User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
আহমাদ মোস্তফা কামাল-এর গল্পগ্রন্থ "অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না বলে"- নিয়ে এক লেখায় সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছেন, "কামালের গল্পগুলি পড়লে ক্যার্নিভালের মতো বহুবিচিত্র একটি জগৎ, তার পলিগ্লোসিয়া- বহু-কণ্ঠ গভীর সব দ্যোতনা, প্রতীক, অ্যাবসার্ড, পরাবাস্তব মনের ভেতর হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দেয়।" বই-এর প্রথম ফ্ল্যাপে কথাগুলো লেখা আছে। গুণী সাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম- এর কথাকে প্রলম্বিত করার প্রয়োজন নেই। আমরা বরং গল্পগুলোর গভীরে প্রবেশ করি। এই সংকলনের জন্য যে সাতটি গল্প প্রখ্যাত লেখক আহমাদ মোস্তফা কামাল বেছে নিয়েছেন সেগুলোর মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে নাগরিক জীবন, বিচ্ছিনতাবোধ, প্রেম, দাম্পত্য সম্পর্ক, সামাজিক লোকাচার, পারিবারিক মূল্যবোধ, ভাঙন এবং সামাজিক সম্পর্ক বির্নিমাণের কথাচিত্র। “অপেক্ষা” গল্পটির কাহিনী লেখক খুব ধীর লয়ে উপস্থাপিত করেন। পদ্মা তীরবর্তী একটি গ্রামীণ পটভূমিকায় কিছু আটপৌরে মানুষের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে প্রথমে। সর্বগ্রাসী পদ্মা তলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটি জনপদ। গ্রামের মানুষগুলো সহজ-সরল, ধর্মান্ধ এবং নানান অলৌকিক বিশ্বাসে বলিয়ান। ভূ-প্রাকৃতিক কোনো কারণ নয়, মানুষগুলো বিশ্বাস করে নদীর ভাঙনের পেছনে নবীর কেরামতি, মানুষের দ্বারা সংঘঠিত পাপ-ই দায়ী। পাপ থেকে বিরত থাকলে পদ্মা ভাঙবে না এবং এজন্য ত্রাতার ভূমিকাও পালন করবেন নবী- এ-ধরনের উপলব্ধিতে তারা প্রার্থনা, মোনাজাতে মনোনিবেশ করে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ গরিব, এদের মাঝে বিশিষ্ট নাগরিকের মতো একটি পরিবার বসবাস করে, যাদের আদি বাড়ি অন্যত্র হলেও প্রায় শতবষকার্ল ধরে এই অঞ্চলে বসবাস করার কারণে গ্রামের লোকজনও প্রায় বিস্মৃত যে, তারা এখানকার নয়। গ্রামের মানুষ এই পরিবারটিকে মান্য করে, সম্মান করে। এই পরিবারটি গ্রামে নিয়মিতভাবে বসবাস করে না। তারা শহরে বসবাস করে। তাদের বাড়ি পাহারায় থাকে আশ্রিত মিনহাজ বা মিনা। পূর্বপরুষ ধর্মীয় শিক্ষা এবং ভাবাদর্শে দীক্ষিত হলেও উত্তরপুরুষ শহরে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে। পারিবারিক ধর্মাদর্শ এবং আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা তাদের উপলব্ধিতে পরিবর্তন আনে যা আমরা এ-পরিবারটির একজন সদস্যের মুখে পদ্মার ভাঙনের ভূ-প্রাকৃতিক