User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
স্বদেশ হাসনাইন। একজন উদীয়মান তরুণ গল্প বলিয়ে। তিনি অনলাইনে লিখছেন দীর্ঘদিন ধরে এবং প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিন। গল্পগ্রন্থ হিশেবে এটা তার প্রথম গল্প সংকলন। নাম ১০০তম গল্প ও অদৃশ্য মানব। গল্প আছে মোট সতেরটি। প্রত্যেকটা গল্পই নিজস্বতায় ভরপুর এবং আলাদা আলাদা প্রকাশভঙ্গী, আলাদা আলাদা স্টোরিলাইন নিয়ে সফলভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। একটা গল্পের সাথে পরেরটা মিলে না আর এ কারণে পাঠক একটা ধাঁধার ভিতর আটকে পড়ে আর সবকটা গল্প একসাথে পড়লেও গল্পের ভিড়ে হারিয়ে যাবার ভয় পায় না। গল্পগুলো নিজেদের সাবলীল ভঙ্গিমায় পাঠকের কাছে পৌঁছে যায় খুব সহজে। কি একটা মোহ পরের গল্পটাকে পড়তে বাধ্য করে পাঠক সেটা টেরও পায় না। বইটি প্রকাশ করেছে শ্রাবণ প্রকাশনী। প্রকাশকাল বইমেলা ২০১৩। আর বইটির অন্যরকম প্রচ্ছদ করেছেন শারমীন হক সঙ্গীতা। স্বদেশ হাসনাইন একজন সফল গল্প বলিয়ে। তার গল্পে মুনশিয়ানা আছে কিন্তু তথাকথিত পাণ্ডিত্য নেই। নেই গৎবাঁধা প্রেমের সাতকাহন, নেই অসংখ্য চরিত্রের ভিড়ে আসল চরিত্রের হারিয়ে যাবার তাড়া কিংবা নেই একমুখী গল্প বলার প্রবণতা। তার গল্পে আছে রোমান্টিকতা, আছে দেশপ্রেম, আছে বিজ্ঞান প্রযুক্তি, আছে কলকারখানার পরিবেশ দূষণের সুতীব্র বয়ান, সর্বোপরি একজন চৌকস গল্প বলিয়ে হিসেবে তার সবরকমের অভিজ্ঞতাই আমরা পেয়ে যাই তার প্রথম গল্প সংকলনে। এবার দেখি তার গল্পগুলো কি বলছে পাঠকদের উদ্দেশ্যে। প্রথম গল্পের নাম ম্যাগনোলিয়া। আপাতদৃষ্টিতে প্রেমের গল্প মনে হলেও আদতে তা সামাজিক অবক্ষয়েরই প্রতিরূপ বলা যায়। কিংবা বলা যায় মানসিক পীড়নে আক্রান্ত আধুনিক মানুষের দোটানার গল্প। অথবা এই হাইটেক যুগে ননহাইটেক ক্যারাক্টার বেজড গল্পও বলা যেতে পারে। ইউনিভার্সিটির মেয়ে ম্যাগনোলিয়া, যার দাদা এমএ গণি, একসময় বিলেতে ছিলেন আর সেই নবাবী দেখাতে নিজের তিন নাতনীর নাম রেখেছেন ফুলের নামে, তাদেরই একজন ম্যাগনোলিয়া। সে ট্যালেন্টেড, ভদ্র, রুচিশীল এবং কালো এবং সবকিছু ছাড়িয়ে গেছে যেটা তা হলো তার ননটেক ব্যাকডেটেড মানসিকতা, যেটা এই যুগে একদমই বেমানান। তার ফাস্টফুডে আসক্তি নেই, কানে হেডফোন গুজে ডেমকেয়ার ভাব নেই, বরং সে এগুলোকে পাত্তা না দিয়ে নিজের আলাদা একটা আইডেন্টিটি দাঁড় করাতে পেরেছে। যে কারণে আমরা দেখি নায়ক তার প্রেমে পড়তে রাজ্যের কিচ্ছা কাহিনী ভাবছে এবং শেষমেশ বন্ধুদের পরামর্শে সে ম্যাগনোলিয়াকে ভুলে যায়। কালো মেয়েকে কেই বা আর মনে রাখে। কিন্তু সেই কালো মেয়েকেই নায়কের বন্ধু যখন সপ্রতিভ প্রশংসা করে নায়কেরই সামনে তখন আমরা গল্প হিসেবে ম্যাগনোলিয়াকে অন্যদিকে মোড় নিতে দেখি, যা একজন গল্প বলিয়ের আলাদা বৈশিষ্ট্য হিসেবে