছে। যেটি তিনি থাইল্যান্ড কিংবা সেদিক হতে হস্তগত করেছেন। জাহাঙ্গীর বাংলার সুবাদারকে আদেশ দিলেন এই সাধের শ্বেত হস্তী কে জোগাড় করে হাজির করতে হবে। সুবাদার কাশিম খাঁ আর ইব্রাহিম খাঁর ব্যাপক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও শ্বেত হস্তী হস্তগত হয়নি জাহাঙ্গীরের। সম্রাট শাহজাহান একবছর ঢাকা ছিলেন। কেন, কবে জানতে বইটি পড়তে হবে। ভিক্টেরিয়ার মুনশি আবদুল কে নিয়ে ইদানীং বেশ চর্চা হচ্ছে। রাণীর আগ্রাবাসী আবদুলের প্রতি এতো যত্নআত্তি নিয়ে নানা কানা ঘুষা প্রচলিত।সেদিকে যান নি লেখক। তবুও আকর্ষণ রয়েছে প্রবন্ধটি। বাঙালি বিশেষত, কলিকাতাবাসী হিন্দু বাঙালিদের ইংরেজি চর্চার পয়লা নাম্বার গুরু ছিল খিদিরপুরের কুলিরা! বাঙালির ইংরেজি চর্চার শুরুটা বড্ডবেশিই আমোদময়। মাহবুব আলম বিচিত্র বিষয়কে পুঁজি করে এই বইকে দাঁড় করিয়েছেন। বিস্তর পড়াশোনা করেছেন তো বটেই। ইতিহাসের খুঁটিনাটির গল্প নিয়ে সুন্দর একটি বই "গুপ্তধনের খোঁজে" ।
Was this review helpful to you?
or
সাধারণভাবে আমাদের কাছে ইতিহাস মাত্রই সাল-তারিখ বর্ণনা, রাজা-রাজড়ার নিরস যুদ্ধ এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বের গল্প। অথচ পুরো ব্যাপারটাই যে উপভোগ্য হতে পারে, তা আমরা শিক্ষাজীবনে উপলব্ধি করতে পারি না। কারণ ইতিহাসের বিচিত্র উপাখ্যানগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরা হয় না। ইতিহাসের মতো আপাত নিরস জিনিসও যে বিষয়-বৈচিত্র্য ও লেখক-গুণে সরস হয়ে উঠতে পারে তা প্রমাণ করেছেন মাহবুব আলম তাঁর “ গুপ্তধনের খোঁজে: ইতিহাসের বিচিত্র সরস কাহিনী” গ্রন্থে। শিরোনাম দেখে মনে হতে পারে, বইটিতে সম্ভবত গুপ্তধনের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে; আসলে তা নয়। ‘গুপ্তধনের খোঁজে’ শীর্ষক একটি অধ্যায় থেকে বইয়ের মূল শিরোনামটি ধার করা হয়েছে। আমার মতে, ‘ইতিহাসের বিচিত্র সরস কাহিনী’ উপশিরোনামটিই বইয়ের মূল বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করছে। মাহবুব আলম পেশায় কূটনীতিক ছিলেন। তবে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া করেছেন ইতিহাস নিয়ে। সেই পড়াশুনা এবং গবেষণার ফল এই গ্রন্থ। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম এই বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, “খণ্ডিত সত্যের কাঠামোয় ভর করে মধ্যযুগ থেকে উনিশ শতকের বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিতে ওঠানামা ও ভাঙাগড়ার যে নানা চিহ্ন চোখে পড়ে, সেসবই প্রবন্ধ আকারে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে এই বইয়ে। এর কিছু অংশ আমাদের চেনা, কিছু অস্পষ্ট। আবার অনেকের কাছেই হয়তো একেবারেই অচেনা”। বইয়ের সূচনা হয়েছে মধ্যযুগের বাংলার কূটনৈতিক যোগাযোগের একটি চীনা সরকারি