User login
Sing In with your email
Send
Our Price:
Regular Price:
Shipping:Tk. 50
প্রিয় ,
সেদিন আপনার কার্টে কিছু বই রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন।
মিলিয়ে দেখুন তো বইগুলো ঠিক আছে কিনা?
Share your query and ideas with us!
Was this review helpful to you?
or
ফোনোগ্রাফ, রেকর্ড প্লেয়ার কিংবা ঢের আগেকার ১৮৭৭ সালে ধ্বনি তরঙ্গে বাজানোর জন্যই উদ্ভাবিত স্মৃতি ও শ্রুতির অন্তর্গত গ্রামোফোনযন্ত্রই গুচ্ছ বাঙালির সুপরিচিত কলের গান। চোঙওয়ালা গ্রামোফোনযন্ত্রটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় বিগত শতাব্দীর চতুর্থ দশকেই। যেটিকে আমাদের দেশওয়ালি ভাষায় বলা কলের গান। যার বেশির ভাগই পাওয়া যেত উপহার হিসেবে। বাঙালির কলের গান বইটির লেখক প্রীতিভাজন আবুল আহসান চৌধুরীর কথা দিয়েই শুরু করা যাক, ‘পিতামহের কল্যাণে আমাদের বাড়িতে গ্রামোফোনের প্রবেশ ঘটেছিল গত শতকের বিশের দশকেই আমার জন্মেরও বহু আগে। শোনা যায়, আমার পিতা ১৯২১ সালে জলপানি পেয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করায় এই গান শোনার যন্ত্রটি উপহার পান। সেই চোঙওয়ালা গ্রামোফোনযন্ত্রটি একেবারে ছেলেবেলায় আমাদের বিস্ময় বিমুগ্ধ করে রাখত। ভেবে কূল-কিনারা পেতাম না অতটুকু যন্ত্রের মধ্যে মানুষ কী করে লুকিয়ে থেকে গান গায়। বড়রা রেকর্ড চালিয়ে দিলে আমরা গোল হয়ে বসে গান শুনতাম।’ আমরা তো কোন ছার স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই আকুল হয়ে গ্রামোফোনের শরণাপন্ন হয়েছেন এই বলে, ‘ও ভাই কানাই, কারে জানাই দুঃসহ মোর দুঃখ।/ তিন-চারটে পাস করেছি। নই নিতান্ত মুকখ\/ তুচ্ছ সা-রে-গা-মা-য় আমায় গলদঘর্ম ঘামায়।/ বুদ্ধি আমার যেমনি হোক কান দু’টো নয় সূক্ষ্ম—/ এ বড়ো মোর দুঃখ কানাইরে/ এই বড়ো মোর দুঃখ\/ বান্ধবীকে গান শোনাতে ডাকতে হয়ে সতীশকে,/ হূদয়খানা ঘুরে মরে গ্রামোফোনের ডিস্কে।’ গত শতকের চার দশক ছিল কলের গানের ভরা যৌবন। দিকে দিকে মুখরিত হচ্ছে কাননবালার সেই অবিস্মরণীয় ‘আমি বনফুল গো, ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে’ উল্টো পিঠে রয়েছে ‘যদি আপনার মনে মাধুরী মিশায়ে। এঁকে থাকো কারো ছবি/ সে কথা ভুলিয়া যেও’, আর আব্বাসউদ্দীনের ভাওয়াইয়া বা ভাটিয়ালি সেই সঙ্গে আছে বাংলার চিরন্তন লোকগীতি। কিঞ্চিদধিক ৮০ বছর বয়ঃক্রমের মধ্যে কলের গান নিয়ে কত যে রঙ্গ, এই বই তারই সামান্য নিদর্শন। কুষ্টিয়া মজমপুর নিবাসী আবুল আহসান চৌধুরীর লেখালেখির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় সেই সুদূর মধুর গত শতাব্দীর আটের দশকের শেষাশেষি থেকে। যখন আমি সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানীর সম্পাদনাকাজে নিযুক্ত। তখন অবশ্য তাঁর সম্পাদিত লোকসাহিত্য পত্রিকার কথাও উল্লেখ করতে হয় তার বিষয়-বৈচিত্র্য আর বৈদগ্ধ্যের জন্য। সে সময় সচিত্র সন্ধানীও তার লিখন-কৌশলতা থেকে বঞ্চিত হয়নি। তাঁর সদ্যতন বাঙালির কলের গান হাতে পেয়ে ও পড়ে মুগ্ধতার সঙ্গে কিছু বিনীত প্রশ্নও মনে জেগেছে। এক জায়গায় প্রকৃত তিনি লিখেছেন, ‘আশির দশকের সূচনা থেকে শেষের কাহিনী জানার ঝোঁক আর মুলুক-সন্ধানের পালা শুরু হলো।’ এখানে তিনি আরও লিখেছেন, ‘ঢাকায় এক আবদুস সাত্তার আর আংশিক আসাদুল হক ছাড়া তেমন কারো সহায়তা পাইনি। এই কাজের যোগ্য জায়গা যে কলকাতা তা বুঝতে বেশি দেরি হয়নি। অবশ্য এর সংগত কারণও আছে। কলের গানের কদর এখনো কলকাতার স্মৃতিকাতর সংগীত সমঝদার রেকর্ড সংগ্রাহকদের মধ্যে আছে।’ ভাবতে অবাক লাগে আবুল আহসান চৌধুরীর মতো একজন দক্ষ, বিজ্ঞ তদুপরি মনন-জ্ঞান-জ্ঞাপনের অধিকারী কীভাবে এসব কথা লিখলেন! বইটি যাঁকে উৎসর্গ করা হয়েছে, সেই ‘সুররসিক চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরী শ্রদ্ধাভাজনেষু’র কথা কি তিনি জানতেন না যে সংগীত সমঝদার ও রেকর্ড সংগ্রাহক হিসেবে তিনি কতটা এলেমের অধিকারী। আমরা কিন্তু ছোটবেলায় কাইয়ুম চৌধুরীর বাড়িতেই প্রথম কলের গানে শচীন কর্তার কণ্ঠে ‘প্রেমের সমাধি তীরে’ গানটি শুনি। এই ঢাকাতেই আমাদের জানামতে ছিলেন ফেনীর অদূরে মঙ্গলকান্দি নিবাসী পরম বৈষ্ণব বাবু কেশব চন্দ্র দত্ত গুপ্ত মহাশয়। রেকর্ডসংগ্রাহক তো বটেই, এ ছাড়া বিভিন্ন রাগরাগিণী-আশ্রিত গানের প্রকৃত রসবেত্তা। তাঁর ঘরেই শুনেছি, ‘তুমি কাদের কুলের বৌ গো...’ এখনো কান থেকে তার রেশ যায়নি। আরেকজন মাহবুব আলম, যিনি রাষ্ট্রদূত হিসেবে কলকাতা বসবাসকে যে কী সুন্দরভাবে কাজে লাগিয়েছেন, ভাবতে অবাক মানতে হয়! তাঁর সংগৃহীত দুষ্প্রাপ্য জিনিসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কলের গানের রেকর্ড ও অভিজাতপাড়ার বাসিন্দাদের ব্যবহূত দুর্লভ টুকিটাকি সামগ্রী। একসময় এসব জিনিস সংগ্রহের জন্য নামকরা যেসব মানুষের ভিড় হতো, তাঁদের অনেকেই আজ আর ধরাধামে নেই। এই যেমন নামডাকওয়ালা লেখক-সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ, তাঁরই বন্ধু সুরঞ্জন সরকার, টাটা কোম্পানির পাবলিক রিলেশন্সের বড় সাহেব রাধাপ্রসাদ গুপ্ত। পুরোনো দিনের শাস্ত্রীয় সংগীতের বহু দুর্লভ গানের রেকর্ডের মধ্যে প্রবাদপ্রতিম রসুলন বাইর কণ্ঠনিঃসৃত সুরলহরী শুনে দুই কান ধরে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হয়েছিল। তার পরও ঝড়তি-পড়তি যাঁরা ছিলেন, তাঁদের নিয়ে তাঁর সংগ্রহশালার বহর নেহাত কম ছিল না। কলকাতার অথৈ হূদিরত্নাকর সেচে তিনি যেসব অমূল্য মণিমাণিক্য নিয়ে এসেছেন, তাঁরই বা মূল্য কম কী? কলকাতায় তিনি যাঁদের সঙ্গে সহবৎ করতে পেরেছিলেন, তাঁদের মধ্যে আমলা সম্প্রদায়কে বাদ দিয়ে কলকাতাকে যিনি কালকুত্তা থেকে নিজ নামে ফিরিয়ে এনেছিলেন সেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আমাদের সময়ের আরেক শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সম্মিলিত মেলবন্ধনের পুরোধা পূর্ণেন্দু পত্রী, দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য