কারণ উল্লেখে দেখতে পাই। এতদিন ধরে গ্রামের অসংখ্য বাড়ি পদ্মাগর্ভে বিলীন হয়েছে এবার সর্বগ্রাসী পদ্মা যখন এই আলোচিত বাড়ির দরজায় উপস্থিত হয় তখন লেখক পাঠকের কাছে তার কথকের মতো বয়ান ভঙ্গি পরিবর্তন করে উত্তম পুরুষে আবির্ভুত হন। যিনি বাড়ি ভাঙনের ফলে বাপ-দাদার কবর, সমস্ত স্মৃতিচিহ্ন বিলীন হবার সকরুন আশংকা পাঠকের কাছে তুলে ধরেন। বাড়ি ভেঙে গেলে মানুষের জীবন কীভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে সেটি কয়েকটি পঙতিতে তুলে দেয়া যাক- “এই হারানোর কষ্ট কাউকে বোঝানো যাবে না। যার বাড়ি নেই, তার আসলে কিছুই নেই। আমাদের আর কোনো স্থায়ী ঠিকানা থাকবে না এখন থেকে, ফেরার কোনো জায়গা থাকবে না- এ যে কী প্রবল নিঃস্বতা, কে-ই বা তা বুঝবে? হয়তো কালই বাবার কবরটা চলে যাবে নদীতে। মনে হচ্ছে এতদিন পর সত্যিই বাবাকে হারাচ্ছি আমরা। ” এই বেদনাবোধ পাঠককেও যখন শোকাতুর করে তোলে তখনই একটুকরো বিশ্বাস ফুটিয়ে তোলেন লেখক। তিনদিন ধরে আটকে থাকা ভাঙন ঠেলে বাড়িটি কী টিকে যাবে? এমন একটি আশার দোলাচলে গ্রামের মানুষেরা এবং পাঠকও যখন দুলতে থাকে, তখনই আলৌকিক ঘটনা ঘটার সমস্ত সম্ভাবনাকে বিদায় করে দিয়ে একটু একটু করে পদ্মা গর্ভে হারিয়ে যেতে থাকে বাড়িটি। বাড়ির লোকেরা চলে গেছেন। আশ্রিত মিনহাজ, মতান্তরে মিনা খা খা বাড়িতে একা। রাত বাড়ে। বৃষ্টি আর বাতাসের তোড়ে ঘুমাতে পারে না মিনা। প্রবল কাশিতে ভেঙে যাচ্ছে তার বুক। তবু বসে বসে বিড়ি টানতে থাকে মিনা। টানে আর ভাবে, বাড়িতো ভেঙে যাচ্ছে, এবার সে কোথায় যাবে! গল্পটি শেষ হয়, মিনার স্বগত রাগী সংলাপে। সাপ-শাপান্ত করতে করতে মিনা পদ্মাকে বকে। গালিগালাজ করে। সে কাঁদে আর বলে পদ্মাকে উদ্দেশ্য করে বলে- “ক তুই। আমারে চাস, আমারে খাইতে চাস, আমারে খাইলে তোর প্যাট ভরবো, ক’রে মাগী, তুই আমারে খাইতে চাস? গল্পটিতে যেমন গ্রামীণ সংকট, দারিদ্র, অসহায়তার ছবি আছে তেমনি কুসংস্কারাচ্ছন, অন্ধ বিশ্বাসের ছবিও দেখতে পাই। নদীর ভাঙনের করুণ রূপ চিত্রিত করার পাশাপাশি লেখক তা থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য কার্যকর বাধ নির্মাণের উপযোগিতার প্রতি মানুষের আগ্রহী হবার পরিবর্তে নবী-রাসুলের কাছে দোয়া, প্রার্থনার চিত্র তুলে ধরে অনগ্রসরতার বাস্তব চিত্রটি চিত্রিত করেছেন। ছোট ছোট কিছু পরিস্থিতি সৃষ্টি করে গ্রামের মানুষদের বিশ্বাস, ধর্মবোধের তুলনারহিত একটি ছবিও লেখক অসাধারণ সংযমের সঙ্গে ফুটিয়েছেন। “ঘুমায়ে পড়িব আমি”- এটি স্মৃতিচারণের গল্প। গল্পটি একটি নিঃসঙ্গ যুবকের। ক্রমশ যে তার আত্মীয়-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হতে