আমাদের কাছে ধরা দেয়। তথাকথিত প্রেমের বাইরেও একটা আলাদা জগত আছে যেখানে ভালোমানুষির কদর আমাদেরকে মুগ্ধ করে। ১০০তম গল্প ও অদৃশ্য মানব শিরোনাম গল্প। এখানে ছদ্মনামে গল্প লিখে জনপ্রিয়তা পাওয়া এক লেখকের মৃত্যু পরবর্তী হাহাকার উঠে এসেছে চমৎকারভাবে। খুব জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও বাস এক্সিডেন্টে মৃত্যু হলে সেই লেখকের নামটা প্রকাশিত হয়না মৃত্যু তালিকায় আর এভাবে সে সাধারণ একজন মানুষের মত চিরতরে হারিয়ে যায়। তার কোন স্মৃতি থাকে না আর। তাই সে মনের দুঃখে কবর থেকে উঠে নিজের ঘরে বেড়াতে আসে কি করছে তার একমাত্র স্ত্রী আর সন্তান তাকে ছাড়া। কিন্তু এসে যা দেখে তাতে তার আর আক্ষেপের সবটুকু ভেঙে যায়। তাই সে আবার চলে যায় কবরে। তখন তার সাথে দেখা হয় মৃত সেইসব আত্মাদের সাথে যারা তার দুঃখ বোঝে এবং তাকে পরিচিত করে দেয় অন্যান্যদের সাথে যারা তার মত আইডেন্টিটি ছাড়াই দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে আর সভ্যতা নির্মাণে অবদান রাখছে। গল্পটি আমাদেরকে নাড়া দিয়ে যায় আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগা একদল সভ্যতা নির্মাণ শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রম আর তা থেকে মুক্তির পথ বাতলে বেঁচে থাকার উদ্দীপনার মধ্যে। বস্তুত, আমাদের সবকিছুই নশ্বর, আমরা কেবল এক অবিনশ্বর জীবন যাপন করে যাই প্রতিদিন; এই হলো গল্পের মূল সুর। যমুনা এক্সপ্রেস। চিরচেনা প্রেমের গল্প হলেও কোথায় যেনো একটা আলাদা হাহাকার আমাদেরকে ভাবায়। নারীর অসহায়ত্বকে কেবলই করুণা ভেবে যারা যুগে যুগে দমন করেছে নারীত্বকে, আলাদা মানুষ হবার মর্যাদা দেয়নি তাদের জন্য করুণা হয়। তিনজন মানুষের গল্প হলেও একটা মেয়েশিশুকে আমরা দেখি আরেকবার বলি হওয়া পুরুষতন্ত্রের শিকার হবে বলে। প্রেমের চিরায়ত পথ আর মতকে লেখকের হাতে ঝলমলে আলো হতে দেখি আর কোথায় জানি একটা আশ্বাস আমাদেরকে আহত করে যায়, ভেঙে যাবে কি বিশ্বাসঘাতকতার এই সংসারধর্ম। ময়মনসিংহ এর আঞ্চলিক ভাষা খুব সুন্দর করে উঠে এসেছে পাত্র পাত্রীর মুখে। অন্য এক গল্প এক নিঃসন্তান দম্পতির হাহাকারে ভরপুর। জন্মনিরোধ পিল আর তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে খুব সুন্দরভাবে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন আর মৃত সন্তানের চিঠিতে ঝরে ঝরে পড়ছে আবেগের ফুলঝুরি, যা একজন নিঃসন্তান বাবাকে অপরাধী করে দেয়। আর তাদের ভালোবাসা এত সুন্দর করে উঠে এসেছে যে গল্পটি অন্য এক মাত্রা পেয়েছে লেখকের সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায়। অবশেষে গল্পটি আমাদের এই শিক্ষা দিয়ে শেষ হয় যে, সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াই জীবনের ধর্ম এবং আমরা দেখি একেবারে শেষ দৃশ্যে, পথ ভুলে