বিবরণ দিয়ে। ১৪১৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার স্বাধীন সুলতান শিহাবুদ্দিন বায়েজিদ শাহ চীনের সম্রাটকে উপহার হিশেবে পাঠিয়েছিলেন একটি জিরাফ। চীনা নথিতে এই ঘটনার বেশ ঘটা করে উল্লেখ করা হয়েছে। চীনারা বিশ্বাস করত ‘চিলিন’ নামক একটি প্রাণীর অস্তিত্বে, যাকে নিয়ে অনেক পৌরাণিক গল্প সবার মুখে মুখে ফিরত। যদিও লেখক জানাচ্ছেন যে, চিলিন তথা জিরাফ নিয়ে নিয়ে চীনাদের উচ্ছ্বাস নথিতে খুঁজে পাওয়া গেলেও প্রেরক বাংলার সুলতানকে নিয়ে কোনো উচ্ছ্বাস চোখে পড়ে না। এ থেকে সেই শতাব্দী প্রাচীন সত্যটি খুঁজে পাওয়া যায়। চীনারা বরাবরই নিজেদের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি বলেই গণ্য করত। বাংলা মুলুকের সাথে তাদের কূটনৈতিক যোগাযোগের লক্ষ্যও ছিল নিজেদের মহত্ত্ব প্রচার করা। কিন্তু বাংলার সুলতান খুব ভেবে চিন্তেই চীনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। চারদিকে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে মিত্র খুঁজে পেতে বাংলা পূর্বে তাকায়। বাংলা মুলুক ও চীনের মধ্যে অনেকবারই কূটনৈতিক সফর হয়েছিল এবং সেসবের লিখিত বিবরণ চীনের নথিতে খুঁজে পাওয়া যায়। এসব বিবরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ,কেননা সেসময়কার বাংলার চালচলনের ঘনিষ্ঠ বিবরণ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। লেখক মাহবুব আলম নানা ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে ‘‘বাংলার সুলতান, চীনের সম্রাট, আফ্রিকার জিরাফ’’ অধ্যায়টি সাজিয়েছেন। কিন্তু প্রচুর তথ্যে ভারাক্রান্ত হয়ে এই অধ্যায়টি প্রাঞ্জলতা হারিয়েছে। বইয়ের অন্যান্য রচনার তুলনায় আলোচ্য অধ্যায়টি কিছুটা অনাকর্ষণীয় মনে হলেও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাকালে এই অধ্যায়ের গুরুত্ব সর্বাধিক। বিশেষ করে সুলতানের রাষ্ট্রাচার বিভাগের নিয়মকানুন ও বিদেশী মেহমানদের অভ্যর্থনা জানানোর রীতিনীতির সাথে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে আশ্চর্য সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। পরবর্তী অধ্যায়টি এই বইয়ের সবচেয়ে সুলিখিত এবং উপভোগ্য অধ্যায়। বাংলা সাহিত্যে এবং উপকথায় গুপ্তধনের উপস্থিতি আমরা বরাবরই লক্ষ্য করে থাকি। এসব যে নিছকই কল্পকাহিনী নয়, তা আমাদেরকে ঐতিহাসিক তথ্য ও সাক্ষ্য দিয়ে জানাচ্ছেন লেখক। লেখক জানাচ্ছেন, সে যুগে বাংলার বণিক এবং ধনী সম্প্রদায়ের মাঝে তাদের ধন-দৌলত মাটির নিচে পুঁতে রাখার চল ছিল। তবে এই প্রথা কোনো রূপকথা থেকে নয়, বরং তৎকালীন সামাজিক অবস্থা কারণেই উদ্ভূত হয়েছে। মধ্যযুগের সচ্ছল বণিক এবং কর্মচারীরা দস্যুদের ভয়ে নিজদের যাবতীয় সম্পদ মাটির নিচে গুপ্ত-স্থানে লুকিয়ে রাখত। যেহেতু ধাতব পদার্থের মুদ্রার চল