একদম একা হয়ে গিয়েছে। প্রথম দৃশ্যে তাকে হাসপাতালের বেডে শুয়ে তীব্র মৃত্যুচিন্তায় আক্রান্ত হিসেবে দেখতে পাই। উত্তমপুরুষে এরপর সে তার কথা বলতে থাকে। সচরাচর যাকে আমরা সামাজিকতা বলে জানি এই যুবক সেসবের বাইরের একটি জীবন, যাকে বলে- অসামজিক জীবন, সেটি যাপন করে যায়। খুব নরোম, কোমল মনের চরিত্রটির ছোটবেলা থেকে প্রিয়তার বস্তু ছিলো একটি অবোধ প্রাণী- ছাগল। ছাগলটিকে তার সমস্ত আনন্দ-বেদনার সঙ্গী করে নেয় সে। হঠাৎ পারিবারিক সিদ্ধান্তে ধর্মীয় উৎসবে বলি দিতে হয় প্রাণীটিকে। যখন এই কোরবানীর কাজটি হয়, আজকের যুবক, সেই কিশোরটি একদম ভেঙে পড়ে। এরপর তার পিতা তাকে আরেকটি ছাগল কিনে দেয়। সেটিকে নিয়ে সে আবার আগের মতো মেতে ওঠে। একসময় এই প্রাণীটিকেও হারিয়ে ফেলে সে। আবার সে বিষণ্নতায় কাতর হয়ে পড়ে। এইযে, আকড়ে ধরা, বলিদান, আবার আকড়ে ধরা, শেষাবধি হারিয়ে যাওয়া, দৃশ্যগুলো জোড়া দেয়া হলে মানুষবেষ্টিত এই পরিচিত এবং চেনা জগত ভিন্ন অন্য একটি জগতের সাথে পরিচয় ঘটে আমাদের। সামাজিক মানুষের আত্মীয়-পরিজনময় যে জীবন, কিশোরটিকে দিয়ে লেখক সেটি ভিন্ন আলাদা একটি সংশ্রবের চিত্র তুলে ধরেন। গল্পটি পড়ে বারবারই আমাদের আলব্যের কামুর- দ্য আউটসাইডার-এর কথা মনে পড়ে যায়। এর নায়ক ম্যোরেস প্রচলিত রীতিনীতির বাইরের মনস্তত্ব নিয়ে বেড়ে ওঠে। তার আচরণ এতটাই নৈর্বক্তিক যে, পাঠক অপ্রচলিত একটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। কাম্যু পাঠককে ম্যোরেস-এর আচরণ আস্বাভাবিক নাকী স্বাভাবিক, এই প্রশ্নের মুখোমুখি করে দেন। আহমাদ মোস্তফা কামালও তাঁর গল্পের এই চরিত্রটিকে নার্সিসাস নয়, আবার স্বাভাবিকও নয় এমন রূপে চিত্রিত করে পাঠককে দ্বিধায় ফেলে দেন। শেষ দৃশ্যে দূরে চলে যাওয়া স্ত্রী নীলাকে যুবকের কাছে হাসপাতালে হাজির করিয়ে লেখক সমস্ত দ্বিধার উত্তরও দিয়ে ফেলেন। যুবক স্ত্রীর আগমনে তার নিয়মমাফিক বিষণ্নতা, বিচ্ছিন্নতার কথা ভুলে যায়। আমরা তখন একটি অভিনব অভিজ্ঞতার সম্মুখিন হই। লেখক তাঁর আশ্চর্য মেদহীন কলমে লেখেন- “দেখা হলো- কেন ও কীভাবে এই দুঃসহ পৃথিবীতে মানবিক সম্পর্কগুলো টিকে থাকে, কেন ও কীভাবে এই অর্থহীন জীবনের জন্যেও মানুষ এমন মমতা বোধ করে, এই ভেবে আমি আবার খুশি হয়ে উঠলাম। এবার তাহলে বলা যায়-দেখে গেলাম ! এবার তাহলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়া যায় !” পরের গল্পটি দাম্পত্য প্রেমের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে আরম্ভ হয়েছে। গল্পের নাম- “এটা কি কোনো গল্প হতে পারতো?” ছোট ছোট সাবটাইটেল দিয়ে কাহিনী বর্ণনের ভিন্ন একটি আঙ্গিক