User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
ভ্রমণ ভালোবাসেন না কিংবা করতে পছন্দ করেন না এমন মানুষ নেই বললেই চলে। নিতান্ত বেরসিক মানুষও ভ্রমণের গন্ধ পেলে নড়েচড়ে বসেন। তাই তো ফি বছর প্রকাশিত হচ্ছে প্রায় শ’ খানেক ভ্রমণবই। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি দৈনিকের পত্রিকার আলাদা করে বেড়ানো পাতা আছে। আছে পর্যটনবিষয়ক আলাদা পত্রিকাও। যা কিনা ভ্রমণের জনপ্রিয়তারই নির্দেশক। ‘পেশাদার’ পর্যটক এবং সৌখিন পর্যটকরা ভ্রমণ করে এসে ‘দেখা’ কাহিনী লিপিবদ্ধ করেন। এর বাইরে আরেকটি শ্রেণি আছেÑভ্রমণলেখক। যারা ভ্রমণকাহিনী লেখার জন্যই ভ্রমণ করেন (অবশ্য এঁরা সংখ্যায় কম)। সৈয়দ মুজতবা আলীর পর হালে খ্যাতিমান লেখকরাও মনোযোগ দিয়েছে ভ্রমণসাহিত্য রচনায়। সত্যিকার অর্থে ভ্রমণবৃত্তান্ত প্রাণ পায় কবি-সাহিত্যিকের হাতেই। সাধারণ পর্যটকের দেখার দৃষ্টি আর কোনো শিল্পীর দৃষ্টি, অনুভবে যোজন যোজন পার্থক্য। কোনো কবি যদি ভ্রমণকাহিনী লেখেন তবে তো তা হয়ে ওঠে অনন্য সৃষ্টি। খ্যাতনামা কবি আসাদ চৌধুরীর লেখা ‘এ ভ্রমণ আর কিছু নয়’ এমনই একটি বই; যার প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে রয়েছে কবিতার ঘ্রাণ, কাব্যিক অনুভূতি, সুসজ্জিত কথার পঙ্ক্তিমালা। কবিতা পড়ার সূত্র ধরে দেশের বিভিন্ন জনপদে একাধিকবার গিয়েছেন লেখক, সুযোগ পেলে এখনো যানÑচোখ দিয়েই কর্ষণ করতে চান সুজলা-সুফলা বাংলা। বিদেশের মধ্যে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, মার্কিন য্ক্তুরাষ্ট্র, ভারত, নেপাল, ভুটান প্রভৃতি দেশে গিয়েছেন। কিন্তু স্বদেশ তাকে টানে মন্ত্রমুগ্ধের মতো। এদেশের মফস্বলেই রয়েছে তাঁর প্রাণগাঁথা। তাইতো কবি আবুল হাসানের পঙ্ক্তি থেকে এ বইয়ের নামকরণ করেছেন, ‘এ ভ্রমণ আর কিছু নয়।’ এই ‘তুমি’টা কে! মা? মাটি? বিশ্ব? সৃষ্টিকর্তা? প্রেমিকা? নাকি অন্যকিছু! উত্তর যা-ই হোক, আমরা ধরে নিই, এই ‘তুমি’টার নাম ভ্রমণ। সেই ভ্রমণ এবার নিসর্গে হোক কিংবা কাঠখোট্টা কোনো স্থানে। বইটিতে লেখক ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন ‘ভ্রমণ সংক্রান্ত’, ‘বেড়ানোর আগে’, ‘এলেম নতুন দেশে’, ‘জার্মানিতে পুনরায়’, ‘এ ভ্রমণ আর কিছু নয়’, ‘ওপারে সেই বাংলা’, ‘দার্জিলিং’, ‘প্রবাসে দুটি স্মরণীয় ঈদ’, ‘ফোবানা স্মৃতিকথা’, ‘চট্টগ্রামে প্রথম যে-দিন’, ‘ফেনায় ফেনায় আলোর নাচন’, ‘কেবল তোমার কাছে যাওয়া’ শিরোনামে মোট ১২টি রচনা। অবশ্য ১২টি রচনা না বলে ১০টি রচনা বললেও খুব একটা হেরফের হবে না। ভূমিকাতে লেখক বইটির জন্মবৃত্তান্ত তথা ভ্রমণ, ভ্রমণকাহিনী