ছিল, সেহেতু নষ্ট হবার ভয় ছিল না। অনেক সময়ই সেই সম্পদের মালিক কিংবা উত্তরাধিকারের মৃত্যুর ফলে লুক্কায়িত সম্পদের খবর আর কারো জানা না থাকায় সেই সম্পদ একসময় গুপ্তধনে পরিণত হতো। কৃষিকাজ, ভবন কিংবা রাস্তা নির্মাণের সময় মাঝে মাঝে গুপ্তধনের দেখা মিলত। লেখক এই অধ্যায়ে অনেকগুলো ঐতিহাসিক উদাহরণের মাধ্যমে গুপ্তধন প্রাপ্তির হদিস দিয়েছেন। লেখক জানাচ্ছেন, সেই যুগে গুপ্তধনের কিংবদন্তী স্থানীয় লোকজন এমনভাবে বিশ্বাস করত যে, ইংরেজ প্রত্নতাত্ত্বিকেরা তাদের অনুসন্ধানের সময় প্রায়ই প্রবল বাধার সম্মুখীন হতেন। যদিও ইংরেজ আমলে সামাজিক নিরাপত্তা এবং কোর্টকাছারির বিধানের ফলে মানুষের মধ্যে নিরাপত্তার বোধ জন্ম নেয়ায় মাটির নিচে সম্পদ লুকিয়ে রাখার প্রথা উঠে যায়। এ অধ্যায় থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি, ইতিহাসের সব পর্বেই মানুষ তার সংকটে কোনো না কোনো উপায় বের করেই ফেলে, তা সে যতোই অদ্ভুত হোক না কেন। যদিও প্রচলিত বাগধারায় আছে ‘আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবরে কী দরকার’, তবুও লেখক মাহবুব আলমের মতে, বঙ্গদেশের আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর রাখতে হতো। ইংল্যান্ডের শিল্প-বিপ্লবের পূর্বে বাংলাদেশ এবং আশেপাশের অঞ্চল মূলত ছিল রপ্তানিকারক দেশ। জাহাজের মাধ্যমেই সেকালে সব ধরনের পণ্যের আদান-প্রদান হতো। রপ্তানি পণ্যের তালিকায় নানান কাঁচামাল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল ছাড়াও বিভিন্ন শৌখিন দ্রব্য ছিল। লেখক বলছেন, এই তালিকায় আদাও ছিল। অবশ্য আদার ব্যাপারীর খবর জানানোই লেখকের মূল উদ্দেশ্য নয়। বাংলার বণিকদের সমুদ্রগামী বাণিজ্য এবং রপ্তানিকারকের ভূমিকার তুলে ধরাই আসল উদ্দেশ্য। সেকালে জাহাজ চালানো একটি বিরাট ব্যবসা ছিল। এতে প্রয়োজন বিপুল জনবলের, দক্ষতার, প্রয়োজন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক যোগাযোগের। এক কথায় বহির্বাণিজ্য তথা সমুদ্র-বাণিজ্যের প্রতি ইঙ্গিত দিচ্ছে উপরোক্ত বাগধারা। এভাবেই বিভিন্ন লোককথা, বচন, লোকগল্প থেকে প্রাচীন ইতিহাস উদ্ধার করা সম্ভব। কড়ি, টানাপাখা এবং চরকা সেই মধ্যযুগ থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত আমাদের দেশের সমাজ, অর্থনীতি এবং দৈনন্দিন জীবনে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল। মজার ব্যাপার হলো, লেখক এই বইয়ে জানাচ্ছেন যে, বাঙালির অতি-চেনা এই সব ক’টি বস্তুই বিদেশ থেকে আনা। ‘কড়িকাহিনী’ শীর্ষক প্রবন্ধে লেখক বঙ্গদেশে কড়ির প্রচলন থেকে শুরু করে বিলুপ্তির রূপরেখা এঁকেছেন। এমনকি কড়ির সাথে সোনা ও রূপার টাকার বিনিময় হারের কিছু এককও তুলে ধরেছেন। ঊন-বিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইংরেজদের খাজনা প্রদানের জন্য অনেক অঞ্চলে কড়ি