ব্যবহার করেছেন লেখক। সূচী আর জুবায়ের ইকবাল, দুই যবক-যুবতীর বিয়ের ঘটনাটিকে নাটকীয় ভঙ্গিতে তুলে ধরে গল্পের ফোকাস আর সেখানে রাখেন নি তিনি। গল্পের যে মূল গল্প সেখানে আর দম্পতিটি নেই। গল্পের চরিত্র জুবায়ের নিজেও একজন লেখক। স্ত্রীকে একদিন গল্পচ্ছলে জুবায়ের ইকবাল এক যুবক- যার নাম সজল- তার গল্প শোনাতে গিয়ে তাৎপর্যময় একটি জীবনের গল্প শোনান। এক প্রতিবাদী যুবক-সজল, প্রচলিত রাজনীতির নষ্ট ফসলের প্রতিবাদ করতে গিয়ে জেল খাটে। জেলে যাবার আগে তার একটি সুন্দর জীবন ছিলো, স্বপ্ন ছিলো, প্রেম ছিলো। জেলের জীবন তার জীবন থেকে সবকিছু তিরোহিত করে, তাকে নিঃস্ব-রিক্ত করে দেয়। যাবজ্জীবন জেল খাটার জায়গায় অলৌকিকভাবে ছয় বছর জেল খেটে বাইরে বেরিয়ে সে দেখে তার কেউ নেই। স্বাভাবিক জীবন, প্রেম কিছু নেই। কিন্তু স্বপ্ন! সেটিও আর দেখেনা সে। নষ্ট রাজনীতি, নেতা এসবের দুষ্টচক্র ভেদ করে দেশটাকে তার কারাগার মনে হয়। সে এই কারাগার ভাংতে চায়। কিন্তু সেটি তো সম্ভবপর নয়। তবু উল্টোস্রোতের মতো সে ভেসে বেড়ায়। একসময় সে অপ্রকৃতস্ত হয়ে যায়। এরপর গল্পকথক জুবায়ের ইকবাল স্ত্রীর কাছে সজল সম্পর্কে নিশ্চুপ হয়ে যায়। পাঠকও কৌতুহলী, স্ত্রী সূচীও। জুবায়ের ইকবাল তখন জানান, এ-গল্প যে সজলের সে আত্মহত্যা করেছে। সজলের সব কিছু নাটকীয় বলে জুবায়ের এ-গল্প লিখতে পারেনি। কারণ, লেখক জুবায়ের ইকবাল তার পাঠককে নাটকীয়তার কুহেলিকা নয়, বরং বিশ্বাসযোগ্য গল্পের স্বাদ দিতে চান। সজল এমনই স্বপ্নভুখ, প্রতিবাদী যুবক ছিলো তার সব ঘটনাই পাঠকের নাটকীয় মনে হবে। তাই এ-গল্প জুবায়ের কখনোই লিখে নি। অনিয়ম আর কু-আচারের এই দেশে সবাই যখন নিয়মমাফিক মেনে নেয়ার জীবন বেছে নিয়েছে সেখানে আশ্চর্য ব্যতিক্রম সজলের গল্প বলা শেষে জুবায়ের ইকবাল অবোধ কান্নায় ভেসে যায়, স্ত্রী সূচীও গল্পের শ্রোতা হয়ে চোখের জল লুকোতে পারে না। সূচীর চোখের জলে ভেসে যায় জুবায়েরর ইকবালের বুক। বিপ্লবী যুবক সজলের জন্য অশ্র“ লের এই বিসর্জন পাঠককের মনকেও বেদনাহত করে। "মেয়েটি প্রেম ও মুক্তি একসঙ্গে চেয়েছিল" গল্পটিকে প্রেমের গল্প বলা যায়। অথবা প্রেম এবং অপ্রেমেরও। এই গল্পটিও উত্তম পুরুষে শুরু করা। মূলত সেভাবেই গল্পের ফ্রেম দাঁড়িয়েছিল। তারপর দুটি চরিত্রের সন্নিবেশ গল্পটিকে নীরিক্ষার দিকেই নিয়ে যায়। বলা যায়, সফল একটি নীরিক্ষার গল্প একটি। কাহিনি সংক্ষেপ এমন- প্রধান চরিত্র- নাম কামাল, একজন লেখক। এক বৃষ্টিমুখর মধ্যরাতে লেখকের কবিবন্ধু আহসান হঠাৎ তার বাড়িতে উপস্থিত হয়। তার আসার কারণ-একটি ডায়েরি হস্তান্তর। আহসান নামক কবিবন্ধুটি প্রাক্তন