বাড়ীর গলি ছাড়িয়ে গেলে গাড়িটিকে সামনের দিকেই যাবার ইঙ্গিত দিচ্ছেন গল্পের নায়ক। একদিন জুম্মন এক পীরবংশীয় নাতীর অলৌকিকতার গল্প। কিছু ব্যাপার থাকে বোঝার অতীত সেটাই এই গল্পে লেখক তুলে ধরেছেন। অলৌকিকতার কিছু নমুনা আমরা দেখি— “এরপর নিউমার্কেটের বারী স্টুডিওতে ঢুকে ব্যাগ থেকে নানার ছবির খামটা বের করতে গিয়ে জুম্মনের আত্মা চমকে উঠে। ব্যাগটা ঠিকই আছে কিন্তু ভেতরে কোন ফটোর খাম নেই। ব্যাগটার ভেতরটা সম্পূর্ণ অপরিচিত। পড়ে আছে কয়েকটা হলুদ মাটির পাখি।” অবহেলা গল্পের প্রেক্ষাপট এ সময়ের টেক ছেলেমেয়ে আর তাদের ভার্চুয়াল প্রেমের গল্প। মেসেঞ্জার, চ্যাটরুম আর তাদের অন্ধকার জগতের ছবিই নয় শুধু সেই সঙ্গে তাদের মানসিকতার বিকার এবং তা থেকে উত্তরণের পথ না জেনে আরো বিপথগামীতার গল্প। শেষ পর্যন্ত একটা ভার্চুয়াল রিলেশনের মৃত্যু আমাদেরকে আহত করে দেয়। আর তার পরিণতি কি নিদারুণ সেটাও জানা হয়। দেহজ গল্পটি অন্যরকম একটা গল্প। চিকিৎসা বিজ্ঞানের আধুনিকতা আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাবে তার একটা নমুনা লেখক এঁকেছেন এই গল্পে। অর্গানিক মৃত্যু। যার মানে হলো দেহ চ্যাঞ্জ করে অন্য একটা দেহে আত্মাকে ঢুকিয়ে দেয়া। এরপর কি ঘটবে সেটা লেখক দেখিয়েছেন খুব সুন্দরভাবে। যার পরিণতি তার স্ত্রীর নিখোঁজ হয়ে যাওয়াটা। দেহজ গল্পটি কিছুটা শিরোনাম গল্পের ছায়া হয়ে থাকে, যদিও দুটোর প্লট আলাদা। লেখকের বুদ্ধিদীপ্ত বলার স্টাইল গল্পকে আলাদা একটা অনন্য মাত্রা দিয়েছে। ডাঃ ইয়েসমীনের একটি সন্ধ্যা গল্পে একটা নিঃসন্তান দম্পতির ভিন্ন গল্প বলেছেন লেখক যেখানে স্বামীটির সন্তান নেয়ার অক্ষমতা লুকিয়ে এককালের ডাঃ বন্ধুর কাছে নিজের অক্ষমতাকে করজোড়ে প্রার্থনার মত করে বলেছেন লেখক। নিজের সংসার টিকাতে পুরুষের এমন দুর্বলতাকে বিষয় করে আর কেউ গল্প লিখেছেন বলে মনে পড়ে না। সত্যি গল্পের বিষয় হিসেবে এটা ভিন্ন একটা গল্প। বৃষ গল্পটি একটি চমৎকার গল্প। না খেতে পারা একদল গ্রামবাসীর কাছে হঠাৎ করে একটা ডাইনোসর কি ভয়ঙ্কর রকম কাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠে সেটা গল্পের পরতে পরতে বলে গেছেন লেখক। শেষপর্যন্ত নাসার বিজ্ঞানীরা ডাইনোসরের হাড়ও খুঁজে পায়নি নিরন্ন গ্রামবাসীর কাছে। ভিলেজ পলিটিক্সের কিছু নোংরামো লেখক এই গল্পে দেখিয়েছেন যা আমাদের প্রতিদিনকার গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সূর্যরথিকা এই সময়ের গল্প। ইন্টারনেটে লেখালেখি করে এমন চরিত্র আমরা বিদেশী গল্প পেলেও বাংলা গল্পেও আসছে ধীরে ধীরে। কবিতা লেখা শিখানোর কোন নিয়ম হয়তো আছে কিন্তু নিজের ভাব অন্যকে কিভাবে শিখানো যায় তার বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। আর শেষ পর্যন্ত যাকে কবিতা শিখাতে আসেন সে যে তারই এক প্রিয় কবি