বইপত্র আর প্রত্নতাত্ত্বিকসামগ্রীর ক্রেতা-বিক্রেতা অগাধ জ্ঞানের অধিকারী কমলকুমার মজুমদারের পার্শ্বচর বাবু ইন্দ্রনাথ মজুমদার, যিনি মাত্র এই কদিন আগে প্রয়াত হলেন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এমনিতর নানাজনে আমাদের অতিসন্ধিৎসু আবুল আহসান চৌধুরী নাছোড়বান্দার মতো লেগে থেকে কে. মল্লিকের ওপর একটা আস্ত বই-ই লিখে ফেলেছেন। এসব কাজে নিঃশর্ত সহায়তা পেয়েছেন ৪০-এর অন্যতম কবি গোলাম কুদ্দুসের। এ ছাড়া কলের গানের মাল-মসলা সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি কলকাতা শহরের আঁতিপাঁতি খুঁজে কলের গানসংক্রান্ত যেসব বিচিত্র তথ্য জোগাড় করতে পেরেছিলেন, এ বই তারই সংকলন। সচিত্র বইটিতে কেবল শিল্পীদের ছবি নয়, কলের গানের নানা বিবর্তনের আর্ট পেপারে ছাপা আলেখ্য বেশ কৌতূহলোদ্দীপক হলেও বাজে ছাপার কারণে বইটির অস্বস্তিকর ওজন বাড়ানো ছাড়া উৎকর্ষের কোনো কাজে লাগেনি। প্রতি পর্ব শেষে গ্রন্থঋণ উল্লেখ থাকলেও এ ধরনের বইয়ের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও জরুরি নির্ঘণ্ট বা সূচির অভাব প্রতি মুহূর্তেই অনুভূত হয়। ভাবতে অবাক লাগে, অভিজ্ঞ ও কুশলী ব্যক্তিরা থাকতে রুদ্ধশ্বাসে পড়ে শেষ করার মতো এ ধরনের বইও কেন প্রত্যাশার মাত্রা ছুঁতে পারল না! বাঙালির কলের গান পড়ে সুখের বদলে বকাণ্ডপ্রত্যাশাই রয়ে গেল। অথচ আবুল আহসান চৌধুরী, এই বই লিখতে গিয়ে অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য বই ঘাঁটাঘাঁটি আর কম খাটাখাটনি করেননি যে তার প্রমাণ তিনি দিয়েছেন মেগাফোনের কমল ঘোষ মহাশয় আর কলের গানের সোনালি সময়ের গায়িকা যূথিকা রায়ের চমৎকার সাক্ষাৎকার দুটিতে। এই লেখাটির কলেবর সংক্ষিপ্ত করার বাধ্যবাধকতা থাকার কারণে অনিচ্ছাসত্ত্বেও যতি টানতে হচ্ছে। কলের গানের প্রচলন হয়েছিল বিগত শতাব্দীর প্রথম দশকে ইংরেজ মালিকানায়। এরপর নানা উত্থান-পতন ও ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে ওই শতাব্দীর শেষাশেষি নতুন নতুন যান্ত্রিক উদ্ভাবনীর কারণে কলের গানের দিনও অস্তমিত হওয়ার পথে। তবে সেই দীর্ঘসময় ধরে কলের গানকে ঘিরে বিভিন্ন পর্ব-পর্বান্তরের ঘটনা নিয়ে যেসব কাহিনি আবর্তিত হয়েছে, তারই এক সংক্ষিপ্ত বয়ান লেখক বিবৃত করেছেন অত্যন্ত দক্ষ হাতে। কলেবরের কথা মাথায় রেখেই হয়তো তিনি এমন আঁটোসাঁটো রীতি আশ্রয় নেওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই বিশদ বিবরণে যাওয়া সম্ভব হয়নি। অবশ্য তাই বলে রসকষহীন স্থূল দর্শিতায় যে পর্যবসিতও হয়নি, তারও প্রচুর নজির রয়েছে বইটির পরতে পরতে। তবে হ্যাঁ, আরও কিছু ঢের বেশি কৌতুকী, রঙ্গ-রসিকতা, নকশা থাকলে মন্দ হতো না। যেমনটা রয়েছে বিষাদ-সিন্ধুর লেখক মীর মশাররফ হোসেনের ভাষ্যে। পত্নীর মৃত্যুতে শোকাতুর মশাররফ বিবি কুলসুম (১৯১০) বইয়ে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কুলসুমের কলের গানের প্রতি অনুরাগের কথা জানিয়েছেন।