প্রেমিকার উদ্দেশ্যে লেখা ডায়েরিটি লেখকের তুলে দিয়ে দিয়েই প্রস্থান করে। লেখক এরপর এই ডায়েরি নিয়ে কী করেন? এই গল্পই পরের গল্প। মেয়েটি ছিল এক বিবাহিতা নারী। আহসান তার প্রতি নিজের প্রচন্ড প্রেমানুভূতি অসাধারণ সব কথার মাধ্যমে তুলে ধরেন পর পর কয়েক পাতায়। এরপর ঘটে তাদের বিচ্ছেদ। কিন্তু কেন এই বিচ্ছেদ? এটি জানা যায় মেয়েটির কাছ থেকে। আহসানের সেই বন্ধু মেয়েটিকে একদিন খুঁজে পায়। তার অনিন্দ্যসুন্দর রূপের বর্ণনার পর লেখক এবার মেয়েটির মুখেই তার গল্প পাঠকের কাছে তুলে ধরেন। জানা যায়, মেয়েটির বিয়ের আগেই একজন প্রেমিক ছিল। আহসানের কাছ থেকে মেয়েটির হৃদয়ের মুক্তি ঘটে। বিয়ের পর স্বামীর সাথে একঘেয়ে জীবনে মেয়েটি যখন ক্লান্ত তখন দেহের মুক্তির জন্য সে আহসানের দারস্থ হয়। একইসাথে একাধিক সম্পর্ক স্থাপন তার কাছে যৌক্তিকও মনে হয়। কিন্তু আহসান সেখানে অংশগ্রহন করে না। মেয়েটি এবার তার পুরনো প্রেমিকের কাছে যায়। কিন্তু এক পর্যায়ে লক্ষ্য করে সবাই তাকে দখলে রাখতে চায়। দখল নিতে চায়। সে সিদ্ধান্ত নেয়, কারো দখলেই থাকবে না। এবং সবাইকে ছেড়ে যায়। এই ছেড়ে যাবার ঘটনাগুলো উপস্থাপন করে মেয়েটি জানায় - এতে সে সুখি আছে। গল্পটি এখানেই শেষ। কিন্তু কুশলী লেখক আহমাদ মোস্তফা কামাল গল্পের শেষ লাইনে লেখক বন্ধুটির মেয়েটির সাথে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্যোগটি সুনিপুন ভাবে তুলে দেন। আমরা বুঝতে পারি, তিনি মেয়েটির প্রেমে পড়েছেন। প্রেম আর মুক্তিজনিত অসাধারণ এক তত্ত্ব উপস্থাপন করে গল্পটিতে প্রেম- অপ্রেম এবং সম্পর্কের নতুন সংজ্ঞা নির্মাণের অনবদ্য একটি প্রচেষ্টা আমরা দেখতে পাই। “কোথাও কিছু একটা ভেঙে পড়েছে” গল্পটি পিতৃহীন যুবক রফিককে নিয়ে। চাচার কাছে মানুষ হয়েছে রফিক। লেখাপড়ার তাগিদে শহরে থাকে। মোটামুটি আত্মীয়-পরিজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্নই থাকে সে। একদিন হঠাৎই বাড়িতে এসে উপস্থিত হয় রফিক। চাচা দীন মোহাম্মদ অবাকই হন, রীতিমতো দূরে সরে থাকা রফিক কেনো হঠাৎ বাড়ি এলো তা নিয়ে তার নানা আশঙ্কা, চিন্তার জাল বুননের এক পর্যায়ে দেখা যায়- বাড়ির আশ্রিতা, ভিখারী পরীর মা' সেদিনই মৃত্যুবরণ করেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায়ও রফিক বাড়ি আসেনি, সেখানে পরীর মা'র মৃত্যু এবং রফিকের বাড়ি আসা একটা ঘটনা হিসেবেই পরিলক্ষিত হয়। পাঠকের কাছে, মায় লেখকের কাছেও। গল্পের শুরু এভাবেই। এরপর আমরা জানতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া, উন্মুক্ত-স্বাধীন জীবন-যাপন রফিকের ভেতরকার সব সংস্কারকে- যেটি তার