ব্যবহৃত হতো। ইংরেজদের আমলেই আরেকটি বস্তুর ব্যাপক পরসার ঘটে- টানাপাখা। উপমহাদেশের গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ইংরেজরা নানা উপায় অবলম্বনের ব্যর্থ চেষ্টার পর সুলতানদের আমলের টানাপাখার প্রথায় ফিরে যায়, দেশজুড়ে পাঙ্খাপুলার নামক এক কর্মজীবী সম্প্রদায় তৈরি হয়ে যায়। চরকায় কেটে সুতা বানানোর চল, আমাদের দেশে হাজার বছর আগে থেকেই ছিল। চরকায় সুতা কেটে নিজেদের চাহিদা পূরণের পর বিদেশে রপ্তানি করে অনেক বাঙালি সচ্ছলতার মুখ দেখেছিল। বাঙালি নারীরা অবসর সময়ে চরকায় সুতা কেটে আয় করে স্বাবলম্বী হয়েছিল বলে জানিয়েছেন লেখক। পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের শিল্প-বিপ্লবের ফলে কারখানায় তৈরি সুতার দাম ব্যাপক কমে যাওয়ায় চরকায় সুতাকাটা কর্মীরা বিপাকে পড়ে। ধীরে ধীরে উপমহাদেশ থেকে চরকার চল উঠে যায়। মহাত্মা গান্ধী সবার নজর আবার চরকার দিকে ফেরানোর চেষ্টা করে কিছুটা সফল হলেও, বাজার অর্থনীতির যুগে বড়ো পুঁজির সঙ্গে এই ক্ষুদ্র কুটির শিল্প টিকতে পারে নি। ‘‘নিজের চরকায় তেল দাও’ শিরোনামের অধ্যায়ে চরকার স্বর্ণযুগ এবং বিলুপ্তির গল্প ঠাই পেয়েছে। ‘নাথানের চোখে বারোভুঁইয়াদের হাতি’ শীর্ষক রচনাটি আলোচ্য বইয়ের সবচেয়ে অদ্ভুত অধ্যায়। এই অধ্যায়ে লেখক বারো ভুঁইয়াদের গুণকীর্তন করেন নি, করেছেন তাঁদের বিশাল হস্তি-বাহিনীর। মোগল সেনা মির্জা নাথান তাঁর ‘বাহারিস্তান-ই-গায়বী’ নামক গ্রন্থে মোগল বনাম বারোভুঁইয়ার বস্তুনিষ্ঠভাবে লিখে রেখে গেছেন। তাঁর বইয়ের মজার দিক হলো, বইটিতে বারো ভুঁইয়াদের সাহস এবং যুদ্ধকৌশলের বর্ণনার পাশাপাশি তাদের সুশিক্ষিত হাতিগুলোর বর্ণনা এবং বীরত্ব স্থান পেয়েছে। ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ, কেননা সাধারণত যুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনায় কখনো সৈন্যদলে কিংবা ব্যবহৃত প্রাণীদের গল্প ঠাই পায় না। মাহবুব আলম ইতিহাসের এই অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকটিতে আলো ফেলতে চেয়েছেন। তিনি মির্জা নাথানের বইটিকে প্রামাণ্য ধরে নিয়ে বারোভুঁইয়াদের হস্তি-বাহিনীর বিখ্যাত সদস্যগুলোকে নাম ধরে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, যুদ্ধকৌশলের প্রশংসা করেছেন। লেখকের এই অধ্যায়টি আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে, আরো হাজারো অজানা রত্ন লুকিয়ে আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়, শুধুমাত্র উত্তোলনের অপেক্ষায়। আমাদের ইতিহাসবিদগণ সেদিকে নজর দিবেন- এই আশায় রাখি। মানব ইতিহাসের নানা বিচিত্র কারণে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। সেগুলোর সাথে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাদা হাতির জন্য যুদ্ধও যুক্ত করা যায়। ভেবে