সেটা বোঝে কবি চলে যান। সোনারগাঁ টিনা আর সজীবের প্রেমের গল্প হলেও শেষপর্যন্ত টিনার চলে যাওয়া কালো দিনের আখ্যানই হয়ে থাকে। Every Brick tells different stories বুকে নিয়ে সজীব অপেক্ষা করে কি টিনার, আমাদের জানা হয় না। শুধু দেখি সালভারেজ একটা মেইলে কয়েকটা ছবি পাঠায় যেখানে সজীব আর টিনা পাশাপাশি লাল ইটের বাড়িটির সিঁড়িতে বসা। মৃত্তিকা ও সামান্য ঘৃণা। স্বাধীনতাবিরোধীরা আমাদের কিভাবে পথভ্রষ্ট করে তার একটা ছক এঁকেছেন লেখক এই গল্পে। শেষ পর্যন্ত মৃত্তিকা ওদের খেলার পুতুল হওয়া থেকে বেঁচে যায় নিজের রক্তে স্বাধীনতার সোনালি বীজ রোপণ করা ছিলো বলে। আর চাকরির অফার লেটারটাকে কুচিকুচি করে ছিঁড়ে সমস্ত ঘৃণা ওদের দিকে ছুঁড়ে মারে মৃত্তিকা। জয় হয় চেতনার, জাতীয়তার। আর লেখকের কলমের ডগায় আমাদের চেতনার বাণী জয়গাঁথা হয়ে গল্পকে আলাদা করে দেয় আমাদের স্বাধীনতাবিরোধীদেরই মত অচ্যুত কোন জাতি হিসেবে। ঘৃণায় রিরি করে উঠে বিবেক। বাংলা গল্প দুনিয়ায় নতুন হলেও স্বদেশ হাসনাইনের লেখায় আলাদা একটা ধার আছে। কি বলায়, কি বিষয়ে নির্বাচনে, কি প্রেক্ষাপটে। বেশী নজর কেড়েছে বিষয় বৈচিত্র্যে। এত সব বিষয়কে একসাথে কোন লেখক মলাট বন্দি করেছেন বলে মনে পড়ে না। আর সে বিষয়গুলো এমনি যে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের নানাবিধ সমস্যা আর তা থেকে উত্তরণের এবং অনেকগুলো গল্পের বিষয় ছিলো আধুনিক যুগের ম্যাটেরিয়ালকে উপজীব্য করে যেটা আমরা আমাদের সময়ে ধীরে ধীরে প্রবেশ করতে দেখছি। তার গল্প কোথায়ও উপদেশ নেই, মানা না মানার দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগা নেই, সরল করে সহজ ভাষায় গল্প বলে গেছেন লেখক। আর যদি প্রশ্ন করা হয় সামাজিক দায় কতটা পালন করেছেন, আমি বলবো, লেখকের কাজ সামাজিক দায় পালন করা না, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া কি কি অবক্ষয়ের মাঝে আমাদের বাস। সেদিক থেকে লেখক সফল। আরো গল্প আছে পাঁচটি। কারাগার, ভালবাসা, প্রতিশোধ, খেলা এবং নিমরীয়দের উপকথা নামে। সবগুলো গল্পই পাঠকের অতৃপ্ত মনে তৃপ্তি দেবে নিঃসন্দেহে। কিছু কিছু বানান বিভ্রাট আছে বইটিতে। মজার জিনিস হলো বইয়ের প্রচ্ছদে কোথায়ও লেখকের নাম নেই। কাগজের মান ভালো হলেও সে তুলনায় দামটা অনেক বেশী মনে হয়েছে। আর সতেরোটা গল্প একটু বেশীই মনে হয়েছে। বাংলা গল্প সাহিত্যে স্বদেশ হাসনাইন একজন সফল রথীর জন্ম দেবেন এই কামনা রইল লেখকের প্রতি। আমাদের সম্মিলিত অনুরোধ তিনি যেনো লেখা চালিয়ে যান। একদিন হয়তো আমাদের গল্পের বিষয় নিয়ে পরের জেনারেশন গর্ব করবে, আমাদের এতসব ম্যাটেরিয়াল আছে গল্প বলার, দেখে। সেদিনের অপেক্ষায় থাকলাম। প্রিয় স্বদেশ, বুকের মানচিত্রে আরেকটা স্বদেশ ধারণ করে এগিয়ে যান। একদিন সুদিন আসবেই এই কামনায়।