পরিবার যুগ যুগ ধরে লালন করে আসছিল সেটি থেকে বেরিয়ে নিয়ে আসে। রফিকের পরিবারটি যেখানে বংশ মর্যাদা নামক বিষয়টি নিয়ে আকড়ে থাকে সেখানে রফিকের সমস্ত সংস্কার ফেলে বদলে যাওয়া মানুষ হয়ে যায়। রফিকের জীবনাচার দিয়ে লেখক রাজনীতি, সামাজিক আচারনিষ্ঠতাকে এতটাই খেলো করে প্রদর্শন করেন যে, উপরের সুন্দর চেহারার ভেতরকার কদর্যরূপটি বারবার পাঠকের সামনে উপস্থিত হয়। পরীর মায়ের লাশ নিয়ে এর পর শুরু হয় টানাপড়েন। রফিকের মনে হয় পরীর মা তাদের বাড়িতে যেহেতু আশ্রিতা ছিলেন সেহেতু তার কবর এ-বাড়ির কবরস্থানেই হবে। আর রফিকের একমাত্র অভিবাবক, তার চাচা দীন মোহাম্মদের দাবী, পরীর মা যেহেতু আশ্রিতা তার কবর গ্রামের গণকবরেই হওয়া উচিত। দুজনের দুদিকে অবস্থান। শেষ পর্যন্ত পরীর মায়ের লাশ আগলেই বসে থাকে রফিক। গল্পের শেষে আমরা দেখি, রফিকেরও চাচার জন্য মন গলে যায়, চাচাও রফিকের দাবীর প্রতি সহৃদয় হয়। কিন্তু গোরের কী হবে? গল্পটিতে গ্রামের মানুষদের নানা সংস্কার এবং পরম্পরা পেরিয়ে সেই সংস্কার আগলেই বেঁচে থাকার যে প্রচেষ্টা আমরা দেখি তেমনি বাম রাজনীতির তাত্ত্বিক দিক, এবং প্রায়োগিক দিকের অসাধারণ স্যাটায়ারও লেখক অসাধারণ কুশলতায় তুলে ধরেছেন। “নৈশভ্রমণ” একটি স্মৃতিকাতরতার গল্প। গল্পটি উত্তম পুরুষে লেখা। আদিত্য নামের এক যুবকের গল্প এটি। হঠাৎ একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে গল্পের নায়ক আদিত্য শহরের অলৌকিক সৌন্দর্য অবেলোকন করতে করতে নিজের জীবনটাকে পেছনে নিয়ে গিয়ে তার বয়ান দিতে থাকে। আমরা দেখতে পাই, আদিত্য একজন স্মৃতিক্লিষ্ট মানুষ। একা হতে হতে, নিঃসঙ্গ হতে হতে তার কাছে এখন আর কেউ নেই। শহরের একদম বাইওে, লেখকের ভাষায় - "একটি বৈশিষ্ট্যহীন বাড়ির দোতলার একচিলতে কামরায়" সে বসবাস করে। দেখতে পাই, সেখানে একা একা স্মৃতির পাহাড় আগলে পড়ে আছে আদিত্য। সে তার নিঃসঙ্গ বাবার কথা ভাবে, যাকে আদিত্যের বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো মনে হতো। মায়ের কথা ভাবে, আকুলভাবে "মা মা মাগো" বলে ডাকে। বন্ধু কবীরের কথা ভাবে, যে কবিতা লিখতো, মনে পড়ে নীলু আপার কথা, যিনি কিশোর আদিত্যকে গোপনীয় আর অচেনা জগতের নীল হাতছানীর লোভ জাগিয়ে শরীর সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিয়েছিলেন। মনে পড়ে নদীর কথা। যার কাছে আদিত্য তার প্রেমের অর্গল খুলে দিয়েছিল- জানিয়েছিল ভালোবাসার কথা। কিন্তু নদী তার ডাকে সাড়া দেয়নি। আদিত্য যেন সবার মাঝে একটি বিচ্ছিন্ন মানুষ। যার কাতরতা আছে, কিন্তু যুথবদ্ধজীবন বাস্তবায়নে অনীহাও প্রবল। আদিত্য যেন একটিই কাজে পারঙ্গম, সেটি, স্মৃতি আর বিস্মৃতির জাবর কাটা, স্মৃতির রোমন্থন। আদিত্য ভাবে আর এসব স্মৃতিকাতরতায় আক্রান্ত হয়।