অবাক হতে, দুর্লভ সাদা হাতিটি কব্জায় আনার জন্য মোঘলেরা বছরের পর বছর আরাকান রাজ্যের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। লেখক এই বিচিত্র ঘটনাটি আমাদের সামনে উপস্থিত না করলে তা হয়ত অজানাই থেকে যেত। ওই সাদা হাতিটি দখলের জন্য সম্রাট বাংলার মোঘল সুবাদারদের লিখিতভাবে তাড়া দিয়েছেন। আরেক মোঘল সম্রাটের কাহিনী এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তিনি হলেন সম্রাট শাহজাহান। যুবক বয়সে পিতা সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে শাহি শাহি সৈন্যের সাথে যুদ্ধ করে উড়িষ্যা দখল করেন। এরপর অনেক পরিকল্পনা করে বাংলা সুবাহ দখলে অভিযান পরিচালনা করেন এবং সফল হন। শাহজাহানের ঢাকায় অবস্থানকালে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এবং প্রশাসনিক রদবদলের খবর আমাদের জানিয়েছেন লেখক। ইংরেজ আমলে বাংলার বণিক-শ্রেণি সহসাই উপলব্ধি করতে পারে যে, ইংরেজদের সাথে ব্যবসা পরিচালনা করতে এবং মুনাফা অর্জনের জন্য ইংরেজি ভাষাটা দখলে আনতেই হবে। যেহেতু বাংলাই ছিল উপমহাদেশে ইংরেজদের দখলকৃত প্রথম ভূমি, সেহেতু বলা যায়- বাংলা মুলুকেই সর্বপ্রথম ইংরেজি ভাষা শেখার চল শুরু হয়। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে সাহেবদের সাথে মৌখিক যোগাযোগ শুরু হয় কলকাতায়। লেখক জানাচ্ছেন, কলকাতার উচ্চবিত্ত হিন্দু পরিবারগুলোই সর্বপ্রথম শিক্ষকদের কাছে ইংরেজি শিক্ষার জন্য তাদের সন্তানদের পাঠাতে শুরু করে। এই বর্ণনায় লেখক, উপমহাদেশে ইংরেজি প্রচলন এবং প্রথম দিকের শিক্ষকদের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। পরবর্তী অধ্যায় ‘বাঙালির বাবু ইংলিশ’এ উনিশ শতকে ভারত জুড়ে তৈরি হয়ে যাওয়া এক ধরনের ইংরেজি ভাষার বিবরণ দেয়া হয়েছে যা তৎকালীন ইংরেজ মহলে এবং চায়ের আড্ডায় হাস্যরসের জোগান দিয়েছিল। এই অধ্যায়টি ‘গুপ্তধনের খোঁজে’ বইয়ের সবচেয়ে সরস এবং মজার অধ্যায়। ইতিহাসের অনেক দিক আছে, যা আপাতদৃষ্টিতে এমনই তুচ্ছ যে, একাডেমিক ঐতিহাসিকদের রচনায় এযাবৎ খুব কমই ধরা পড়েছে। কিন্তু এসব গল্প যেমন সাধারণ পাঠকের মনোরঞ্জন করতে পারে, তেমনই ইতিহাসের প্রতি আগ্রহটা আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। আলোচ্য গ্রন্থে লেখক মাহবুব আলম বাংলার ইতিহাসের নানা যুগের বিভিন্ন ঘটনা মনোরমভাবে বর্ণনা করেছেন যা সচরাচর ইতিহাস গ্রন্থে দেখা যায় না। এই বইয়ের প্রতিটি অধ্যায় তথ্যপূর্ণ এবং উপভোগ্য। এই বইয়ে ইতিহাসের যেসব মজার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তা মূলধারার ইতিহাসে প্রায় নেই বললেই চলে। ইতিহাসের বালুচর ঘেঁটে এমন সব নুড়ি-পাথর তুলে আনার জন্য লেখক মাহবুব আলম ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন পাবার যোগ্য।
Was this review helpful to you?