ইত্যাদি সম্বন্ধে জানিয়েছেন। তারপর লিখেছেন দুটি রচনাÑ‘ভ্রমণ সংক্রান্ত’ ও ‘বেড়ানোর আগে’। এ দুটি রচনাকে ভ্রমণকাহিনী না বলে পড়ার জন্য পাঠককে প্রস্তুত করা বললে সত্যের অপলাপ হবে বলে মনে হয় না। হয়তো লেখক মূল লেখায় ঢোকার আগে পাঠককে একটু প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন! কবিতার পঙ্ক্তি ভেঙে শিরোনাম দেয়া বইটির লাইনে লাইনে উপলব্ধি করা যায় এর প্রতিটি কথা যেন কবিতারই আরেক রূপ। আসাদ চৌধুরী গদ্য মানেই যেন বিপন্ন বিস্ময় এক। আটপৌরে কিন্তু অলৌকিক শব্দচয়ন। চমক জাগানিয়া ব্যাপ্তি, গভীরতা প্রখর। কম শব্দে গভীর ভাব প্রকাশ করার বিরল মতা রয়েছে তাঁর। পরিমিতি বোধ এবং যথার্থ শব্দচয়নে তাঁর তুল্য লেখক কমই আছে বাংলা সাহিত্যে। এ বই নতুন করে আবার তা স্মরণ করিয়ে দেয়। পাতায় পাতায় কবিতার উপমা, অলঙ্কার, আধুনিক ভাষাশৈলীর কোমল-মনোরম গাঁথুনি যে কোনো সাহিত্যপ্রেমীকে আটকে রাখবে, যতণ না বইয়ের শেষ শব্দটিও পড়া শেষ হয়! অসামান্য মুন্সিয়ানায়, কখনো বা সখেদেÑমারমুখী ভঙ্গিতে, আবার কখনো উৎফুল্ল মেজাজে স্বদেশ এবং প্রবাসজীবনের রকমারি ঘটনা, মধুর ও তিক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। ভয়েস অব জার্মানির বাংলা বিভাগের সম্পাদক থাকাকালে জার্মানিতে ঘটে যাওয়া সে সব মধুর, মজার স্মৃতিকথা একেবারে স্পষ্ট কবিতার আলোকে পাঠকের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে। বিমানবন্দরের নানা বিপত্তিতে পড়া এবং কৌশলে সে ঝক্কি থেকে উদ্ধার পাওয়ার অভিনব ধরন পাঠককে নির্মল আনন্দ দেবে। এসবের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে খ্যাতিমানদের ‘মুখ’ দেখার আনন্দ। দেশ-বিদেশে ছড়া-কবিতা পাঠ করতে গিয়ে অনেক খ্যাতিমান সাহিত্যিকের সঙ্গ নিয়েছেন, দিয়েছেনও। দেশের নামকরা ছড়াকার ও কবিদের সাথে লেখকের আড্ডার প্রাঞ্জল বর্ণনা চোখের সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে যেন। বহু চেনাজানা মুখগুলো চোখের সামনেই হেঁটে যায় যেন। ‘ফেনায় ফেনায় আলোর নাচন’ রচনাটি শুরু হয়েছে এভাবে- প্রতিদিন সূর্যাস্ত এখানে সম্পূর্ণ নতুন। আগের দিনের মতোন নয়। আগের কোনো একটি বিশেষ দিনের মতোও নয়। আকাশের চেহারা নতুন। প্রতিটি সূর্যাস্তের এমন রূপ, এমন মহিমা, এমন ঐশ্বর্য একমাত্র কক্সবাজারই উপহার দিতে পারে। কক্সবাজার ভ্রমণ নিয়ে এ কাহিনীর সূচনাই এমন পাঠক স্তম্ভিত না হয়ে আর থাকতে পারে না। এমন করে বলবার ভঙ্গি, এমন অভিনব বর্ণনা একজন প্রকৃত, প্রাজ্ঞ কবির পইে সম্ভব। বিদগ্ধ সাহিত্যিক আসাদ চৌধুরী যে নিজস্ব একটা গদ্যভঙ্গি আবিষ্কার করেছেন