,শেষে এসে আমরা দেখি-মায়া-প্রেম আর ঘোরতর স্মৃতিতে ডুবে যেতে থাকে সে। “অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না বলে”, গল্পটিও এক অর্থে বিচ্ছিন্নতার গল্প। উত্তম পুরুষে লেখা এ-গল্পে আমরা দেখি, এক যুবক- নাম মঞ্জুর, তার সৎ মায়ের অসুস্থতাজনিত কারণে গ্রামের বাড়ি যাবার তাড়না, বাড়ির পথে রওনা হওয়া, শেষঅব্ধি বাড়ি না পৌঁছে অন্ধকার রাস্তায় পথ ঘুরে অন্যপথে চলে যাওয়া নিয়ে কেমন এক কুহক বিভ্রমের মধ্যে পড়ে যায়। যুবকটি বাড়ি যাচ্ছে, একপর্যায়ে তার ভাবনা-কল্পনার ভেতর লেখক আমাদের ঢুকিয়ে দেন। যুবকটি স্মৃতিচারণার ঘোরে পড়ে যায়। বিচ্ছিন্ন, টুকরো গল্প মিলিয়ে আমরা যেন সমসাময়িক নাগরিক জীবনের একটি প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাই। যেখানে বড়দের দ্বারা ছোটদের বিভ্রান্ত করার প্রবনতা যেমন দেখা যায়, বংশগৌরব আর আপন মা- সৎ মা নিয়ে পরিবারগুলোর যে তথাকথিত ধ্যান-ধারনা সেটিও নিদারুণ ভাবে উন্মোচিত হয়। যুবকটির জন্ম, বেড়ে ওঠা, তার পরিবারের সদস্যদের মূল্যবোধ আর চিন্তা-চেতনা যুবকটির কাছে যেভাবে প্রবাহিত হয়েছে সেটি লেখক আশ্চর্য কুশলতার মাধ্যমে পাঠকের কাছে তুলে ধরেন। টের পাই, পরিবারগুলোর তথাকথিত বংশগৌরব, কৌলিন্য আসলে কতোটা নড়বড়ে। কিসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সম্পর্ক কিংবা কী কারণেই তা ভেঙে যাচ্ছে সেটি যুবকের পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে সমাজের প্রতিচ্ছবির মতো সুনিপুন ভাবে তুলে ধরেন লেখক। শেষে এসে অন্ধকার রাতে পথ ঘুরে ঘুরে তার হারিয়ে যাওয়া যেন জীবন নদীর বাঁক হারানো মানব জীবনের কথাই তুলে ধরে। পাঠকের গ্রন্থপাঠের অলৌকিক পথযাত্রায় ভ্রমণসঙ্গী হবার জন্য এই গল্পগ্রন্থটি অনিবার্য হতে পারে। গল্পগুলোর ভাষা এবং কাহিনির সূক্ষব্যঞ্জনা আবারও প্রমান করে- আহমাদ মোস্তফা কামাল-এর গল্পে স্থূল ঘটনার কোনো ভূমিকা নেই। জীবন সম্পর্কে যে সূক্ষ এবং অন্তর্ভেদি দৃষ্টি তাঁর রয়েছে সেটি তাঁর অধিকাংশ গ্রন্থপাঠেই পাঠকের উপলব্ধি হবে। তাঁর বাহুল্যবর্জিত উপমা, নির্মেদ লেখনি সম্বলিত সাতটি গল্পই হয়তো আহমাদ মোস্তফা কামালের প্রতিভাকে পুরোপুরি তুলে ধরে না। কিন্তু এই গল্পগুলোর মাধ্যমে তিনি যে সামাজিক ত্রুটি-বিচ্যুতির ও সম্পর্কের ক্ষয়-নির্মাণ কে উঠিয়ে এনেছেন তা জীবন সম্পর্কে তাঁর গভীর উপলব্ধিকে যেমন চিহ্নিত করে তেমনি সেসবকে সফলভাবে গল্পে প্রতিস্থাপন করার কুশলতা দেখে গল্পরচনায় তাঁর দক্ষতাকেও প্রমানিত করে।