or
ইতিহাস নিয়ে বহু পুরোনো কথা এই যে ‘ইতিহাসে পরাজিত মানুষের কথা লেখা থাকে না।’ তবে সাব অলটার্নবাদীরা এখন নানা তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এই কথাকে এক রকম ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন। সমাজ-সভ্যতার গলিপথে ঢুঁ দিয়ে দেখিয়েছেন, জয়-পরাজয়ের বাইরে ইতিহাসের অন্য উঠোনও আছে। সেই উঠোনে দাঁড়িয়ে মাহবুব আলমের গুপ্তধনের খোঁজে বইটি পড়তে গিয়ে পাওয়া গেল ইতিহাসের মধ্যে আলো-আঁধারে থাকা পার্শ্ব ইতিহাসকে। যেমন, বাংলার স্বাধীন সুলতান শিহাবুদ্দিন বায়েজিদ শাহ চীনের মিং সম্রাট ইয়োং-লোকে একটি জিরাফ উপহার পাঠিয়েছিলেন—এই সাদা-কালো তথ্যকে উপজীব্য করে ‘বাংলার সুলতান, চীনের সম্রাট, আফ্রিকার জিরাফ’ নামে বইয়ের প্রথম প্রবন্ধে তিনি যেমন চৈনিক সভ্যতার সঙ্গে বাংলা মল্লুকের যোগাযোগকে খোলাসা করেছেন, তেমনই চীনের ধর্ম-দর্শন, সংস্কারগুলোও অলিখিত থাকেনি। কেবল এই রচনাতেই নয়, বইয়ের ১২টি প্রবন্ধেই ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের অনালোচিত টুকরা টুকরা নানা প্রসঙ্গ, পার্শ্ব ইতিহাস। বইটির শিরোনামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি পঙিক্ত, ‘ইতিহাসের বিচিত্র সরস কাহিনি’। হ্যাঁ, ‘বিচিত্র সরস কাহিনি’ই বটে! তাই তো ‘বিদ্রোহী যুবরাজ শাহজাহান ঢাকায়’ শীর্ষক রচনায় জানা যাচ্ছে, মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর বিদ্রোহী পুত্র শাহজাহানকে ‘বিদৌলত’ বা ভাগ্যহীন নামে সম্বোধন করেছিলেন। অথবা ‘নিজের চরকায় তেল দাও’ শিরোনামে লেখায় এই প্রবাদটি নিয়ে কথা পাড়তে পাড়তে লেখক যখন বলে যান বাঙালির চরকা-কাহিনির আদ্যোপান্ত ও সমাচার দর্পণ-এর বরাত দিয়ে শান্তিপুরের এক অসহায় চরকা-কাটুনির প্রসঙ্গও যখন অনুল্লিখিত থাকে না, তখন বইটিকে অন্য রকম সম্মান না দিয়ে উপায় কী! লেখক মাহবুব আলম ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন দীর্ঘদিন। বইয়ের মুখবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘পাঠ্যবইয়ের গণ্ডি পেরিয়ে প্রশস্ত রাজপথ ছেড়ে শুরু হলো ইতিহাসের মেঠোপথে ঘুরে বেড়ানো।... হাঁটতে গিয়ে চোখে পড়ে দেখা না-দেখা নানা চরিত্র, জানা যায় নানা তুচ্ছ কাহিনি, যার ভেতর বিগত দিনের মানুষ, সমাজ ও সংস্কৃতি ভেসে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন ইতিহাসের চূর্ণ।’ ‘ইতিহাসের চূর্ণ’ হাতড়াতে গিয়েই যেন-বা তিনি পেয়েছেন গুপ্তধন। রচনা করেছেন গুপ্তধনের খোঁজে। এই বইয়ে ইতিহাস উঠে এসেছে অনেকটা গল্পের আদলে। সেই সঙ্গে লেখকের অনুপম ভাষাভঙ্গি একে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক, ‘নিজের চরকায় তেল দাও’ প্রবন্ধে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের কারণে বাংলার চরকাজীবীদের দুরবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘সেখানে কলের যুগ শুরু হওয়ায় সুদূর বাংলার সুতা-কাটুনিদের ভরা জোয়ারের সংসারে মরা কটাল নেমে এল।’ বিষয়বস্তু, তথ্য-উপাত্ত এবং বয়ানকৌশল—সব দিক থেকে গুপ্তধনের খোঁজে গ্রন্থটি পাঠককে প্রকৃতই গুপ্তধনের খোঁজ দেবে।