তা পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে। ‘এলেম নতুন দেশে’ রচনায়ও মেলে ‘অশ্রুত’ এক গদ্যভঙ্গির- অপো যে কতোটা কষ্টকর, তা প্রেমিক-প্রেমিকারা যতটা জানেন, তার চেয়ে আমার জানাটাও কম নয়। বীরবল পড়া শেষ হলো তখন যাত্রীদের বিমানবন্দরে কর্তব্যরত কর্মীদের চেহারা পাঠ করা ছাড়া সত্যি সত্যি পড়ার কিছু ছিলো না। জার্মান রেডিও ডয়চে ভেলে-র বাংলা বিভাগে যোগদান করতে লেখকের এই বিমানযাত্রা। এ যাত্রায় পথিমধ্যে যে বিড়ম্বনা, বিশেষ করে বিমানবন্দরে তা ছত্রে ছত্রে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। তাঁর বিরক্তির পরিমাণ মাত্রাধিক। এই বিরক্তির মাঝেও পাঠক ঠিকই আনন্দ খুঁজে পাবেন। জার্মান যাত্রার আরেকটি কাহিনী বিধৃত হয়েছে- ‘জার্মানিতে, পুনরায়’। এ ভ্রমণ অবশ্য প্রথমটির তুলনায় সম্পূর্ণ বিপরীত। এবার আর চাকরির সুবাদে নয়, তিন বছর পর লেখক বেড়ানো জন্যই গিয়েছেন জার্মানি। বাঙালিদের সাথে দেখা, আড্ডা, গল্পগুজব, বইমেলা, জাদুঘর গমন ইত্যাদি বিধৃত হয়েছে এ রচনায়। প্রবাসে বাংলাদেশিদের কর্মযজ্ঞ, জীবনধারা, সাহিত্য-সংস্কৃতি স্মৃতি রোমন্থনের অনুপুঙ্খ বয়ান ফুটে উঠেছে। ‘ওপারে সেই বাংলা’ ভারত ভ্রমণের গল্প। সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণ করতে ভারত ছড়াকার রফিকুল হক দাদুভাই ও আসলাম সানী; অন্য আরো বেশ কয়েকজনের মতো আসাদ চৌধুরী এঁদের সহযাত্রী। আসাদ চৌধুরী যে মাঝে-মধ্যে ‘উথালপাথাল গদ্য’ গদ্য লিখে পাঠকের আক্কেলগুড়–ম করে দেন তার নজির পাওয়া গেলো আবারÑ ... না, আম কিনিনি, তবে জামরুল (আমাদের গ্রামে বলে আমরুজ) আর আশফল কিনলাম। একা একা বাম হাতের চেটোয় লবণ, আর ঠোঙা থেকে জামরুল নিয়ে খেতে খেতে এগোচ্ছি- হঠাৎ মনে পড়লো, পাজামা তো নেই, পাজামা কিনতেই হবে। দোকানে ঢুকলাম, কাউন্টার নেই, তক্তপোষে বসা দুটি মেয়ে পরোটা-গোশত খেয়ে উঠে এইমাত্র, ভদ্রলোক একেবারেই লখনৌ ঘরানার, মেয়ে দুটিও পাজামার বন (দড়ি) ভরে দিলেন, কিন্তু জামরুল নিলেন না। এ লেখা পুরো তিন ফর্মার, আলাদাভাবে সাড়ে তিন বা চার ফর্মার বইও হতে পারতো। দুই বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি, লেখক-কবিদের আড্ডা আর হৃদ্যতায় ভরপুর সুদীর্ঘ লেখাটি শেষ হলেও যেন আরো পড়ার তৃষ্ণা থেকেই যায়। শুধু এটার কথা বললে ভুল হবে, গ্রন্থভুক্ত প্রতিটি লেখাই মজাদার, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। আসাদ চৌধুরীর ভ্রমণ মানেই যেন একের ভেতর অনেককিছু! এ ভ্রমণ আর কিছু নয় আসাদ চৌধুরী প্রকাশক : উৎস প্রকাশন প্রচ্ছদ : সব্যসাচী হাজরা দাম : ২০০, পৃষ্ঠা : ১৭৬